শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের নাম আমরা স্কুলজীবন থেকেই শুনে আসছিলাম। সাধনা ঔষাধালয়ের সঙ্গে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়, একটি যেন অন্যটির পরিপূরক ছিল। সেই ছোট বয়সে ফেনী শহরে গেলে ‘সাধনা ঔষধালয়’ যেমন এখানে ওখানে কয়েকটি দেখতাম, তেমন দেখতাম ‘কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়’ও। বড় বড় সাইনবোর্ডে তখন ঔষধালয় দুটির প্রতিষ্ঠাতা দুজন– অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ এবং অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র হিংহের নাম দুটিও জ্বলজ্বল করত।
সাধনা এবং কুণ্ডেশ্বরীর কারণে এই দুজন তখন তৎকালীন সারা পূর্ব বাংলাতে তো বটেই, তাঁরা পরিচিত ছিলেন বাংলার বাইরের দুনিয়ার আরও অনেক জায়গায়, যেখানে বিশেষ করে বাঙালির বসতি-বসবাস ছিল। ’৭১এর মুক্তিযুদ্ধে এই দুজনই শহীদ হয়েছিলেন। চুরাশি বছর বয়সী যোগেশচন্দ্র ঘোষ ’৭১এর ৪ এপ্রিল, নূতন চন্দ্র সিংহ ১৩ এপ্রিল। এই দুজনের মতো আরও একজন– আর পি সাহা– রণদা প্রসাদ সাহাকেও ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছিল পাকিস্তানের ঘাতক বাহিনী, আর পি সাহার সঙ্গে তাঁর একমাত্র ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকেও এই ঘাতকরা মেরে ফেলেছিল। শিশু রাজীব, রাজীব সাহার বয়স তখন মাত্র তিন।
শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ
শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ
এই তিন জন রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না। ’৭০এর সাধারণ নির্বাচনে তাঁরা হয়তো ভোট দিয়েছিলেন গোপন ব্যালটে। হয়তো তাঁরা বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদেরই ভোট দিয়েছিলেন এই নির্বাচনে। কিন্তু তার চাইতেও তাঁদের বড় ‘অপরাধ’ ছিল, তাঁদের তিনজনই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানের ঘাতক বাহিনী এবং দেশীয় রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান দুই টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ এবং হিন্দু সম্প্রদায়। ঐ এক ভয়ঙ্কর ভয়াবহ অন্ধকার বছরে দোষী, নির্দোষ বিচার বিবেচনা করার কোন দরকার ছিল না ঘাতকদের। আওয়ামী লীগ এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ হলেই তাকে ‘গুরুতর অপরাধী” বিবেচনা করে রায় তাৎক্ষণিক কার্যকর করা হত।
যেমন করা হয়েছিল, ১৯৭১ এর ১৩ এপ্রিল ঋষিপুরুষ নূতন চন্দ্র সিংহের ক্ষেত্রে, রাউজান উপজেলার কুণ্ডেশ্বরী মন্দিরে।
দুই
’৭১এ নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যার খবর লন্ডনেই পেয়েছিলাম। ওখানকার পত্রপত্রিকায়ও মানবকল্যাণে নিবেদিত এমন এক জন মানুষকে কোনো রকমের সামান্যতম অপরাধ ছাড়াই মেরে ফেলার ঘটনা আমাদের প্রবাসী বাঙালিদের তো বটেই, আলোড়িত করেছিল আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ভিনদেশি নীতিনির্ধারকদেরও। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের সৃষ্ট রাজাকার আলবদররা কেমন নিষ্ঠুর, বর্বর চরিত্রের ছিল, তার উদাহরণ হিসাবে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ, শহীদ যোগেশ চন্দ্র এবং শহীদ আর পি সাহার মতো মানুষজনের কথাও আমরা বর্ণনা করেছি তখন। নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আমাদের লক্ষ লক্ষ শহীদের সঙ্গে এদের আত্মত্যাগ বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে আমাদের কাজ সহজ করে দিয়েছিল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টিতে প্রকৃত অর্থেই নন্দিত ভূমিকা রেখেছিলেন তারা।
অন্য যে কোনো মানুষের মতোই আমিও জীবনে সরল সহজ ধর্মপ্রাণ মানুষ দেখেছি অনেক। কিন্তু নূতন চন্দ্র সিংহ যে এত সরল এবং মনেপ্রাণে এমন কঠোর দেশপ্রেমিক একজন মানুষ তা ব্যাখ্যা করতে পারছিলাম না অনেক বছর।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন চট্টগ্রাম শহরের একটি অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ভূমিকা ছিল সদ্য সৃষ্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারিদেরও। কিছুদিনের মধ্যেই যখন স্পষ্ট হয়ে উঠল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আর নিরাপদ নয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারিরা খুঁজতে থাকলেন নিরাপদ জায়গা। এই পর্যায়ে এগিয়ে এলেন নূতন চন্দ্র সিংহ। তাঁর বাড়িঘর স্কুল বিদ্যালয়-বিদ্যামন্দির খুলে দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।
এখন লক্ষ্য করুন নামগুলো যারা আশ্রয় নিলেন অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সে:
১. প্রফেসর ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিক, উপাচার্য;
২. প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ এবং ডিন, কলা অনুষদ;
৩. ড. আনিসুুজ্জামান, রিডার, বাংলা বিভাগ;
৪. ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ;
৫. হায়াৎ মামুদ, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ;
৬. মাহবুব তালুকদার, গবেষণা সহকারী, বাংলা বিভাগ;
৭. মনিরুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক বাংলা বিভাগ;
৮. ফজলী হোসেন, রিডার, গণিত বিভাগ।
রাউজান উপজেলার কুণ্ডেশ্বরী মন্দির
রাউজান উপজেলার কুণ্ডেশ্বরী মন্দির
২০০১ সালে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রফেসর মনিরুজ্জামানের সম্পাদনায় এবং শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের তিন ছেলের মধ্যে একমাত্র জীবিত কনিষ্ঠতম সন্তান প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহের সহযোগিতায় প্রকাশিত ‘স্মৃতিদীপ’ নামের একটি প্রকাশনায় বেশ কয়েক জন বুদ্ধিজীবীর লেখা দেখছি। প্রফেসর মনিরুজ্জামানের ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদ নূতন চন্দ্র সিংহ’ নামের লেখাটির শেষে সংযোজিত তালিকাটিতে এমন ২৭ জন অধ্যাপক, কর্মকর্তার নাম আছে। সকলের নাম স্পেসের অভাবে দিতে পারলাম না বলে মাফ চাইছি। উপরে যাদের নাম দিয়েছি তাঁরা সকলেই আমার পরিচিতি।
ড: আজিজুর রহমান মল্লিক ভারতে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার ছিলেন। পরে অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদের পতদ্যাগের পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীও ছিলেন কয়েক মাস। প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানেরও ব্যাপক পরিচিতি আছে দেশে। কয়েক বছর আগে তারা দুজনই মারা গিয়েছেন।
উপরের তালিকার অন্য ছয় জন বেঁচে আছেন এবং দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন আরও বেশি জ্বলজ্বল করছেন। এই তালিকার একজন প্রফেসর ফজলী হোসেন কয়েক বছর আগেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাসেলর ছিলেন। আর প্রফেসর মনিরুজ্জামান (তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মনিরুজ্জামান নন) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং কলা অনুষদের ডিন ছিলেন, এখন ধানমণ্ডিতে অবসরজীবনেও ব্যস্ত সময় কাটাছেন। তাঁর আর একটি পরিচয়, ৫০ বছর আগে আমাদের জামানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট আবদুল হাই তাঁর শ্বশুর।
এই মানুষগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিতই লিখলাম এই কারণে যে, তাঁরা যখন কুণ্ডেশ্বরীতেও পাকিস্তানি হানাদারদের সম্ভাব্য হামলা আঁচ করতে পারলেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন কাছের ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় চলে যাবেন। তখন তাঁরা নৃতন চন্দ্র সিংহকেও নিয়ে যেতে চাইলেন তাঁদের সঙ্গে। অনেক বোঝালেন তাঁরা তাকে, কিন্ত তিনি তাঁর দেশ, দেশের মাটি এবং তাঁর দেবী কুণ্ডেশ্বরীকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না। তাঁর এক কথা, তিনি তো কারও ক্ষতি করেননি, সুতরাং তাঁর ক্ষতি কে করবে!
প্রফেসর মনিরুজ্জামানের উপরে উদ্ধৃত লেখাটির নিচে উদ্ধৃত অংশটিতে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের তখনকার মনোভাব, অবস্থান এবং দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থই প্রতিফলিত হয়েছে:-
‘‘তিনি বলেছিলেন–
- ‘মা আদেশ না করলে আমি এখান থেকে যেতে পারি না।’
- প্রশ্ন হল, ‘কিন্তু এখানে থেকে আপনার যদি ক্ষতি হয়?’
- ‘বুঝব সেটা মায়েরই অভিপ্রায়।’
এটা যেমন তিনি বলেছেন, তেমনি এদেশের আরও বহু ঋষি বলে গিয়েছিলেন।
শ্রী অরবিন্দেরও ছিল এই সত্যোপলব্ধি, এটাই ছিল চণ্ডীমন্ত্র, এটাই ছিল সকল তপস্যার লক্ষ্য ও প্রাপ্তি।
‘পয়ৈতু মৃত্যুমৃতংম ঐতু’– মৃত্যু পরগত হোক অমৃত্যুতে, জীবন পূর্ণ হোক।
এই উপলব্ধি থেকেই নূতন চন্দ্র সত্যের মধ্যে জীবনকে দেখতে চেয়েছিলেন।
তাই তিনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অন্যদের কথায় আশ্চর্য কণ্ঠে এই উচ্চারণ রেখেছিলেন–
- ‘সত্য ও ধর্মের পথে যে থাকে, তার বিনাশ হয় না।’
নূতন বাবু অবিনাশী হলেন, সত্য ও বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়লেন না। তিনি নিরস্ত্র যুদ্ধ করলেন নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে এবং মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুকে জয় করলেন।’’
তিন
শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের উপর “বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র” অষ্টম খণ্ডের ৪৬৫ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলো আছে। এই কথাগুলো ১৯৭২এর ১৩ এপ্রিলের (অধুনালুপ্ত) দৈনিক বাংলা থেকে নেওয়া হয়েছে:
‘‘তাঁর একমাত্র ইচ্ছে ছিল তিনি যেন দেশের মাটিতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। সে ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়েছে। দেশের মাটিতে তিনি মরতে পেরেছেন। তবে বড় নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে– কখনও কেউ যা কল্পনাও করেনি।
গত বছর এই ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের অদূরে নিজের হাতে গড়া কুণ্ডেশ্বরী ভবনে তাঁকে হত্যা করা হয়। কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা বাবু নূতন সিংহের কথা বলছি। এপ্রিলের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহরের পতন হয়েছিল। ১৩ তারিখে পাক বাহিনী কুণ্ডেশ্বরী আক্রমণ করে। বাবু নূতন সিংহ তখন মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৭ জন অধ্যাপক সস্ত্রীক আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। সৈয়দ আলী আহসান, ড. এ আর মল্লিক, ড. আনিসুজ্জামান, ড. কোরাইশী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রাম থেকে আগরতলা যাওয়ার পথে এম আর সিদ্দিকীও কুণ্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পাক বাহিনীর অগ্রগতির খবর শুনে সবাই কুণ্ডেশ্বরী ছেড়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। বাবু নূতন সিংহকে যাওয়ার কথা বললে তিনি রাজি হননি। বলেছিলেন, যদি মরতে হয় দেশের মাটিতেই মরব। অনেক পীড়াপীড়ির পরও তাকে রাজি করানো গেল না। এদিকে পাকবাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছিল। ১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী কুণ্ডেশ্বরী ভবনে প্রবেশ করে।
শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয় ২০১১তে
শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয় ২০১১তে
ছেলেরা আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। বাবু নূতন সিংহ তখন মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন। জনৈক সালাউদ্দীন তাঁকে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এসেছিল। তাঁর চোখের সামনে মন্দির উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল নৃশংসভাবে। মেজর তিনটি গুলি করার পরও সালাহউদ্দীন রিভরবারের গুলি ছুঁড়েছিল নূতন বাবুর দিকে। তিনি লুটিয়ে পড়েছিলেন। তেমনি মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন তিন দিন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
নূতন বাবুর জন্ম ১৯০১ সালে। শৈশবেই তিনি মাতৃ-পিতৃহারা হন। আট বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন। তিনি নয় বছরে বার্মা যান। সেখানে মুদির দোকানে চাকুরী করেন। ১৯২২ সালে চট্টগ্রাম ফেরেন এবং বিয়ে করেন। তারপর কলকাতা যান। ১৯৪৬ সালে ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিহারের বৈদ্যনাথ ধামে গিয়ে কুণ্ডেশ্বরী মায়ের কবচ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।
কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যাপীঠ
নিজের মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি তিনি। সে জন্য একটা ক্ষোভ ছিল মনে। তখন রাউজান থানায় কোনো বিদ্যালয় ছিল না। রাউজান থানার মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা মন্দির। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিদ্যালয় ছিল এটি। শুধু রাউজান থানা নয়, দেশের সব এলাকা থেকেই ছাত্রীরা যায় সেখানে লেখাপড়া করার জন্য। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ডাকঘর, সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগ, পানির পাম্প, জেনারেটর, বাস ইত্যাদি ছিল। মোট প্রায় ২ লাখ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে সেখানে।”
চার
গত ১ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয়ের মাসের প্রথম দিন শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ১১৪তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমার স্ত্রী বিলকিস এবং আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। কুণ্ডেশ্বরী, তার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ এবং পুরো কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সের বর্তমান প্রধান পুরুষ প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ এবং তাদের ছেলেমেয়ে, বউ-বাচ্চাদের প্রতি আমাদের প্রবল দুর্বলতার একটি কারণ, বিলকিস কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের একজন ছাত্রী ছিল, ১৯৬৯ সালে সে এই বিদ্যামন্দির থেকে এসএসসি এবং তিন বছর পর এইচএসসি পাস করে। একাত্তরে এখানে ওখানে তাদের পালিয়ে থাকতে হয়েছিল বলে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি, বাহাত্তরে দিয়েছে বলে এইচএসসি পাশ করতে তিন বছর লেগেছে।
পশ্চিম বাংলার বর্ধমান থেকে রিফিউজি হিসেবে আসা তার আব্বা মরহুম গণি ইসহাক চট্টগ্রামে বার্মা ইস্টার্ন তেল কোম্পানির চাকরি থেকে অবসর নিয়ে রাউজানে বাসা-বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। বিলকিসের কথা, এই বিদ্যামন্দিরটি না থাকলে তার পক্ষে প্রাইমারির পর আর লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া সম্ভব হত না। বিলকিস এই বিদ্যামন্দিরের একজন প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে প্রফুল্ল সিংহ, তার স্ত্রী কল্যাণী সিংহ, তাদের ছেলে রাজীব সিংহ, ছেলের বউ এবং তাদের শিশুসন্তান তিন বছরের রায়নন্দিনী সিংহের কাছে বিলকিস এখনও দারুণ প্রিয়। এই দিনের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে, কাছেই গহীরায় বাড়ি, মরহুম মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ‘স্বাধীনতা তুমি কার স্বাধীনতা’ কবিতাটি আবৃত্তি করে বিলকিস।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ফজলী হোসেন শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি সংসদের সভাপতি। এই যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ গুণী ব্যক্তির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় আমার বক্তৃতায় শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের নামে ২০১১এর বিজয় দিবসে ডাকটিকেট প্রকাশ করায় এবং তাঁকে ২০১১তে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই।
তাঁর নামে ঢাকা বা চট্টগ্রামের কোনো একটি বড় রাস্তার নামকরণ, তাঁর স্মরণে দেশের বিশিষ্ট জনদের লেখা নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ এবং এখানে একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবও রাখি। আর পি সাহার ভারতেশ্বরী হোমসকেও বোধহয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কুণ্ডেশ্বরীতেও একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে, এই প্রস্তাবে একমত হলেন সেদিন উপস্থিত বিশিষ্টজনরা।
এখানে জরুরি ভিত্তিতে দরকার– চট্টগ্রাম-হাটহাজারী-রাউজান-রাঙ্গামাটি বড় সড়কটি থেকে যে মাইলখানেক সরু রাস্তা আছে কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স পর্যন্ত, তার পাকাকরণ। বিলকিস সেই পঞ্চাশ বছর আগে যে কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাস থেকে নেমে স্কুলে গিয়েছে, সেই রাস্তাটি একই অবস্থায় এখনও আছে।
আজ শনিবার, শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের উপর দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত এক লেখায় বন্ধু সৈয়দ মাহবুব রশীদ লিখেছেন, ইতোমধ্যে গত ৪২ বছরে দেশের ৫৬৬ কিলোমিটার ফিডার/ জেলা সড়ক ২০১৪ সালে এখন দাঁড়িয়েছে ১৩,৬৩৮ কিলোমিটারে। কিন্তু এই এক মাইল রাস্তার কোনো উন্নতি ঘটেনি। অথচ হাজার হাজার ছাত্রী এই বিয়াল্লিশ বছরে শীত-বর্ষায়, কাদামাটি ধূলাবালি পাড়ি দিয়ে স্কুলে গিয়েছে, স্কুল থেকে ফিরেছে। এ গুরুত্বপূর্ণ সরু সড়কটির দ্রুত উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রক্যশল বিভাগের বিদায়ী চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওয়াহেদুর রহমানের জায়গায় সদ্যনিযুক্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার শ্যামাপ্রসাদ অধিকারীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, এখন কলাম লেখক সৈয়দ মাহবুব রশীদ এবং গবেষক, লেখক মানবাধিকার কর্মী সালাম আহমদও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে।
নূতন চন্দ্র সিংহ শহর থেকে দূরে অজপাড়াগাঁয়ে বিদ্যামন্দির গড়ে তুলেছেন শুধুমাত্র এইসব গ্রামের ছাত্রীদের জন্য। ১৯৬০ সালে তিনি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, আর ১৯৭০ সালে বিদ্যামন্দিরকে কলেজে উন্নীত করেন। প্রাইমারি স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত এখন প্রায় হাজার খানেক ছাত্রী। আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৪০০। বাংলাদেশের কয়টি জায়গায় শুধুমাত্র গ্রামগঞ্জে শিক্ষাবিস্তারে এমন বিদ্যানুরাগী মানুষ এখন আছেন বা আগে ছিলেন?
আমাদের দেশের লুণ্ঠনকারীরা, বিবস্ত্র ক্যাপিটালিস্টরা যদি নূতন চন্দ্র সিংহ থেকে এতটুকু শিখতেন, দেশের অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটত। তারপর মালালা ইউসুফজাইয়ের বর্তমান পাকিস্তানের বিপরীতে ষাট বছর আগের কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যামন্দিরকে তুলনা করলে নূতন চন্দ্র সিংহের অবদান আরও উজ্জ্বল হয়। আরও একটি দিক বিদেশে ঘরবাড়ি কেনাতে আসক্ত বাংলাদেশের লুণ্ঠনকারীরা বিবেচনায় নিতে পারে। নূতন চন্দ্র সিংহ সারা জীবন কুণ্ডেশ্বরীতেই কাটিয়েছেন; ঢাকা, চট্টগ্রাম তাঁকে আকর্ষণ করেনি।
১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার একটি অভিজ্ঞতা কোনো দিন ভুলতে পারব না। বিদ্যামন্দির প্রাঙ্গনে সঙ্গীঁতশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে তার দলবল নিয়ে প্রথমে কয়েকটি গান গাইলেন। কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যামন্দিরের কিশোরী ছাত্রীদের তা তেমন পছন্দ হল না। তারা, বলতে গেলে চুপচাপই থাকল। উপস্থিত কয়েক শ’ কিশোরীর দাবিতে দাবিতে কিরণচন্দ্র রায় যখন ‘বাংলাদেশের ঢোল’ এবং ‘সাধের লাউ’ গাইতে থাকলেন, তখন এই মেয়েগুলোর উচ্ছ্বাস-আনন্দ দেখে আমি অভিভূত। এক পর্যায়ে সামনের দর্শক সারির সোফা থেকে আমাকেও টেনে নিয়ে গেল কয়েক জন কিশোরী। জীবনে কোনোদিন নাচিনি। তবে এই দিন তারা আমাকে নাচাল। প্রথমে বিব্রত বোধ করলাম। তারপর ভাবলাম, আমার অংশগ্রহণে তারা যদি একটু বাড়তি আনন্দ পায়, তবে তাই হোক। এই সন্ধ্যায় আমাকে দু’দুবার নাচাল মেয়েগুলো।
মালালাদের তুলনায় আমাদের মেয়েরা অনেক এগিয়ে আছে, দেখলাম শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যামন্দিরে।
Source: বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন