|
মুহাম্মদ রুহুল আমীন
|
|
এভাবে আইএসকে নির্মূল করা যাবে কি?
12 Oct, 2014
২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ও তার পাঁচটি আরব মিত্ররাষ্ট্র সিরিয়ায় যুদ্ধরত আইএস যোদ্ধাদের ওপর বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণ শুরু করে। ওই রাতেই ১২০ জন আইএস যোদ্ধার মৃত্যু হয় এবং অসংখ্য সৈন্য আহত হয়। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে সরকারের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী- এমন নীতিবোধ থেকেই হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের একক নয়, বরং সবার সমন্বিত হামলা হিসেবে অভিহিত করেছেন। একই সময়ে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ার জাতিসংঘের একটি ধারা ব্যবহার করে ওই হামলাকে বৈধ করার যে চিঠি দিয়েছেন, তা মহাসচিব বান কি মুন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিলি করেছেন।
শুধু পাঁচটি আরব মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার হামলাকে বিশ্বশক্তির সম্মিলিত হামলা হিসেবে প্রচারণা চালালেও এ মুহূর্তে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে বড় প্রশ্ন- আইএসবিরোধী যুদ্ধ কি সফল হবে? পাকিস্তান-আফগানিস্তানের গ্রাউন্ড জিরো পয়েন্টের মতো ইরাক ও সিরিয়ায় নতুন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ কি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে? এ ব্যাপারে আশাবাদ ও নৈরাশ্য দুটি ধারাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা নীতির অভাব এবং তাদের একপেশে ও দ্বৈতনীতির কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা যে অর্জিত হবে না, এ ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।
অতীতের পর্যালোচনায় আমরা বৃহৎ শক্তির নিরাপত্তা নীতির ত্র“টিগুলো পরিষ্কার দেখতে পাই। ৯/১১-এর বিয়োগান্তক ঘটনার পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করা হল, ইরাক ও আফগানিস্তানকে বিধ্বস্ত করা হল, আফগানিস্তানের প্রতিবেশী পাকিস্তানকে অস্থিতিশীলতায় ঠেলে দেয়া হল; কিন্তু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কি রক্ষিত হয়েছে? গত কয়েক বছর ধরে নোয়াম চমস্কিসহ নিরাশাবাদীরা যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণার পর পৃথিবী আগের তুলনায় আরও বেশি অনিরাপদ, আরও সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎ শক্তির নীতি দোদুল্যমান; কোথাও তারা অসহায়, কোথাও দিকনির্দেশনাহীন, লক্ষ্যহীন, আবার কোথাও নীতি-বিহ্বলতায় (confused policy) নিমজ্জিত। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ায় যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করতে গিয়ে আইএস এত বেশি পশ্চিমা ও আরব সহযোগিতা পেয়েছে যে, আজ তারা অপ্রতিরোধ্য এক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যে আইএসকে এত বছর ধরে লালন করা হয়েছে, সেই আইএসের বিরুদ্ধে লালনকারী শক্তিকেই আজ যুদ্ধ করতে হচ্ছে, এটাই নির্মম ট্রাজেডি। নীতি-বিহ্বলতার আরেকটি উদাহরণ হল, পশ্চিমারা শিয়া অধ্যুষিত ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হলেও ইরাকের শিয়াদেরই ক্ষমতায় রাখতে হচ্ছে। নীতি-বিভ্রান্তির তৃতীয় উদাহরণ হল, আরব দেশগুলোর সুন্নিদের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও পাশ্চাত্যকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে সুন্নি পরিচালিত আইএস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইএসবিরোধী যুদ্ধের অন্যতম কৌশল হল ইরাকে একটি ঐকমত্যের সরকার (inclusive government) গঠন করা, যেখানে শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের অন্তর্ভুক্তি থাকবে। এ সর্ব-অন্তর্ভুক্তির সরকারের প্রায়োগিকতা ও নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে ব্যাপক কূটনীতির প্রয়োজন ছিল। সর্ব-অন্তর্ভুক্তির ভাবনাটি যৌক্তিক, কিন্তু তা বাস্তবায়নে নেয়া হচ্ছে না সতর্ক কৌশল। শুধু আইএসকে নিশ্চিহ্ন করলেই সর্ব-অন্তর্ভুক্তির পূর্বশর্ত অর্জিত হবে না। বরং আইএস যা চাচ্ছে তার কতটুকু যোগ-বিয়োগ করা যায়, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে নিবিড় সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে। সংলাপের অবধারিত পন্থা পরিহার করে ওবামা সিরিয়া ও ইরাকে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুমান করা যায়, এ হামলায় ইরাক ও সিরিয়া আবার ক্ষতবিক্ষত হবে, লাখ লাখ আবাল বৃদ্ধ বনিতা মৃত্যুবরণ করবে। লাখ লাখ অসহায় নাগরিক পঙ্গু হবে, আহত হবে, মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতরাবে।
আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের রণকৌশলের সংজ্ঞা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। ওবামার ওয়াশিংটন ভাষণ এবং জন কেরির জেদ্দা বৈঠক- সর্বত্র আইএসবিরোধী কর্মকাণ্ডের ধারণা, নামকরণ ও সংজ্ঞায়ন নিয়ে অস্পষ্টতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ১৩ সেপ্টেম্বর সিএনএন অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত US at war with IS শীর্ষক এক লেখায় যুক্তরাষ্ট্রের আইএস নীতির এ দুর্বোধ্যতা তুলে ধরা হয়েছে। জন কেরি আইএসবিরোধী সামরিক অভিযানকে যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করতে অনিচ্ছুক, তবে ওবামা প্রশাসনের অন্য অনেকে একে আইএসবিরোধী যুদ্ধ হিসেবেই বিবেচনা করছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ১০ সেপ্টেম্বরের ভাষণে আইএসকে ধ্বংস করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি তার এ অভিযান সম্পর্কে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসীদের শিকার করে তারা সমুচিত শাস্তি দেবেন। স্পষ্টত ওবামার যুদ্ধবিরোধী সুরে বুশের যুদ্ধংদেহী নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে। সিএনএনকে জন কেরি বলেছেন, আইএসবিরোধী অভিযানের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। এটা এমন একটি সন্ত্রাস দমনকারী অভিযান যা ব্যাপক বিস্তৃত, ব্যাপক অর্থপূর্ণ, বহু বাহু বিশিষ্ট। বস্তুত বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, ওবামার সন্ত্রাসী ধ্বংস করার যুদ্ধ এবং জন কেরির সন্ত্রাস দমনকারী অভিযানের স্বার্থ ও লক্ষ্য অভিন্ন। তাদের কৌশল শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী নিরাপত্তার স্বার্থে প্রণীত, যা স্বল্পস্থায়ী, ভঙ্গুর, ব্যর্থ ও আÍবিধ্বংসী।
আইএসবিরোধী অভিযান পরিচালনায় সমন্বিত ফ্রন্ট গঠনের এ চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র তেমন সফল হবে না, এমন আভাস এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ নিয়ে মিসরে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করলেও মিসরের সেনাবাহিনী আইএসবিরোধী অভিযানে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তবে মিসর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য সহযোগিতা করতে রাজি আছে। কয়েকদিন আগে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও অনৈক্য পরিলক্ষিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের নব-উত্থিত জেহাদি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে সিরিয়া কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ করে আসছে। অথচ আইএসবিরোধী ফ্রন্ট গঠনে সিরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সিরিয়ার মিত্ররাষ্ট্র ইরানও আইএসবিরোধী অভিযানে নানা সহযোগিতা করছে। অথচ ইরানকেও যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত সম্মিলিত ফ্রন্টে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমন একটি পক্ষপাতদুষ্ট সমন্বিত উদ্যোগ, যা আঞ্চলিক অনৈক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা কখনও দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য অর্জন করবে না, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আইএসবিরোধী অভিযান যে কারণে সুদূরপ্রসারী সমাধান আনবে না তা হল, মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্তি পরিকল্পনা। ২০০৬ সালের জুনে Arms Forces Journal-এ প্রকাশিত মানচিত্রে লে. কর্নেল রাল্ফ পিটার্স মধ্যপ্রাচ্যের বিভক্তি পরিকল্পনা পেশ করেন। ইরাকের বিভক্তি প্রক্রিয়া ছাড়াও ইনোন পরিকল্পনায় (Yinon Plan) লেবানন, মিসর ও সিরিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশকে রক্তাক্ত সীমান্ত হিসেবে অভিহিত করে একে মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্নির্মিত মানচিত্রে সংযোজনের জন্য গোপনে অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি কুর্দিস্তান গঠন করে তুরস্ক, ইরান ও সিরিয়াকে পুনর্বিন্যস্ত মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এসব পরিকল্পনায় সৌদি আরব ও জর্ডানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা স্মরণ করতে পারি ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার কথা এবং পরবর্তী সময়ে গোপন চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বিভক্ত করে জোরপূর্বক ইসরাইল রাষ্ট্রের সীমানা তৈরি এবং অদ্যাবধি তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনার কথা। এ ধরনের গোপন অভিপ্রায় নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে যুদ্ধমান কোনো পক্ষকে দমন করা বা প্রতিহত করার পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিকর ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী।
তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের অপ্রতিরোধ্য সামরিক হামলার মুখে অগোছালো আইএস যোদ্ধাদের বেশি দিন টিকে থাকার কথা নয়। আমি নিশ্চিত, এ হামলায় আইএস যোদ্ধারা সাময়িকভাবে পরাস্ত হবে। কিন্তু তাদের কি চিরতরে পরাজিত করা সম্ভব হবে? এ প্রশ্নটি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আইএস যোদ্ধারা একটি গণমূল্যবোধকে জাগরিত করতে সক্ষম হয়েছে। তারা ইসলামের স্বর্ণযুগের খেলাফত ব্যবস্থার সমৃদ্ধ অতীতকে বর্তমান প্রজন্মের স্মৃতিতে পুনর্জাগরিত করেছে। হার্ভার্ড পণ্ডিত হান্টিংটন একে সাংস্কৃতিক পুনঃমূর্তায়ন (cultural reconfiguration) হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, দীর্ঘ সময় চাপা দিয়ে রাখা এ সাংস্কৃতিক চেতনা যখন জাগতে শুরু করে, তখন তা প্রতিহত করা কঠিন হয়। কারণ ওই গণচেতনা দমন করে ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্ককে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। হান্টিংটন এ দেশগুলোকে তাই ছিন্নভিন্ন দেশ (torn country) হিসেবে পরিচিত করিয়ে সেখানে অবশ্যম্ভাবী বিপ্লবের পূর্বাভাস দিয়েছেন। আইএস সেই বিপ্লবকেই পরিচিত করিয়েছে। আজ আইএসকে প্রতিহত করা সম্ভব, কিন্তু আইএসের রাজনৈতিক দর্শন, খেলাফত ব্যবস্থার নস্টালজিয়াকে অত্যাধুনিক পরমাণু বা জীবাণু অস্ত্র দ্বারা দমন করা অসম্ভব।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জন কিরবিসহ যুক্তরাষ্ট্রের স্পর্শকাতর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো এর আগে আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক সমাধানের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও শেষ পর্যন্ত আইএসের বিরুদ্ধে সামরিক সমাধানের দিকেই ধাবিত হল বিশ্বশক্তিগুলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিজমের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী মৌলবাদের উত্থানকে যেভাবে হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল, এখন তার প্রকাশ্য প্রতিফলন ঘটছে। আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তকে সন্ত্রাসীদের গ্রাউন্ড জিরো পয়েন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে গত কয়েক বছর ধরে এ দেশ দুটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সর্বাত্মক আক্রমণ চালাচ্ছে। এরপর ইয়েমেন, সোমালিয়া, সুদান ও ইরাকে আল কায়দাসহ অন্য যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে। এবার সিরিয়ার আইএস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নতুন এক ফ্রন্ট খোলা হল। হয়তো আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের এ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ উপসাগরসহ অন্যত্র সম্প্রসারিত হবে। এমন এক ভয়ংকর ও অযৌক্তিক যুদ্ধে না জড়িয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর উচিত সন্ত্রাস দমনে বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসা। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক কূটনীতি শুরু করা দরকার এখনই।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন