|
আহমদ রফিক
|
|
জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ নেই
24 Sep, 2014
আপিলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা হ্রাস নিয়ে মানুষ অখুশি- এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গিক বিষয় ও মামলার প্রেক্ষাপট নিয়ে উদ্ভূত প্রশ্নাদি। এখনো এগুলোই আলোচনার বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ এমন কথাও বলছেন, আপিল বিভাগ তো যুক্তিহীনভাবে সাজা কমায়নি, সাক্ষ্য-প্রমাণে দুর্বলতা ছিল বলেই এমন দুর্গতি।
আর এ বিষয়টিই সংবাদপত্র মাধ্যমে বড় হয়ে উঠে এসেছে নানা প্রশ্নের ডালপালা বিস্তার করে। প্রথমত, তদন্ত ও প্রসিকিউশনের দুর্বলতা। আর সে জন্যই সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় টেকেনি। মৃত্যুদণ্ড তাঁর প্রাপ্য হলেও এর কার্যকারণ সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। ৪৩ বছর অনেক দীর্ঘ সময়- এ সময়ের মধ্যে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী মারা গেছেন, অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ হারিয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন পর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করলে এ জাতীয় সমস্যা দেখা দেবেই। এর মধ্যেই সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড়ের শ্রমসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। সে কাজ যোগ্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ করতে পেরেছে কি না সেটাই প্রশ্ন- সে প্রশ্নেরও তো সঠিক জবাব পেতে হবে।
এ সম্পর্কে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে (১৯ সেপ্টেম্বর) বলা হয়েছে, 'তদন্ত ও মামলা পরিচালনায় প্রসিকিউশনের দুর্বলতার কথা' এবং তা অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের বরাত দিয়ে। প্রসঙ্গত, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের মন্তব্যেও উদ্ধার করা হয়েছে যে 'প্রসিকিউশনে পরিবর্তন আনা হবে।'
মনে পড়ছে ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময়েও এ জাতীয় দুর্বলতার প্রশ্ন উঠেছিল। এমন কথাও বলা হচ্ছিল, দক্ষ নামিদামি আইনজীবীদের কেন এ কাজে নিয়োগ করা হলো না। এমনই বহু প্রশ্ন এখন উঠছে। প্রসঙ্গত, আরো একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য যে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এবং তাঁদের পরিবার কত দিন পুলিশ পাহারায় জীবন কাটাতে পারেন? একাত্তরের অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসে এখন তাঁরাই আবার যে একাত্তরের বলি হবেন না, তেমন নিশ্চয়তা তো দেখা যাচ্ছে না, অন্তত আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি থেকে এমনই মনে হয়। কারণ দুর্বৃত্তদের হামলায় ইতিমধ্যেই একজন সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারের মৃত্যু ঘটেছে।
জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ নেই
এখন প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক মহলে যাঁরা এই বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী, এমনকি কেউ কেউ শাস্তিদানেরও বিরোধী, তাঁরা কি সাক্ষী নিহত মোস্তফা হাওলাদারের খুনের বিষয়টি হাওয়ায় উড়িয়ে দেবেন, এর শাস্তি চাইবেন না? আন্তর্জাতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি ভেবে আমার অবাকই লাগছে এবং বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে এ ক্ষেত্রে রাজনীতির ভালো-মন্দ কতটা প্রভাব ফেলছে। তারা কি ভুলে গেছেন হিটলারের নির্দেশে ইহুদি হত্যার পরোক্ষ ঘাতক আইসম্যানের কথা, যাকে অপরাধের দীর্ঘকাল পর সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে ধরে আনার পর বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ইসরায়েলি আদালত। তখন তো কোনো প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি আন্তর্জাতিক রাজনীতির উচ্চ মহলে। যত দোষ বাংলাদেশের। এবং এ ক্ষেত্রে ঘাতক অপরাধীকে দেশের আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তখন মানবিকতার প্রশ্ন ওঠে।
সে কথা থাক। প্রসিকিউশনের দুর্বলতার কথা শুধু বর্তমান প্রতিবেদনে যে বিশদভাবে বলা হয়েছে সাঈদীসহ বিভিন্ন আসামির বিরুদ্ধে দাখিল করা অভিযোগপত্রের বরাত দিয়ে তাই নয়, এর আগেও একাধিকবার এ প্রশ্ন উঠে এসেছে, সে ক্ষেত্রে দক্ষ প্রসিকিউশন টিমের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন? আইনমন্ত্রী বলেছেন, 'পরিবর্তন আনা হবে'। আমাদের প্রশ্ন : এত দিন ধরে আলোচিত বিষয় নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? কবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, মামলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে? সন্দেহবাদীদের মনে হতে পারে, রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে আগ্রহ ও আন্তরিকতা দুই-ই হারিয়ে ফেলছে।
এসব সন্দেহ উঠে আসছে এবং জনসাধারণ্যে আলোচিত হচ্ছে মূলত প্রসিকিউশনকে ঘিরে। কারণ তাঁরা যেভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণসহ অভিযোগপত্র দাখিল করবেন তার ভিত্তিতে হবে বিচার এবং শাস্তি বা মুক্তির রায় ঘোষণা। গতকালের একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে আঁতকে উঠেছি, ভাবছি শর্ষের মধ্যে ভূত নেই তো!
খবরটি হলো 'মামলার নথি গায়েব'। 'প্রসিকিউশনের কম্পিউটার থেকে নিজামী, সাঈদী, আশরাফুজ্জামান ও মাইনউদ্দিনের মামলার ফাইল মুছে ফেলা হয়েছে।' এ খবর যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনাল তো মহাবিপদে পড়ে যাবে। দেখা যাবে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণসহ অভিযোগপত্র দিতে না পারার কারণে একাত্তরের ঘাকতরা সব অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মহানন্দে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছে এবং আবার হাতিয়ার নিয়ে তাদের স্বভাবমাফিক কাটাকুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে! সে ক্ষেত্রে প্রথম কোপ পড়বে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের ওপর। পড়তে পারে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের ওপরও।
প্রসঙ্গত, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায়ের অংশবিশেষ ফাঁস হওয়া নিয়ে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হচ্ছে, এত বড় একটি ঘটনার পরও ঘটনা সম্পর্কে বা এর প্রতিরোধ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। নিলে বর্তমান প্রতিবেদনের মতো ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটত না। স্বভাবতই প্রশ্ন : সত্যই কি তাহলে শর্ষের মধ্যে ভূত? এবং সে ভূত মহাশক্তিমান এবং সর্বত্রগামী।
স্বভাবতই সাঈদীর মামলা ও সাজা প্রসঙ্গে এখন যে প্রশ্নটি বাজারে সবচেয়ে মুখরোচক ও সচল, তা মূলত রাজনৈতিক এবং তা রাষ্ট্রপক্ষের সদিচ্ছা নিয়ে। এ প্রশ্ন নিয়ে যে শুধু সংসদ উত্তপ্ত তাই নয়, পত্রিকার কলামগুলোতে ঠাসবুনোনির লেখালেখি চলছে বিশদ বিবরণে, পক্ষে-বিপক্ষে। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক চমকপ্রদ সূত্রের বরাত দিয়ে। সে ক্ষেত্রে লন্ডন, রিয়াদ, ঢাকাকেন্দ্রিক ত্রিভুজে নানা বার্তা চালাচালি বা কলকাঠি নাড়ানাড়ি চলছে বলে কেউ কেউ সন্দেহ করছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থক এক সাবেক উপাচার্য তাঁর দীর্ঘ কলামে সৌদিকেন্দ্রিক বিপদের কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন ওই পক্ষ থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের অভিযোগের কথা।
এ সম্পর্কে একাধিক ঘটনা মানুষ আলামত হিসেবে তুলে নিয়ে যে যার মতো ব্যাখ্যা করে চলেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের আশঙ্কা নিয়ে। বিশেষ করে একাত্তরে রক্তাক্ত, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও সংশ্লিষ্ট মানুষজনেরই সর্বাধিক আশঙ্কা ভবিষ্যৎ মামলার রায়গুলো নিয়ে, বিশেষ করে যখন কম্পিউটার থেকে তথ্যাদি ফাঁস হচ্ছে বা মুছে যাচ্ছে- তারা আরো চিন্তিত তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে।
আঁতাতের প্রশ্নে যুক্তি বলে, আওয়ামী লীগ এখন যেমন শক্তপোক্ত অবস্থানে আছে, তাতে কি তাদের পক্ষে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার কোনো প্রয়োজন আছে? যদি ভবিষ্যৎ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সমঝোতার কথা ভাবা হয়, তাহলে সেটা মস্ত এক ভুল পদক্ষেপ হবে। কারণ জামায়াত কখনোই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সহযোগী হতে পারে না, সমর্থক তো নয়ই। স্বার্থের প্রশ্ন থাকলে তা হবে চালাকি। কারণ বিষয়টি আদর্শগত। এবং সেখানে রয়েছে একাত্তর রক্তচক্ষু মেলে। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই, এ কথা আংশিক সত্য, কিছু না কিছু ক্ষেত্রে শেষ কথা থাকে, যেখানে আপস চলে না। আপস চাইলে বিপদ ঘটে আপসকামীরই। এ সত্য আওয়ামী লীগের তার দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় বুঝতে পারা উচিত। যদি না পারে, তাহলে ক্ষতি শুধু আওয়ামী লীগের একারই নয়? ক্ষতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী সবারই। মনে রাখা দরকার, জামায়াত কখনো বিএনপিকে ছাড়বে না, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপিও জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন হতে দেবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণে এটাই বাস্তব, এটাই সত্য। এ বিষয়ে ভিন্ন স্বপ্ন দেখার কোনো অবকাশ নেই।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন