|
আহমদ রফিক
|
|
মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি এখন নয়া সংকটে
17 Sep, 2014
মধ্যপ্রাচ্যে আবার নতুন করে অশান্তির হাওয়া দিতে শুরু করেছে। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার পর যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল এই ভেবে যে ইসলামী মৌলবাদী শক্তির বড়সড় একটা শিকড় কেটে ফেলা গেছে। ওদের বড় কয়েকজন নেতার মৃত্যু ঘটেছে তাদের ড্রোন বিমান হামলায়। একা জাওয়াহিরি কি-ই বা করতে পারবে।
মার্কিনি নীতিনির্ধারক শাসকরা হয়তো স্বীকার করবেন না যে আফগানিস্তান থেকে রুশ সৈন্য সরাতে গিয়ে তাঁরা ইসলামী মৌলবাদী যে শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন, তাঁরাই একসময় যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে। তালেবানদের যদিও বা কিছুটা সংযত করা গেল, তো অন্য প্রান্তে ওই মতাদর্শিক রক্তবীজের জন্ম হচ্ছে অধিকতর নিষ্ঠুর চরিত্র নিয়ে।
সেটারও নেপথ্য কারণ ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনকে শেষ করে ইরাকের তেল ভাণ্ডার দখল করার উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা যুক্তিতে বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক আক্রমণ। ইরাককে ছিন্নভিন্ন করে অন্তর্দ্বন্দ্বে অশান্ত ইরাকে পুতুল সরকার বসিয়ে ওয়াশিংটন ভেবেছিল সব সামলে দেওয়া গেছে।
কিন্তু তাদের বিধিবাম। নতুন উৎপাত-উপদ্রব দেখা গেল বাশারের একনায়কী শাসনের বিরুদ্ধে সিরিয়ান বিদ্রোহ উপলক্ষে ইসলামী মৌলবাদীদের আত্মপ্রকাশে। যুক্তরাষ্ট্রের বহির্দেশীয় নীতি প্রায়ই স্ববিরোধী ও আত্মঘাতী, যা তাদের বিদেশনীতির বিচক্ষণতা প্রকাশ করে না; বরং পাল্টা সমস্যা তৈরি করে।
বাশার শাসিত সিরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়, কাজেই সুযোগ-সুবিধামতো তাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে, এই নীতি কি তাদের কথিত গণতন্ত্রের পক্ষে যায়? যায় না বলেই যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত। তাতে ক্ষতি নেই, তারা আগ্রাসী যুদ্ধ চালিয়ে যাবেই। তাতে অর্থনীতি চাপ পড়ে পড়ুক, নতুন অর্থের উৎস ভাণ্ডার তো হাতে আসবে আর শত্রুও নির্মূল হবে। অস্ত্র বিক্রি বাড়বে। অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাদ সমৃদ্ধ হবে।
এমনই তাদের বরাবরের হিসাব-নিকাশ। এবং সে অনুযায়ী গাদ্দাফিবিরোধী বিদ্রোহী শক্তিকে অস্ত্রে-অর্থে সাহায্য করে লিবিয়াকে গাদ্দাফিমুক্ত করা গেল। শত্রুর শেষ। কিন্তু লিবিয়ার ইদানীংকার অন্তর্দ্বন্দ্বের হালচাল দেখে তো মনে হয়, সেখান থেকেও ভবিষ্যতে ওয়াশিংটনের মাথাব্যথার মতো শক্তির উত্থান ঘটতে পারে, তবে সময় লাগবে এই যা।
লিবীয় সাফল্যে উদ্দীপ্ত ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সর্বশেষ শত্রু সিরিয়ার বাশারকে শায়েস্তা করতে একই ধারায় বাশারবিরোধী সিরীয় বিদ্রোহীদের মহানন্দে মদদ জুগিয়েছে ভাবনাচিন্তা না করে যে এই বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক চরিত্র কী ধরনের। এখানে যেমন সিরীয় ন্যাশনাল ফ্রন্ট আছে, তেমনি আছে আল-কায়েদার মতো ইসলামী মৌলবাদীগোষ্ঠী।
আরো চমৎকার যে এই আল-কায়েদাগোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে এসেছে উগ্রপন্থীগোষ্ঠী, যারা খলিফাভিত্তিক চরমপন্থী ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে চায়, যা খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে মেলে না। এদের রক্ষণশীলতা, এদের গোঁড়ামি, এদের চরমপন্থী নীতি বর্তমানে আধুনিকতার চরম বিপরীত ধরনের। তা সত্ত্বেও অন্ধ স্বার্থের বশবর্তী হয়ে ওয়াশিংটন বাশারবিরোধী অভিযানে অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়ে গেছে।
কিন্তু গাদ্দাফির মতো বাশারকে ফেলে দেওয়া যায়নি। কারণ একটাই, রাশিয়া ও চীনের বাশারের প্রতি সমর্থন, বিশেষভাবে আসাদের পুরনো বন্ধু রাশিয়ার সশস্ত্র সমর্থনের জোরে টলমল করতে করতেও আপাতত টিকে আছে বাশারের সিরিয়া, একান্তভাবে বন্ধুশক্তির জোরে। সর্বশেষ পরিস্থিতি একই কথা বলে। তা ছাড়া রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে এখন সিরিয়ার একমাত্র বন্ধুরাষ্ট্র ইরান। এদের বন্ধুত্ব সম্পর্কও পুরনো। ইরান চায় না বর্তমান সিরিয়ার পতন।
মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি এখন নয়া সংকটে
(দুই)
কিন্তু ইতিমধ্যে পাশার দান উল্টে গেছে। গেছে যতটা সিরীয় বিদ্রোহে, তার চেয়েও বেশি ইরাকে একই উগ্রপন্থীগোষ্ঠীর সফল অভিযানে। একের পর এক শহর দখলের মধ্য দিয়ে ইরাকে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত। রাজনৈতিক পরিচয়ে উগ্র সুনি্নগোষ্ঠী, চরমপন্থী শরিয়া শাসন প্রবর্তনে মরিয়া। এদের নাম 'ইসলামী স্টেট' বা সংক্ষেপে 'আইএস' গোষ্ঠী। দুর্বল ইরাকি শাসন তাদের ঠেকাতে না পেরে মার্কিন সেনাদের আবার ইরাকে এনেছে, চলেছে মার্কিনি বিমান হামলা। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ইরাকিদের মার্কিন ঘৃণা আরো জোরদার হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে ওয়াশিংটনবিরোধী শক্তি সংহত হতে সাহায্য করবে।
যে সাদ্দামকে হত্যা করে নিশ্চিন্ত হয়েছিল ওয়াশিংটন, এখন শোনা যাচ্ছে সেই মৃত সাদ্দামের সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত সেনাদের অনেকে সম্ভবত ক্ষুব্ধচিত্তেই এই নয়া অভিযানকারীদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যদিও তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য সাদ্দামের ঠিক বিপরীত। সাদ্দামের সেক্যুলার ইরাক ভেঙেচুরে তার ভুলের মাসুল গুনছে। কিন্তু মার্কিনি অভিযানের ভুল-ভ্রান্তিরও মাসুল নয় কি এই নয়া চরমপন্থী মৌলবাদীগোষ্ঠী, যারাও মার্কিনবিরোধী।
অতএব, পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে মহাসংকটময়। এখন ইরাকে তাঁবেদার সরকারকে রক্ষা করতে ওয়াশিংটনের মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় অচিরে বহু বিলিয়নে পেঁৗছে যাবে। আবারও অর্থনীতিতে চাপ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এসব খুঁটিনাটি ভেবে দেখেছেন তো? নাকি বুশের মতো অন্ধ আবেগে অভিযান চালাতে অটল। কিন্তু উপায় নেই। যতটা কট্টর মৌলবাদী আগ্রাসন ঠেকানো ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য, তার চেয়ে বড় লক্ষ্য অধিকৃত তেলভাণ্ডার রক্ষা। সে কাজটাই এখন চলছে ইরাকে। কিন্তু কী করছিল সিআইএ কট্টর এই জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঠেকাতে। সিআইয়ের তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ।
এই জঙ্গিবাদীগোষ্ঠী যেহেতু ওয়াশিংটনের শত্রু, সেহেতু তাদের পরাজিত করা ওবামার নৈতিক দায়িত্ব। তাই সীমিত আকারে হলেও সেনা সমর্থন সেখানে জোগাতেই হবে। কিন্তু সমস্যা একই, মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর দ্বিতীয় ফ্রন্ট সিরিয়ায় বাশারের উৎখাতে মরিয়া- ইতিমধ্যে কিছু অঞ্চল তাদের দখলে চলে গেছে। তাই বারাক ওবামার ঘোষণা- সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলা চালাতে হবে।
কিন্তু এ সিদ্ধান্তে বাদ সেধেছে রাশিয়া। পুতিনের প্রকাশ্য ঘোষণা- সিরিয়ায় মার্কিন হামলা সহ্য করা হবে না। আপাতদৃষ্টিতে পুতিনের এ ঘোষণা স্ববিরোধী মনে হতে পারে। কারণ, এর অর্থ কি পুতিনের সুনি্ন জঙ্গিবাদ সমর্থন? বিষয়টি মোটেই তা নয়। মস্কোর ভালোভাবেই জানা আছে যে আইএস দমনের সুযোগে ওয়াশিংটন বাশারবিরোধী বিদ্রোহীদের দামেস্কে ক্ষমতায় বসানোর ইচ্ছা রাখে। মস্কো সেটা হতে দিতে পারে না। লক্ষণীয়, চীনের আপাত নীরবতা।
মস্কো বুঝেশুনেই সিরিয়ায় মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। কারণ এটাও ঠিক যে আসাদবিরোধী এক পক্ষ দুর্বল হলে আসাদবিরোধী অন্য পক্ষ শক্তিমান হবে, মার্কিন সাহায্য নিয়ে তারা তাদের বাশারবিরোধী অভিযান ত্বরান্বিত করবে। এ ত্রিপক্ষীয় জটিলতা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি ও ব্যক্তির জন্য বাস্তবিক এক বিদঘুটে সংকট তৈরি করেছে- না এগোনো যাচ্ছে, না পেছানো যাচ্ছে।
এ সমস্যা সিরিয়ার বন্ধু তেহরানের জন্যও। শুরুতে প্রবল সুনি্নবাদী অভিযানের মুখে ইরান বিস্ময়করভাবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিল। তারাও এখন চুপচাপ, অনেকটা চীনের মতোই। কোন পথ গ্রহণ করবে তা ঠিক করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেমন সিরিয়া, তেমনি ইরাক সম্পর্কেও। সত্যি ওয়াশিংটনের দ্বিমুখীনীতি যে সংকটের জন্ম দিয়েছে তা বিশ্বগণতন্ত্রী বা বিশ্বশান্তিবাদীদের মহাসমস্যায় ফেলে দিয়েছে। তাদের 'ন যজৌ, নস্থৌ' অবস্থা।
একই অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের নিরপেক্ষ শক্তিগুলোর বা আদর্শবাদী মানুষগুলোর। কোনো পক্ষকে সমর্থনের উপায় নেই। তাই বলে কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে সবাই? তা-ই কি সম্ভব! এ অবস্থার আরো একটি বিপজ্জনক মাত্রা হলো আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘোষণা যে তারা মুসলিম বিশ্বে শরিয়াভিত্তিক কট্টর ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। বলা বাহুল্য যে রাষ্ট্রে প্রথম কোপটা পড়বে মার্কসবাদীদের মাথায়, এরপর পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্রী ও আধুনিকতাবাদীদের ওপর, সেই সঙ্গে নারী স্বাধিকারের ওপর।
সে জন্যই স্বাধীন কুর্দিস্তানের প্রবক্তারা, এমনকি কুর্দি নারী যোদ্ধারাও এই কট্টর মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রস্তুত? কুর্দিদের সমস্যাও বহুমুখী। তাদের রাজনৈতিক সংকটও কমন নয়, বিশেষ করে মার্কিন তাঁবেদার তুরস্ককে নিয়ে। অথচ তারা সবাই আবার আইএস জঙ্গিবাদবিরোধী। সে জন্যই বলছিলাম, এই নয়া জঙ্গিবাদী উপদ্রব মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে বহুমুখী সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কে যে কোন দিকে, কার পক্ষে দাঁড়াবে, তা নির্ধারণ করা বড় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরো একটি সমস্যা তৃতীয় বিশ্বের, বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশের প্রতি জাওয়াহিরির ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে। এই দুই দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী বা তরুণের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে নবজঙ্গিবাদের সমর্থক হয়ে ওঠা শঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। শঙ্কা বিশেষত সেক্যুলার সমাজব্যবস্থা নিয়ে, যা ইতিমধ্যে আঘাতের সম্মুখীন।
পরিস্থিতি কি তাহলে বাংলাদেশে শরিয়ারাষ্ট্রবাদীদের পক্ষে মোড় নিতে শুরু করবে জিহাদিদের টানে, দেশে সেক্যুলার, দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের অভাবে? তরুণ সমাজের বিতৃষ্ণা-বিরূপতা যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে তা গণতন্ত্রীদের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশি শাসকদের সতর্ক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ যেমন স্বল্পমেয়াদি, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি- অতীব জরুরি হয়ে উঠেছে। সাধু সাবধান!
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন