১২ জুনের প্রথম আলোর নবম পৃষ্ঠায় একটা খবরের শিরোনাম ছিল, ‘শতভাগ জাম ও ৯৫ ভাগ লিচুতে ফরমালিন’।
কৃষ্ণকলির সাঁওতাল ও ঝুমুর গান-এর যে সিডিটা এখন চেম্বারের গানের কলে বাজছে, সেই সিডির শেষ গানের প্রথম কলি এ রকম, ‘সানতাল করেছে ভগবান, মানুষ করেনি ভগবান’।
মানুষ কি প্রায় প্রতিটি খাবারে জেনেশুনে বিষ দিতে পারে? আমাদের সানতাল করেনি, সৃষ্টিকর্তা মানুষই করেছে। কিন্তু আজকাল আমরা এক আজব প্রজাতির মানুষ হয়ে পড়ছি। এই ফলের মৌসুমে সেই ছোট বাচ্চারা জাম অতটা না খেলেও মিষ্টি লিচু খাবে, মা-বাবা তাদের আদর করে আম খাওয়াবে। একটু বেশি টাকার জন্য ব্যবসায়ীদের বদৌলতে এই শিশুরা এখন বিষ খাচ্ছে, ফলের সঙ্গে।
বলা বাহুল্য, শুধু ফল ব্যবসায়ীদের কথা হচ্ছে না। মাছে বিষ এসেছে অনেক আগে। দিন কতেক আগে টেলিভিশনের খবরের বিশেষ রিপোর্টে দেখলাম, ফার্মের গরু যে ঘাস খাচ্ছে, তাতেও গুরুতর বিষ, যে বিষ রয়ে যাচ্ছে গরুর দুধে আর সেই দুধ থেকে বাচ্চাদের শরীরে। সেই গুরুতর বিষ থেকে দুরারোগ্য ভীষণ ভীষণ ব্যাধি হতে পারে। ফার্মের মুরিগকে যে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, সেটা নাকি আমরাও খাচ্ছি মুরিগর মাংসের সঙ্গে। ফিরিস্তিটা অনেক পৃষ্ঠা চালাতে পারবেন পাঠককুল, অধমের চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শিতায়।
এমনটা কেন হলো, কীভাবে হলো?
২
সম্প্রতি অতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবলা দুর্বল, সহায়-সমর্থহীন, চতুর্দিক থেকে অকাতরে ও নির্বিচারে এবং তদুপরি সম্পূর্ণ বিনা কারণে আক্রান্ত ‘ওসমান পরিবার’কে রক্ষা করার অত্যন্ত প্রশংসনীয় গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন, আবেগঘন কণ্ঠে জাতীয় সংসদে সবাইকে জানান দিয়ে।
এখন বেচারা নিজাম হাজারীর দায়িত্বও নিশ্চয় অতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে। বিশেষত নচ্ছার প্রথম আলোর মতো বদজন যখন িনজাম হাজারীর পেছনে লেগেছে, তাঁর জেল না-খাটার খবর ফাঁস করে দিয়ে।
অবশ্য নিজাম হাজারীকে ‘ক্রেডিট’ না দিয়ে উপায় নেই। খুনখারািব, ডাকাতি আর অস্ত্র মামলায় জেলখাটা অনেক রাজনীতিবিদের জন্য কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু সাজার পুরো মেয়াদ না খেটে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো কৃতিত্ব কয়জনই-বা দেখাতে পেরেছেন। পাবলিক সেয়ানা। ভাববেন না সবে জাতে উঠেছে, অর্থাৎ অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক ভালো কাজে হাতেখড়ি হয়েছে সবেমাত্র। ভদ্রলোকের অস্ত্র মামলা বছর বিশেকের পুরোনো। অস্ত্র মামলায় সাজা হয়েছে এক যুগের বেশি আগে। পুরো সাজা না খেটে আগেভাগেই বেরিয়ে গেছেন জেল থেকে।
অবশ্য এসব কিছু প্রথম আলোর কেচ্ছা বা সংবাদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে দেশবাসীকে সাংসদ হিসেবে উপহার দিয়েছেন। তাই নিজাম হাজারীকে রক্ষার দায়িত্বও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হতে পারে৷ বিশেষত নিজাম হাজারী এমপি যদি মহান সংসদে দাঁড়িয়ে আরেক মাননীয় এমপির মতো নিহত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে আগাম মাফ চেয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
রাজনীতিতে এখন গডফাদারের ছড়াছড়ি৷ মনে হয় আমরা জাতে উঠছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে গডফাদার তথা মাফিয়াদের প্রচণ্ড দাপট ছিল ১৯২০-১৯৩০-১৯৪০-এর দিকে। আমাদের ফেনসিডিল ‘ব্যবসা’ নিয়ন্ত্রণ করে যেমন বিভিন্ন অপরাধচক্র, ঠিক তেমনি চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ এক দল অপর দলকে টেক্কা দেয়—দরকার হলে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে ইত্যাদি ইত্যাদি করতে করতে যে অপরাধী দলগুলো দাঁড়িয়ে গেল, তারাই বিখ্যাত হয়ে গেল বিভিন্ন মাফিয়া গ্রুপ নামে।
ফেনসিডিল থেকে চাঁদাবািজ, তারপর সন্ত্রাসী ব্যস্ততা। আস্তে আস্তে জমি দখল, মার্কেট দখল। মাঠ দখল (এখন যেমন আস্ত ধানমন্ডি মাঠটাই খেয়ে ফেলছে) ইত্যাদি করতে করতে অবশেষে রাজনীতিতে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী বাদ দিয়ে তাঁরাই আস্তে আস্তে হয়ে পড়লেন গডফাদার-রাজনীতিবিদ।
আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলের শেষের দিকে ফেনী, বরিশাল ও ঢাকায় দুিট আসনসহ কিছু কিছু জায়গায় বড় বড় গডফাদারের একচ্ছত্র আধিপত্য ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির সবচেয়ে প্রধান না হলেও অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। তখনকার সরকারের শেষ আমলে জননিরাপত্তা আইন পাস করে সেই আইন দিয়ে বিরোধীদের ঠ্যাঙানো, গণভবন নিজেদের নামে লিখিয়ে নেওয়া—এসব ছিল অন্যান্য কারণ।
৩
গত বিএনপি সরকারের সময়ে প্রথমে অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে এবং তিন মাস পরে আইন করে মানুষ হত্যা বৈধ করা হয়েছিল। তারপর ২০০৪ থেকে র৵াবের ক্রসফায়ারে মানুষ মারা। এই মানুষ মারা শুরু হয়েছিল ২০০৪-এর জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে। তারপর ২১ আগস্টের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের হত্যাযজ্ঞ।
পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছি এ লেখার আসল শিরোনামের যৌক্তিকতাটা দাঁড় করানোর জন্য, আসল শিরোনামটা—রাজনীতিতে গডফাদার আর ফলে ফরমালিন। অর্থাৎ রাজনীতিতে যত দিন গডফাদার থাকবে, ফলে-মাছে-অন্যান্য খাদ্যে তত দিন বিষ থাকবে।
গডফাদার থাকা মানে আইনের শাসন না থাকা। কর্তাব্যক্তিরা যদি আইন না মানেন, তাহলে বেচারা ক্ষুদ্র ফলবিক্রেতা আইন মানবে কোন দুঃখে। বা আইন মানার অনুপ্রেরণা কোথায় পাবে? সে তো দেখছে আশপাশের আতিনেতা-পাতিনেতা থেকে শুরু করে বড় নেতা, জাতীয় নেতা কেউই আইন মানছে না। ২০ একর জমি নিয়ে মিন্ত্রত্ব শুরু করে পাঁচ বছরে জমির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার একর। আরও দেখল—ভীষণ বড়লোক হয়ে গেলে বড়জোর দুদক দু-এক দিন দাওয়াত দিয়ে মিডিয়াকে দেখানোর জন্য ‘ইন্টারভিউ’ নেবে, ওই পর্যন্তই।
আর ভীষণ গডফাদার হলে পাশে তো আছেন খোদ অতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বিরোধী দলে থাকলে গডফাদার স্বভাবতই কম থাকে। বিরোধী দলে থেকে তো নিজের জান-মাল বাঁচানোই মুশকিল, গডফাদারদের প্রটেকশন দেবেন কীভাবে। বিরোধীদের তাই আপাতত কিছুটা ধোয়া তুলসীপাতা-পাতাভাব।
জনসমর্থন কমতে থাকলে দুটো জিনিস বাড়তে থাকবে। প্রথম—নির্বাচন দেব না। এ কথা বলার স্বর ও মাত্রা তীব্রতর হতে থাকবে প্রতিনিয়ত। যারা নির্বাচন চাইবে, তাদের বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশের ভাবমূর্তি হননকারী ইত্যাদি বিশেষণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে এসব বিশেষণপ্রসূত আইিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত, গডফাদার-র৵াব-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকবে।
ফলে আইনের শাসন দুর্বল থেকে হবে দুর্বলতর। বাড়বে ফরমালিন, বিষ। ওষুধে ভেজাল, এখন কেবল ইন্টার্নি কিন্তু অচিরে খোদ ডাক্তারদের মারামারি, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অহরহ হানাহানি, একটা সড়ক দুর্ঘটনার পর অনেক অনেক গাড়ি ভাঙচুর, আশপাশের যানবাহনের নিরীহ যাত্রী-বাচ্চাদের রক্তাক্ত হওয়া, সাংবাদিকদের ব্ল্যাকমেল আর আইনজীবীদের জোচ্চুরি সবকিছু মিলিয়ে ভালো ঠেকছে না। ঢাকার আটটি প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসিয়ে এক সপ্তাহের জন্য ফলে ফরমালিন কমানো সম্ভব কিন্তু রাজনীতি থেকে পুরো সমাজে যে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে, তার বিরুদ্ধে চেকপোস্ট কোথায়?
এই চেকপোস্ট বসাতে হবে এখন আমাকে-আপনাকে। দলগুলো থেকে যদি গডফাদাররা বিতাড়িত না হয়, তাহলে দলগুলোকে বিতাড়িত করতে হবে।
গত শতাব্দীর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চার্লস ফেগল আর আয়াতুল্লাহ খোমেনি নিজ নিজ দেশের বাইরে অর্থাৎ অন্য দেশে থাকা অবস্থায় হয়ে উঠেছিলেন বিরাট নেতা। তাঁরা দেশত্যাগী হয়েছিলেন নীতির কারণে, রাজনীতির কারণে। আইনকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য নয়।
বিষদাঁত উপড়ে না ফেললে বিষ দিয়ে যাবে সারা শরীরে। বলা বাহুল্য, সবই করতে হবে আইনের মধ্যে থেকে আইনি পন্থায়। সবাইকে নামতে হবে রাজনীতিতে, যে যেভাবে পারেন।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন