এখন অধমের ধারণা, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধই হবে।
আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে বেশ কিছু ব্যাপার এখন প্রায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। সম্পূর্ণ চূড়ান্ত হবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে কথাবার্তার পর। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি দু-চারটা আসনের ভাগ পেলেও পেতে পারে। খুচরা কিছু বামপন্থী দলের দু-চারজন নেতার কপালে এবারও সাংসদের খেতাব জুটবে।
জুটবে এ কারণেই যে তাঁদের সঙ্গে নির্বাচনী যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তো কাউকে পাওয়া দুষ্কর হবে। এরশাদের জাপা, মঞ্জুর জাপা, নাজিউর রহমানের জাপা অর্থাৎ সব ধরনের জাতীয় পার্টি, সঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), সাম্যবাদী দল ইত্যাদি ইত্যাদি সবই মনে হচ্ছে সরকারি দল। সবাই থাকবে মাঠের এক প্রান্তে; মাঠের অন্য প্রান্তে কে থাকবে তা তো মোটেও বোঝা যাচ্ছে না।
অবাধ অর্থ বাধা ছাড়া, কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়া। মাঠের অন্য প্রান্তে কোনো দল থাকলে—খেলাটা যদি ফুটবলের মতো হয়, সেই দল তাদের নিজের প্রান্ত আগলে রাখবে, অপর পক্ষকে গোল করতে দেবে না, চাই কী বল নিয়ে অন্য পক্ষের গোলপোস্টে হানা দেবে। গোল করতে চেষ্টা করবে।
কিন্তু মাঠের অন্য প্রান্তে, অর্থাৎ যে প্রান্তে আওয়ামী লীগ, জাপা—নিজেদের বাম দলগুলো অবস্থান নিয়েছে, তার বিপরীতে তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ অবাধে বল নিয়ে অপর প্রান্তের গোলে যতবার খুশি প্রবেশ করানো যাবে। খেলাটা হবে অবাধ—কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়া।
অপর পক্ষের যে দু-একজন খেলোয়াড় একটু-আধটু উঁকি-ঝুঁকি মারছিলেন, তাঁদেরও এখন সম্পূর্ণ মাঠছাড়া করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। যেখানে, যেভাবেই, যেকোনো অঘটন ঘটবে—আগুন, আগুনে মানুষের নির্মম মৃত্যু, গাড়ি ভাঙচুর, ট্রেন লাইন ধ্বংস, ট্রেনে আগুন—সব মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম ও প্রধান আসামি। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন যে বিএনপির নেতাদের গাড়ির নম্বর জোগাড় করে ওসব গাড়িতে আগুন লাগালে বিএনপির নেতারা টের পেতেন। যাকে বলে, কত ধানে কত চাল।
মোদ্দা কথা, মামলা ইতিমধ্যে প্রায় সব প্রধান নেতার বিরুদ্ধে হয়ে গেছে। যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিএনপির প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আশা করা যায়, সব নেতাই দু-চার দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হবেন।
অর্থাৎ নির্বাচনটা সম্পূর্ণ অবাধ হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দল প্রার্থী থাকা মানে একধরনের বাধা। এবার নির্বাচন হবে সব ধরনের বাধা ছাড়া—সত্যিকার অর্থে ‘অবাধ’ নির্বাচন।
২.
অবাধ নির্বাচনে জেতার মজাই আলাদা। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি এই মজা পেয়েছে। একই মজা পেয়েছে বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। দেশের পুরোনো ও ভীষণভাবে ঐতিহ্যবাহী দল হয়ে বহু নির্বাচনে অংশ নিয়েও কোনো বারই ‘অবাধ’ নির্বাচনের মজা আওয়ামী লীগ পায়নি। তাই এবার সেটা নিশ্চিত করাই মুখ্য লক্ষ্য হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এবার নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। ধরে নিচ্ছি জাপার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ভাই নাসিম ওসমানও নারায়ণগঞ্জের আরেক এমপি হবেন। ওসমান ভাইদের সুখে অধমও সুখী। তবে শামীম ওসমান সাহেবের মতো ঐতিহ্যবাহী অন্য নেতারা যেমন হাজী সেলিম, আলহাজ মকবুল, ডা. ইকবাল, ফেনীর জয়নাল হাজারী গং মনোনয়ন পাননি দেখে অধম যারপরনাই ব্যথিত। এ রকম দক্ষ-অভিজ্ঞ-পারদর্শী নেতাদের বাদ দেওয়া মোটেও ঠিক হচ্ছে না।
একই কথা প্রযোজ্য সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্যও। এত বড় দেশপ্রেমিক—খোদ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দেশপ্রেমের সনদ, আর তিনিও মনোনয়ন পেলেন না। পদ্মা সেতু, বিশ্বব্যাংক—সব জাহান্নামে যাক। চাই সৈয়দ আবুল হোসেনকে সাংসদ হিসেবে দেখতে। যাঁর জন্য পদ্মা সেতু বিসর্জন দেওয়া হলো, তাঁকে পর্যন্ত মনোনয়ন দেওয়া হলো না। এভাবে দল টিকবে?
৩.
আশা করছি আজকালের মধ্যে বিএনপির সব বড় নেতাকে ধরা হবে। এখন পর্যন্ত মোটে আধা ডজন ধরা হয়েছে। যখন এই লেখাটা লিখছি, তখন আড়চোখে টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, রুহুল কবির রিজভীকে ডিবি অফিস থেকে আদালতে নেওয়া হচ্ছে। কোনো নেতার ব্যাপারে আদালত পুলিশের রিমান্ডের নির্দেশ—থুক্কুমুক্কু, রিমান্ডের আবেদন—অমান্য করেনি, তাই যতক্ষণে পাঠক এ লেখা পড়বেন, ততক্ষণে রুহুল কবির রিজভী রিমান্ডে থাকবেন অথবা রিমান্ড বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য কোনো তারিখ পড়বে।
টেলিভিশনে আরও দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তৃতায় বলছেন, বিএনপির আমলে তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি মামলা দেওয়া হয়েছিল। আরও অভিযোগ করছিলেন, এত কিছুর পরও বিএনপির নেত্রী ১৫ আগস্ট ‘কেক কাটেন’।
তিনটি আইনি বিষয় দিয়ে ছোট লেখাটা শেষ করব। প্রথমত, অন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে আগামী নির্বাচনটা সম্পূর্ণ ‘অবাধ’ করার জন্য খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে হুকুমের আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হোক। মির্জা ফখরুলসহ অন্য সবাই যখন ইন্ধনদাতা ইত্যাদি হিসেবে আসামি হয়েছেন, তখন নেত্রী বলে তো খালেদা জিয়া আর বাদ যেতে পারেন না। হাজার হলেও তো আইনের চোখে সবাই সমান। এই আওয়ামী লীগ আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিশ্চয় এক ডজন মামলা হয়নি, যেমনটি হয়েছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, বিএনপির আমলে। এখানেও একটা সমতার ব্যাপার আছে।
দ্বিতীয়ত, বারবার ১৫ আগস্টে কেক কাটার ব্যাপারটা আর উপেক্ষা করা সমীচীন হবে না। বর্তমান নবম সংসদের শেষ অধিবেশন করে ‘১৫ আগস্ট কেক কাটা নিষিদ্ধকরণ আইন’ পাস করতে হবে। আমেরিকার সংসদ (কংগ্রেস) ব্যক্তিবিশেষের নামে বহু আইন পাস করেছে। দরকার হলে খুঁজে দিতে পারব। অর্থাৎ, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সংসদের অনুকরণে আমাদের সংসদও ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিনে কেক কাটা নিষিদ্ধকরণ আইন পাস করতে পারে।
তৃতীয় ও শেষ আইনি কথা, এটা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য বা এমনকি ভারত থেকেও ধার করা নয়। এটা ছিল আমাদেরই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ কর্তৃক পাস হওয়া চতুর্থ সংশোধনীতে। সংবিধান চতুর্থ সংশোধনী আইনের ৩৩ নম্বর ধারাটা এরূপ: ‘প্রথম সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি—সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে দায়িত্ব পালনরত সংসদ, রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া দিয়া না থাকিলে, এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’
অর্থাৎ, সংসদের শেষ অধিবেশনে চতুর্থ সংশোধনীর উপরিউক্ত ধারার মতো একটি ছোট্ট সংশোধনী পাস করলে ‘অবাধ’ নির্বাচনের ঝামেলাও পোহাতে হবে না। শুধু ‘প্রথম’ সংসদের জায়গায় লিখতে হবে ‘নবম’।
আগামী চার-পাঁচ সপ্তাহে বহু নিরপরাধ লোক মারা যাবে—অগ্নিদগ্ধ হয়ে, গোলাগুলিতে, ট্রেন-বাসের দুর্ঘটনায়। যানবাহন ভাঙচুর হবে, অগ্নিসংযোগ হবে, পুড়বে বহু সম্পত্তি। আয়-রোজগার বন্ধ হবে লাখ লাখ লোকের—হবে অনাহার, বাড়বে হাহাকার। থাকবে পুলিশি নির্যাতন, গ্রেপ্তার, মামলা, রিমান্ড।
রেষারেষি, জেদাজেদি। দেশটা তিল তিল করে গড়ে উঠছিল। দুই পক্ষের কোনো পক্ষেরই এটা সহ্য হচ্ছে না। নির্বাচন ‘অবাধ’ হতে পারে। না-ও হতে পারে। কিন্তু দেশটাকে আমাদের ফেরত পেতেই হবে।
শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট এবং অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
(প্রথম আলো, ০১/১২/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন