অলিউল্লাহ নোমান
দীর্ঘ ১৭ বছরের টানা লড়াইয়ের পর ৫ আগষ্ট পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন ভারতের এজেন্ট ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা। এই লড়াই শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের ফ্রেব্রুয়ারীতে পিলখানায় সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। ধারাবাহিক লড়াইয়ে নানা চড়াই উৎরাই পার করেছে বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদের কালো থাবায় গুম হয়েছেন অনেক মানুষ। বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন অনেকে। সবশেষে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই-আগষ্টের লড়াইয়ে যোগ দেয় দেশের সব শ্রেনী পেশার মানুষ। সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী শুধু জুলাইয়ের আন্দোলনে ১৪শ’র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন । আহতের সংখ্যা ২২ হাজারের বেশি। ৪ শ’র বেশি মানুষ চোখ হারিয়ে জীবনের জন্য অন্ধ হয়ে গেছেন। নীপিড়নের মুখোমুখি হয়ে যারা এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন, তাদের খবর ক’জনই বা রাখেন জানি না। নিহতদের পরিবার গুলোর অবস্থা কে সেটা নিয়েও কারো মধ্যে তেমন কথাবার্তা শুনিনি।
একযুগ পর বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল মূলত তাদেরই আত্মত্যাগের বিনিময়ে। ২৫ দিনের বাংলাদেশ ভ্রমনের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, ফ্যাসিবাদের শীর্ষ নেতৃত্ব পালিয়ে গেলেও প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে রয়ে গেছে এখনো তাঁরই এজেন্টরা। এই অবস্থায় বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা কতটা সম্ভব হবে সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
প্রশ্ন করতে পারেন কেন আমার এমন ধারণা হচ্ছে?
আমার এমন ধারণা হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
১. সাংবাদিকতা পেশায় একটি লম্বা সময় কেটেছে সুপ্রিমকোর্ট ও আইন বিষয়ক নিউজের সন্ধানে। ফ্যাসিবাদের আমলে সুপ্রিমকোর্টের অন্যায় ও অবিচার নিয়ে নিউজ করতে গিয়ে কারাভোগ করতে হয়েছিল। সেটা ভিন্ন বিষয়। ফ্যাসিবাদ মূলত দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল সুপ্রিমকোর্টের নিরঙ্কুশ সহযোগিতার মাধ্যমে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসেই খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, এম মতিনদের মত আওয়ামীদের মাধ্যমে কব্জায় নেন সুপ্রিমকোর্ট। আওয়ামী ক্যাডার ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের বসানো হয় বিচারকের আসনে। তারাই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার প্রধান হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছেন।
৫ আগষ্ট বিপ্লবের পর আপিল বিভাগ থেকে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সেক্রটারিকে তাড়ানো হয়েছে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগে ৫৭জন এখনো রয়ে গেছে। এরমধ্যে খুনের মামলার প্রধান আসামী, সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুর ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতিসহ চিহ্নিত আওয়ামী ক্যাডাররা রয়েছেন।
সকলেরই মনে আছে নিশ্চয়ই খায়রুল হক নামক এক ব্যক্তির কথা। ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে সুপ্রিমকোর্টকে কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। এই খায়রুল হকই ছিলেন ফ্যাসিবাদের নাটের গুরু। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল-ই শুধু নয়, সুপ্রিমকোর্টকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি করণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে একজন নয়, সুপ্রিমকোর্টে ৫৭জন খায়রুল হক রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিমকোর্টে অনেক বিষয়েই তৎপর। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ৫৭জন খায়রুল হককে নিয়ে তাদের স্পষ্ট কোন বক্তব্য নেই। বরং আইনজীবী ফোরামের বর্তমান সভাপতির মুখে শোনা যায় উল্টা কথা। তাদের নিয়েই নাকি চলতে হবে, এই হচ্ছে বয়ান।
অনেকেই যুক্তি দেন একসঙ্গে তাদের অপসারণ করার সুযোগ নেই। বা তাদের অপসারণ করলে আদালত চলবে কেমন করে?
এর বিপরীতের বলা যায়, আপিল বিভাগের ৫ জনকে যে প্রক্রিয়ায় বিদায় করা সম্ভব হয়েছে, একই প্রক্রিয়ায় হাইকোর্ট বিভাগের ৫৭জনকেও সম্মানের সাথে বিদায় দেওয়া সম্ভব। এছাড়া সুপ্রিমকোর্ট বছরে একাধিকবার দেড় মাস করে ছুটিতে যায়। এই ছুকিকালীন সময়ে তো দেশ চলে! ৫৭ জন খায়রুল হককে বিদায় করতে আদালত একমাস বন্ধ থাকলে তেমন কিছুই অচল হবে না, যেভাবে সুপ্রিমকোর্ট দেড় মাসের ছুটিতে গেলে দেশ অচল হয় না।
সুপ্রিমকোর্টে বার এসোসিয়েশনে অনেক দক্ষ আইনজীবী রয়েছেন, যারা বিচারক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
৫৭ জন খায়রুল হককে বিদায় দিয়ে যোগ্যদের দ্রুত নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তা করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে যে কোন সুযোগে ৫৭ জন খায়রুল হক হিংস্ত্র ছোবল দিতে ভুল করবে না। তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
সুপ্রিমকোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে নিয়োগ পাওয়ার জন্য লম্বা লাইন ও তদবীর দেখেছি নিজের চোখে। যারা এই নিয়োগের জন্য তদবীর ও চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের একবার ভাবা উচিত বিষয় গুলো। তারা কার কোর্টে গিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে ন্যায় বিচার চাইবেন! এছাড়া যাদের রক্তের বিনিময়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে চাকুরি করার জন্য তদবীরের সুযোগ পাচ্ছেন সেই আত্মত্যাগিদের কথাও স্মরণ করা উচিত প্রতিটি মূহুর্তে। তারা কি আত্মত্যাগ করেছেন খায়রুল হকদের কাছে বিচার চাওয়ার জন্য?
২. দুর্নীতি দমন কমিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল ২০০৪ সালের নভেম্বরে। এই প্রতিষ্ঠানটির চুড়ান্ত অপব্যবহার করেছেন ফ্যাসিবাদি শাসক শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় এই কমিশনে বর্তমানে যারা রয়েছেন তাদের অবদান কম নয়। ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নক হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান বন্ধনা করে অনেকেই এই কমিশনের শীর্ষ পদ লাভ করেছিলেন। তারাই এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যেসব ব্যক্তিরা দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ার ব্যবহার করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ অনেকের চরিত্র হননে লিপ্ত ছিলেন তারাই এখনো চড়ি ঘুরাচ্ছেন।
আমার এই সফরে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির হালহকিকত নিজের চোখে দেখেছি। ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মা ও শেখ মুজিব বন্ধনাকারীদের উঁচু পদে বহাল তবিয়তে রেখে আর যাই হউক, বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জন কখনো সম্ভব হবে না। বরং বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন