রাফসান গালিব (Rafsan GAlib)
একজন বিবাহিত নারী। সধবা নাকি বিধবা জানেন না। স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন হাল ছেড়ে দেন। কয়েক বছর হয়ে গেল, আর কত!
মারা গিয়েছেন ধরে নিয়ে সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। স্বামীকে খোঁজার দাবি নিয়ে আর কোথাও যান না। একদিন তার স্বামীকে স্বপ্নে দেখলেন। স্বামী তাকে বলছেন- তুমি কি আমাকে আর খুঁজবে না? আমাকে কি আর দেখতে চাও না? তুমি খোঁজ নিলে পেয়ে যেতে। এরপর আবারও বের হতে থাকলেন তিনি।
একজন বয়স্ক মা-বাবা৷ সন্তানকে খুঁজতে খুঁজতে কত বছর কাটিয়ে দিলেন। কোথাও পান না। অপেক্ষা করে থাকেন কবে তাদের ছেলে আসবে। বাবা একদিন অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে বলেন, ছেলে তাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিল। তার সঙ্গে কথা বলেছে। তার হাত ধরেছে। তার স্পর্শ এখনো অনুভব করেন তিনি।
পরে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন, এগুলো আসলে বিভ্রম। এরপরেও হাসপাতালে ছেলে তাকে দেখতে আসার গল্প করেন তিনি। সেই বাবা একদিন চিরতরে চলেই গেলেন৷ দুইজনের আর কখনো দেখা হলো না।
একটা পরিবার। পরিবারটির স্বামী বা বাবা প্রতিদিন বিকেলে বাইরে থেকে বাসায় ফিরত। সে জন্য প্রতিদিন বিকেলে বাসার দরজা খুলে রাখেন তারা। তিনি আর আসেন না।
আরেকটি পরিবার। বাসায় নানা সময়ে মানুষটার আওয়াজ শোনে এ রূম ও রূম থেকে- 'এই এক কাপ চা করে দাও তো', 'এই এক গ্লাস পানি দাও', 'কেউ আমার গামছাটা নিয়ে আসো তো', 'আমার ঘড়িটা কোথায় গেল'। কিন্তু মানুষটা আসলে নাই৷ কিন্তু আছে, সারাক্ষণ তাদের মনে।
একজন স্ত্রী। ছেলেকে নিয়ে গেছেন হাসপাতালে। সেখানে বসে বসে ডায়েরি লিখছেন। স্বামীর ওপর সব রাগ, অভিমান, অভিযোগ ঝরে পড়ছে: তুমি থাকলে আজকে আমার এত কষ্ট করতে হতো না। বাচ্চাটা এত কষ্ট পেত না, তার যত্ন করতে পারতে।
একটা বাচ্চা। কখন তার বাবাকে দেখেছে ভুলে গেছে। সেই বাচ্চাকালে দুই তিন বছর বয়সে। মনেও থাকার কথা না। এখন সে অনেক বড় হয়ে গেছে। বারো-চৌদ্দ বছর। যদি রাস্তাঘাটে হুট করে বাবা দেখে ফেলে তাহলে তো চিনবে না এখন। তাই সে তার পড়ার টেবিলের সামনে রুমের দেয়ালে বাবার ছবি লাগিয়ে রেখেছে৷ যদি হুট করে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়, তাহলে চিনতে পারে।
আরেকটা বাচ্চা। তার প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড খাতায় লিখে রাখে৷ বাবাকে নিয়ে কখন কোথায় কোন পত্রিকায় কী ছাপানো হচ্ছে সেগুলোও গাম দিয়ে আটকে রাখে খাতায়৷ দেওয়ালে। পাশে লিখে রাখে- প্লিজ পাপা, কাম ব্যাক সুন। উই উইল মিস ইউ।
অনেকগুলো বাচ্চা। স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে নানা হেনস্থার মুখে পড়ে। মানুষ তাদের নিয়ে ফিসফাস শুরু করে দেয়। কোনো কোনো শিক্ষকেরা তাদের অন্য চোখে দেখে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের রাখতে চায় না।
একজন বোন। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ধরে টানা এক মাস প্রতিটা জায়গায় খুঁজে বেড়ান তার ভাইকে। নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে তুলে নেয়ার পর শীতলক্ষ্যায় তাদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে তার ধারণা হয়েছিল, শীতলক্ষ্যার পাড়ে গেলে হয়ত তার ভাইয়ের লাশটা অন্তত খুঁজে পাবেন। শীতলক্ষ্যা এখনো বয়ে যায়, ভাই-বোনের আর দেখা মেলে না।
পরিবারগুলো স্বজনের খোঁজে থানায় থানায় ঘুরেছেন৷ কোথাও কোনো এফআইআর বা মামলা নেয় নাই। রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন বারবার। পুলিশ বাধা দিয়েছে, অনেক সময় দাঁড়াতেও দেয় নাই৷ শুরুর বছরগুলোতে মিডিয়াতেও তাদের কথা প্রকাশ হইত না
এগুলো গল্প না। গত এক যুগ ধরে গুম হওয়া পরিবারের দৈনন্দিন বাস্তবতা ও জীবনযাপন। তারা আসলে এভাবেই একটা বৃত্তে ঘুরতে থাকেন। প্রিয় মানুষের স্মৃতির জালে বন্দী জীবন কাটান তারা।
নৃতত্ত্বের শিক্ষার্থী ও ফটোগ্রাফার মোশফিকুর রহমান জোহান একেকটা পরিবারের সাথে টানা কয়েক বছর ধরে কাজ করে, ঝুঁকি নিয়ে তাদের বাসায় বাসায় গিয়ে দিনের পর দিন পড়ে থেকে ছবি তুলেছেন। প্রতিটা পরিবারের, ঘরের, জীবনযাপনের চিত্র ক্যামেরাবন্দী করেছেন। এতদিন কোথাও দেখাতেও পারেন নাই।
সেসবের কিছু ছবি প্রদর্শন ও গল্প তিনি আজকে বর্ণনা করলেন। প্রতিটা ছবি দেখছিলাম, ছবির বর্ণনা শুনছিলাম আর বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছিল।
গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার, গুম নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস এক্টিভিস্ট, সাংবাদিক, গবেষকদের নিয়ে 'রোধ' এর আয়োজনে 'গুম: বিচ্ছেদ ও ব্যবচ্ছেদ' শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সি মজুমদার হলে এ আয়োজন হয়।
জোহানের এই অসাধারণ কাজটার পুরো প্রদর্শনীটি আরও বিস্তারিত শুক্রবার থেকে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে এক সপ্তাহ প্রদর্শনী হবে৷ ৩০ আগস্ট–৬ সেপ্টেম্বর। প্রতিদিন ১০.৩০–৫.৩০টা, শুক্রবার ২.৩০–৭.৩০টা আর বৃহস্পতিবার বন্ধ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন