চলতি বছরে এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল ৩৩ হাজার ৮৬০ পরীক্ষার্থী। ধারণা করা মোটেই অসঙ্গত নয় যে, এদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। এটাও অনুমান করি যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই ঝরে পড়েছে অধিক সংখ্যাতে। কারো বিয়ে হয়ে যায়, কারো বাবা-মা পড়াশোনার খরচ যোগাতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এরই মধ্যে কয়েকটি অসামান্য খবর বের হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে মেয়েদের কেউ কেউ সে রকমেই অসম্ভব কাজ করেছে যেমনটা করেছে তাদেরই বয়সী সাফ চ্যাম্পিয়ান আমাদের নারী ফুটবল খেলোয়াড়রা।
যেমন মানিকগঞ্জের একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়ার তিন-চার দিনের মাথাতে এসএসসি পরীক্ষা দিতে চলে গেছে; বাড়ির কাছে নয়, বেশ দূরের পরীক্ষাকেন্দ্রে। কুমিল্লার আরেকটি মেয়ে- সুমাইয়া আখতার- বাসায় বাবার মৃতদেহ রেখেই গেছে পরীক্ষা দিতে। পিতা কাজ করেন গাড়িচালকের। সুমাইয়া আখতাররা তিন বোন ও দুই ভাই; সে সবার বড়। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে শিক্ষিত হয়ে শিক্ষকের চাকরি করবে। মেয়েটি মেধাবী, ভালো সংগঠক। পরীক্ষার আগের রাতে বাবার সঙ্গে কথা বলেছে। মধ্যরাত্রিতে পিতা চলে গেলেন। সকালে উঠে আড়াই কিলোমিটার দূরে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে সুমাইয়া। পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে বাবার মৃত দেহ ধরে বুক চাপড়ে বলেছে, "বাবা, বাবা আমি পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। তুমি চোখ খোলো। ও বাবা তুমি চোখ খোলো।"
এই মেয়েদের দাদী নানী খালা ফুফুরা একাত্তরে অকল্পনীয় দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। তাদের সাহস ছিল না, তবু স্বপ্ন দেখেছেন মুক্তির। পরে তারা দেখতে পেয়েছেন, স্বপ্ন নয়, নতুন এক দুঃস্বপ্নই ঘিরে ফেলেছে তাদের জীবনকে।
তবে দেশের সমষ্টিগত একটা স্বপ্ন যে ছিল সেটা আমরা জানি। বামপন্থি রাজনৈতিক নেতারা তখনো বলেন স্বপ্নটি ছিনতাই হয়ে গেছে। ছিনতাই নয়, স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে চলে গেছে সুবিধাভোগীদের কাছে। সুবিধাভোগীদের সুবিধা বহু পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষভাবে দুঃসহ হয়েছে মেয়েদের জীবন, একাত্তরে তাদের জীবন বিপন্ন ছিল ভয়াবহভাবে, পরবর্তীতেও সে জীবনের উন্নতি ঘটেনি। ধর্ষণ তো আছেই। গত এক বছরে শুনলাম বাল্যবিবাহ বেড়েছে ১০ শতাংশ।
তা সুবিধাভোগী ঘরের মেয়েরা কী করে? কী করছে? একটা নমুনা পাওয়া গেল ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রীনেত্রীদের কাজকর্মে। ইডেন কলেজ অনেক কারণে সুখ্যাত-মেয়েদের শিক্ষিতকরণের কাজে তার ভূমিকা ঐতিহাসিক। দেশের রাজনীতিতেও এই কলেজের ছাত্রীদের ভূমিকা রয়েছে, উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে ওই কলেজ খবরে এসেছে শিক্ষাগত বা রাজনৈতিক উৎকর্ষের কারণে নয়, সুবিধাভোগী মেয়েদের বিশেষ রকমের তৎপরতার দরুন। বলাই বাহুল্য যে এই মেয়েরা সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠনের অর্থাৎ ছাত্রলীগের সদস্য। তাদের কলহ বেধেছে তবে সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনের মেয়েদের সঙ্গে নয়, বিরোধীদের তো কলেজে থাকবারই কথা নয়, এবং তারা নেইও; কলহ নিজেদের মধ্যেই এবং আদর্শগত প্রশ্নে নয়, ভাগবাঁটোয়ারার প্রশ্নে। ছাত্রনেত্রীদের নাকি প্রচুর আয়। কলেজ হোস্টেলের ৯০টি কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা আসন বিতরণ করে, সালামি নেয়, মাসে মাসে ভাড়াও তোলে। কলেজে যেসব ঠিকাদারি কাজ চলে তার থেকেও বখরা পায়।
কিন্তু, এই সব আয়-রোজগার সংগঠনের প্রধান যে দুই জন তাদের কাছেই চলে যায়; অন্য কর্মকর্ত্রীরা বঞ্চিত হয়। আর সেই বঞ্চনার বেদনা থেকেই কলহ, পরস্পরের ওপর হামলা, রক্তারক্তি হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, এবং দুই পক্ষেরই থানায় গিয়ে মামলা করা, পরস্পরের বিরুদ্ধে।
সাধারণ ছাত্রীদের ক্ষোভ ছিল, তাদের ওপর আর্থিক নির্যাতন তো বটেই, মানসিক, এমনকি শারীরিক বলপ্রয়োগও চলতো। দুর্বৃত্ত পুরুষরা যা করতে ভালোবাসে নেত্রীরা নাকি তেমন কাজও করতো। মেয়েদের বিবস্ত্র করে ছবি তুলে ছড়িয়ে দেবার ভয় দেখাতো, এবং ভয় দেখিয়ে বশে রাখতো।
নির্যাতিত ছাত্রীরা আশা করেছিল এবার অবস্থাটা বুঝি বদলাবে, কিন্তু অবস্থা কী অত সহজে বদলায়, বিশেষ করে ব্যবস্থাটা যদি অক্ষুন্ন থাকে? ব্যবস্থাটা এমনই যে এমন খবরও আমাদেরকে পড়তে হয় যে-গরু চুরির দায়ে ছাত্রলীগ নেত্রী গ্রেফতার হয়েছে; ঢাকার কাছেই, ধামরাইতে। বোঝা যায় পদে থাকলে কত পদের সুবিধা পাওয়া সম্ভব। সে জন্যই তো মূল দল যে আওয়ামী লীগ, তার সাধারণ সম্পাদক গভীর দুঃখ ও শঙ্কার সঙ্গে দলের লোকদেরকে বলেছেন যে আওয়ামী লীগের নানা স্তরে "এই মুহূর্তে পদবাণিজ্য সব চেয়ে লাভজনক ব্যবসাতে পরিণত হয়েছে", এবং উদ্বেগাকুল কণ্ঠে আবেদন করেছেন, "টাকায় লেনদেন বন্ধ করুন, দলটাকে বাঁচান।"
পদ নিয়ে মারামারিতে শিক্ষকরাও অবশ্য পিছিয়ে নেই। রংপুরের পীরগঞ্জে একটি স্কুলের ব্যবস্থাপক কমিটিতে পদ পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্বে লিপ্ত শিক্ষকরা বল্লম নিয়ে এপক্ষ ওপক্ষকে ধাওয়া করেছেন, ফলে প্রাণ গেছে এক ছাত্রের।
ছেলেরা মেয়েদেরকে ছাড়িয়ে যায়; স্বভাবতই। তারা কেবল রক্তারক্তিই ঘটায় না, বিরোধিতার গন্ধ পেলে এমনকি মেরেও ফেলে। পিটিয়ে। আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ? সেসবের তো শেষ নেই। খুব শান্ত শহর ছিল কুমিল্লা, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার জন্য সুখ্যাতি ছিল প্রচুর, সেই শহর এখন অনেক দিক দিয়েই আগের তুলনায় অনেক উন্নত, উন্নতির ধারাবাহিকতায় সেখানে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম মাঝে মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়; অন্য কারণে নয়, সরকার-সমর্থক ছাত্রদের ভেতর সংঘর্ষের কারণে। একাংশের সঙ্গে অপরাংশের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে।
সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে দৌড়াদৌড়ি ঘটে, এবং খবর পাওয়া যায় যে নেতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকে, "খুন-ধর্ষণ মামলার আসামীরা"। তা তারাই তো এগিয়ে থাকবে, যাদের ক্ষমতা অধিক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দৌড়াদৌড়ি তো সামান্য ব্যাপার, খুনোখুনিও নিতান্ত সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন ঝিনাইদহের এই ঘটনাটি। ছাত্রলীগের একপক্ষের দু'জনকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে অন্যপক্ষ, এবং ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে তিনজন। ওই একই দিনে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যার স্মরণে সভা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অধিকার পরিষদের ২৪ জন নেতা-কর্মী "হামলা সয়ে মামলা খেয়ে কারাগারে" স্থান পেয়েছে। সবটাই ক্ষমতার ব্যাপার।
সমস্ত কিছু মিলে বাস্তবতাটাকে এখন অত্যন্ত অবাস্তবিক মনে হয়। কিন্তু এটাই তো সত্য। ১০০ বছর আগে ফ্রানৎস কাফকা যে বাস্তবতাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন তাঁর সময়ের আপাত-অবাস্তব, কিম্ভূত, যুক্তিহীন এক জগৎকে চিত্রিত করে, সেই বাস্তবতা এখন আরও অধিক পরিমাণে সত্য হয়ে উঠেছে উন্নতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। বাংলাদেশে যা ঘটছে তা বিশ্বব্যবস্থার বাইরে নয়। বিশ্বজুড়েই অস্বাভাবিকতা স্বাভাবিকতার রূপ নিয়েছে।
প্রেসক্লাবের সামনে কুষ্টিয়ার কাজী আনিসুর রহমানের নিজের গায়ে আগুন দিয়ে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন; ঠিক একই জায়গাতে একই কাজ করার চেষ্টা নিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ'র শিরিন খান; তবে একা নন, দুই শিশু সন্তানসহ। কারণও ওই একই, প্রতারণা। জমি কিনেছেন একটুকরো, জমিতে বাড়ি তৈরি করেছেন কোনোমতে, এখন নোটিশ এসেছে উচ্ছেদের। টের পেয়েছেন যে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, যার কাছ থেকে জমি কিনেছিলেন তার দ্বারাই; ইনি আবার শক্তিধর ব্যক্তি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। শিরিন খান ও তাঁর সন্তান দু'টি শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেছেন, আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে আগুন নিভিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অভিযোগের মীমাংসা কী?
আগুন তো জ্বলছেই। মানুষ তো দগ্ধই হচ্ছে। অসহায়ত্বে, নিরাপত্তাহীনতায়। ঢাকা শহরের ধানমন্ডির লেক এলাকা নিরাপদ বলেই কথিত। শাহাদাত হোসেন মজুমদার একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার; জাহাজে যাবেন, অপেক্ষায় ছিলেন। অপেক্ষারত অবস্থায় লেকের ধারে বেড়াতে বের হয়েছিলেন সন্ধ্যার পরে। পাশেই থানা, পুলিশও টহল দেয়। নিরাপদ জেনে হাঁটছিলেন। পাঁচজন কিশোর তাকে ঘিরে ধরলো। তার মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিতে চাইলো। তিনি বাধা দিলেন। ব্যস, ওইটিই হলো তার অপরাধ। কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা তাকে ছুরিকাঘাত করলো। তিনি পড়ে গেলেন এবং মারা গেলেন। পুলিশ অপরাধীদেরকে ধরেছে ঠিকই, তবে তাতে তো শাহাদাত হোসেন তার প্রাণ ফিরে পাননি। মোবাইল বিক্রি করে ছিনতাইকারীরা নাকি সাড়ে তিন হাজার টাকা ও দশটি ইয়াবা বড়ি পেয়েছিল। জীবনের মূল্য তাহলে অতটাই।
নিরাপত্তা কে দেবে? দেবার কথা পুলিশের। পুলিশের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে কী? ঢাকা শহরের সকল থানাই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, থানার ওসি'রা অত্যন্ত দায়িত্ববান অফিসার; তাঁদেরই একজনের সম্বন্ধে যদি এমন খবর শুনতে হয় যে তাঁর বিরুদ্ধে এই মর্মে মামলা হয়েছে যে তিনি পাঁচজন পুলিশসহ একজনের অফিসে ঢুকে টাকা ও স্বর্ণ লুট করেছেন, তাহলে জনমনে ভরসার কোন আস্থা সৃষ্টি হয়, শুনি? সন্দেহ করবার কারণ কী থাকে না যে এমন ঘটনা আরও ঘটছে, এবং ঘটবে?
ঢাকা শহরেরই আরেকটি খবর, একটি দৈনিকে।
"পুলিশ কনস্টবল গ্রেফতার। ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে অর্থ আদায়। একটি সংঘবদ্ধ দল ধানমন্ডি এলাকা থেকে একজন ব্যবসায়ীকে আটক করে, হাতে হ্যান্ডকাফ লাগায়, বলে তারা পুলিশের গোয়েন্দাবাহিনীর লোক। তারা ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা আদায় করে। তিনটি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। তবে সেখানেই থামে না। শাহবাগ থানার একটি পুরানো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পাঁচ দিন ধরে তাঁকে আটক করে রাখে এবং পরে আদালতে হাজির করে। আদালত তাকে জামিন দেন, কারণ এজাহারে তাঁর নাম ছিল না। জামিন পেয়ে সাহসের ওপর ভরসা করে তিনি অপহরণের মামলা দায়ের করেন। সংঘবদ্ধ ওই দলে তিনজন পুলিশ কনস্টবল ছিল। ইউনিফর্ম পরিহিত।"
অভিজ্ঞতাগুলো নিশ্চয়ই গুণগত মানে খুব কী স্বতন্ত্র? তাহলে প্রশ্ন সময় ও সমাজ যাচ্ছে কোন দিকে!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন