উত্তর আমেরিকা তো বটেই, বাদ বাকি পৃথিবীতেও মার্গারেট অ্যাটউড বর্তমান সময়ের একজন তারকা লেখক। তার যে কয়টি উপন্যাস পড়া হয়েছে, কোনোটাতেই গল্পের শেষটা ঠিক কোন দিকে গড়াবে সে সম্পর্কে আগাম ধারণা করতে পড়িনি। গল্পের শেষটা তিনি এমন রাখেন, সেখান থেকে অনায়াসে আরেকটি গল্প বেরিয়ে আসতে পারে! অনেকটা আরব্য রজনীর মতো, শেষ হয়ে আরেক শুরুর ইঙ্গিত দিয়ে যায়!
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি তার উপন্যাসের ভেতরকার বর্ণনার বেলায়ও। কাহিনি আচমকা মোড় নেয়, এক কাহিনির ভেতরে হাজারো না-বলা ছোট ছোট গল্প দিব্যি লুকিয়ে থাকে! গল্প বলার ঢংয়ে পাঠককে চমকে দেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা তার। উত্তেজনায় ঝুলিয়ে রাখার বেলায় তিনি এক হাত দেখিয়ে দিলেন ১৯৮৫ সালে ‘দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল’ লেখার পর। এমন এক জায়গায় এসে তিনি গল্পটা শেষ করলেন, পাঠক স্বস্তি পাবে কী, আরও বেশি উতলা হয়ে পড়েছিল পরের অবস্থা জানতে!
মোটমাট ৩৪ বছর অপেক্ষায় রাখার পর লিখলেন দ্বিতীয় ধারাবাহিক, ‘দ্য টেস্টামেন্টস’! অবশ্য এই দুই উপন্যাসের ভেতর কাহিনি বর্ণনায় সময়ের পার্থক্য ছিল ১৫ বছর।
পাঠকও তাকে কম জ্বালায় নাই, কম দৌড়ের ওপর রাখে নাই! যে কোনো ধরনের সাক্ষাৎকারেই তার জন্য মোটামুটি কমন প্রশ্ন বরাদ্দ ছিল, ও হ্যাঁ, তারপর অফরেডের কী হলো? ওই যে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাতের আঁধারে! লেখক নিজে অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন গল্প বলার ব্যাপারে। তিনি গল্প বলাকে একা গল্প বলিয়ের দায়িত্ব বলে মনে করেন না। তার ব্যাখ্যা হচ্ছে গল্প এগিয়ে চলবে পাঠক-লেখক মিলিয়ে। লেখক যা বলেন না পাঠক সেটুকু নিজের চিন্তায় পুষিয়ে নেন আবার পাঠকের চিন্তা থেকে লেখকের নতুন লেখার উপাদান জোটে, এ এক পারস্পরিক চক্র! পাঠকেরও সমান স্বাধীনতা আছে গল্পকে টেনে এগিয়ে নেবার!
কিন্তু এসব মিষ্টি কথায় তো আর আমাদের মন ভরলে চলে না। ‘দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল’ যখন নাটক, সিনেমা, টিভি সিরিজ, থিয়েটার ইত্যাদি নানা মিডিয়ায় দারুণ জনপ্রিয় হয়ে পৃথিবী মাতিয়ে তুলেছে, অনেকটা চাপে পরেই তাকে এর ধারাবাহিকতায় ‘দ্য টেস্টামেন্টস’ লিখতে কলম তুলতে হয়েছে। গত বছরের শেষার্ধে বইটি বাজারে আসে।
অ্যাডউডকে অনেকেই ডিসটোপিয়ান লেখক বলতে ভালোবাসে। হ্যান্ডমেইডস টেল ও টেস্টামেন্টস দুটোই সে ক্যাটাগরিতে পড়ে। দুটোতেই রাষ্ট্র দানব হয়ে গেলে কী আচরণ করতে পারে বা কেমন করে দমন-পীড়ন অথবা কণ্ঠরোধ করে বা করতে পারে তার ভয়াবহ বর্ণনা আছে। চলতি বিশ্ব, রাজনীতি, কূটনীতি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন অ্যাটউড জানেন, বিশ্বের অনেক নৃশংসতাই আজও অপ্রকাশিত এবং জায়েজ, সুশাসনের নামে অত্যাচারের নানান আঞ্চলিক চেহারাও বিদ্যমান!
এক দুঃস্বপ্নের ভোরে জিলিডের নারীরা জানতে পারে দেশের ক্ষমতা দখল হয়ে গেছে কমান্ডারদের দ্বারা। কমান্ডাররা বাইবেলে বর্ণিত, জীবনযাপনের নির্দেশ মেনে দেশ শাসন করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেছে। ক্ষমতা দখলের পরপরই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যায় জিলিডের মানুষের ওপর, শত শত গোপন ও প্রকাশ্য লাশ পরতে থাকে। সবার চোখেমুখে ঠুলি, নারীর বাইরে কাজ বন্ধ-তারা কোনো টাকাপয়সা লেনদেন করতে পারছে না, সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট গায়েব। পুরুষদের ডাক দেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য আর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সব চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব করে রাখা হয়েছে। দেশের ভেতরে জরুরি অবস্থা, চারদিকে গোপন গোয়েন্দাদের তৎপরতা। গোপন ক্যামেরা, টেলিফোনে আড়িপাতার ব্যবস্থা।
শাসকের আসল চেহারা গেড়ে বসে দেশটিতে! সেনাবাহিনীর র্যাংক যার যত ওপরে, তার তত বিলাসী জীবনযাপন, যত বড় অফিসার তত বেশি বিয়ে। বিত্তবানদের সন্তান শুধু স্কুলে যাবে এবং হাতেগোনা মেয়েদের স্কুলে শুধুমাত্র ভালো গৃহিণী হবার ট্রেনিং দেয়া হবে। সকল লাইব্রেরিতে তালা, এমনকি বাইবেলগুলোও আলমারিতে তালাবদ্ধ! কমান্ডাররা মুখে যা বলছে তা-ই বাইবেল বাণী বলে মেনে নিতে হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে জীবনযাপনে কৃচ্ছ্রতা আনতে হবে কারণ যুদ্ধের ব্যয়ে বাজারে আকাল। শাসক ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যে কোনো রকম সন্দেহ, মন্তব্য, বিদ্রোহের জন্য কঠিন শাস্তি। অত্যাচার করে হত্যা করার পর ক্ষতবিক্ষত লাশ পচে যাবার আগ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে রাস্তার মোড়ের দেয়ালে। শীতল ভয়, চাপা আতঙ্ক, অনাস্থা, অস্বস্তি ছড়িয়ে পরেছে জিলিডের পরতে পরতে!
টেস্টামেন্টস নিয়ে লিখতে গেলে হ্যান্ডমেইডস নিয়ে না লিখে পারা যাবে না। প্রথমটাতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক মাইক্রো লেভেলের চিত্র ও অন্যটাতে রাষ্ট্র-কূটনীতি-সংগঠন ইত্যাদি ম্যাক্রো লেভেল থেকে দেখা চিত্র আঁকা হয়েছে। ‘হ্যান্ডমেইডস টেল’-এ শাসনব্যবস্থার পুরো চেহারাটা ধরা পড়ে না, যতটা ধরা পড়ে টেস্টামেন্টসে। অ্যাটউডের কল্পনার এক অনবদ্য চরিত্র সৃষ্টির নাম ‘হ্যান্ডমেইড’! সন্তান জন্মদানে সক্ষম, অপরাধী ও বিদ্রোহী নারীদের, অথবা শাসকের ইচ্ছে অনুযায়ী নারীদের শুধু যৌনকাজে ব্যবহার ও সন্তান জন্মদানের জন্য রাখা হয়েছে। হ্যান্ডমেইড নারীর মাথা ও শরীর লাল রঙের পোশাক দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা। কমান্ডার ও সমাজের অন্যান্য অভিজাত পুরুষের বাড়িতে সন্তান জন্মদানকারী হিসেবে এরা ব্যবহৃত হতে থাকে। বাড়ি থেকে বাড়িতে হাতবদল হতে থাকা হ্যান্ডমেইডরা, এক বাড়িতে সন্তানের জন্ম দেয়া মাত্র আরেক বাড়িতে নতুন নামে প্রবেশ করে! তারা সন্তানের মালিকানা বা লালনপালনের দাবিদার নয়, এমনকি জীবনে দ্বিতীয়বার দেখারও সুযোগ পাবে না।
অফরেড নামের নারীর চোখ দিয়ে পরিবর্তিত জিলিডকে পাই আমরা, অফরেডের ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং জীবনযাপন অনেক বেশি সাইকো-অ্যানালিটিক্যাল বলা চলে। অফরেডের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা নাই, প্রতিক্রিয়া নাই, ঘর নাই, ভয়েস নাই। একটি পোষা জন্তুও চেয়েও অধম তার জীবনযাপন। তার একমাত্র কাজ হচ্ছে বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্য কমান্ডারের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হওয়া, যে যে উপায়ে যখন কমান্ডার চায়। উপন্যাসে কমান্ডারের মাধ্যমে গর্ভবতী হতে না পারলে ড্রাইভার নিকের সঙ্গে অফরেডকে গোপনে শুতে হয় কমান্ডারগিন্নীর আদেশে! যেকোনো উপায়ে বাচ্চা দরকার এই পরিবারের।
শেষমেশ নিকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরে অফরেড এবং নিককে বিশ্বাস করে নিজের ও কমান্ডারের কিছু গোপন আচরণ শেয়ারও করে ফেলে ভালোবাসার আতিশয্যে! পরবর্তীতে স্পাই নিকের বিশ্বাসঘাতকতায় অন্তঃসত্ত্বা অফরেডকে কালো কাপড়ে মুখঢাকা সেনাবাহিনীর লোক এসে ধরে নিতে আসে ভোর রাতে। বিশ্বাসঘাতকতার নিশ্চিত শাস্তি মৃত্যু, অন্ধকারে কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। অফরেড জানে, এই ভ্যান একবার যাকে তুলে নিয়ে যায় তার আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। শান্ত পায়ে ভ্যানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে অফরেড ভাবছে, এই অনিশ্চয়তার যাত্রা তাকে শেষমেশ কোনদিকে নিয়ে যাবে! আরও অন্ধকারে মৃত্যুর কাছে, নাকি নতুন কোনো শুরুর দিকে!
সময়কাল বিবেচনায় নিলে গল্পটা আবার চলতি সময়েরও, কারণ শুধুমাত্র জিলিড নামের নতুন তৈরি হওয়া রাষ্ট্রটি ছাড়া বাদবাকি পৃথিবী চলতি সময়েরই পৃথিবী। তাহলে প্রশ্ন থাকে, এমন একটি অবাস্তব দেশ আর অসম্ভব শাসনতন্ত্রের উপন্যাসটি কী কারণে এত জনপ্রিয় অথবা প্রাসঙ্গিক হতে পারে! কারণ কি এই যে, সারা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অন্যায়-অত্যাচারগুলোকে আলাদা করে না দেখে অ্যাডউড সবগুলোকে জিলিডে এনে জড়ো করেছেন যাতে ঘটনাগুলোর তীব্রতা আমাদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে পারে! এটি কি একটি সতর্ক হবার বার্তা আমাদের জন্য! সেনাশাসনের দৌরাত্ম্য পৃথিবীতে আছে, নির্যাতন সেল আছে, নারীর প্রতি অত্যাচার আছে, যৌন দাসত্ব আছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত আছে একনায়কের হাতে, সেনা হেডকোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অত্যাচার আছে। জিলিডের ভেতরে যা ঘটছে, সবই তো আছে আজকের পৃথিবীতে, অথচ বাস্তবে জিলিড বলে কোনো ভূখণ্ড নাই!
জিলিডের কথা পড়তে পড়তে আমাদের মনে পড়বে পাশের দেশ আমেরিকায় পুলিশের হাঁটুর চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার আগে এরিক গারনার বলেছিল, “আই কান্ট ব্রিদ!” লালমনিরহাটে পুড়িয়ে মারা যুবকটি, নোয়াখালীর ধর্ষণের ভিডিও, পটুয়াখালীর প্রকাশ্য কোপানোর ঘটনা, এগুলো কি জিলিডের নৃশংসতার চেয়ে কম কিছু!
অফরেডের জীবনের ভয়, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা তাই বোধকরি আমাকেও চিবোতে থাকে! তাই হ্যান্ডমেইডস টেল শেষ হতে অফরেডের কী হলো তা না জেনে অনেক দিন ঘুম আসেনি আমার! খুব র্নিদয় আর নিষ্ঠুর মনে হয়েছে অ্যাডউডকে, পাঠককে এইভাবে অনিশ্চয়তায় ঝুলিয়ে ছেড়ে দেবার জন্য! টেস্টামেন্টস প্রকাশিত হবার পর অ্যাডউড নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “গত ৩৪ বছর লোকজন আমাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে তারপর কী হলো অফরেডের?” তার মুখে এর দুষ্টু উত্তর ছিল, “পাঠকও উপন্যাসের অংশ, তার কল্পনায় সেও গল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যেদিকে খুশি। আমি কে সেখানে তাকে বাধা দেবার!”
অতি আগ্রহ নিয়ে টেস্টামেন্টস পড়তে বসে নিজেকে আহাম্মক মনে হচ্ছিল, খেই হারিয়ে ফেলছিলাম, উপন্যাসের সুর ধরা যাচ্ছিল না। তিন বলয় থেকে তিন নারী নিজেদের কথা বলে যাচ্ছে। কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, কীভাবে তারা পরস্পর সংযুক্ত, কেনই বা তারা এভাবে বলছে, আগের উপন্যাসের জিলিডের সঙ্গে এই উপন্যাসের জিলিডের সময়ের পার্থক্যই বা কী, সবচেয়ে বড় কথা অফরেড কোথায়?
উপন্যাসে সাক্ষ্য দেয়া ৩ জনের মধ্যে দুই কিশোরী-তরুণী অ্যাগনেস ও ডেইজি তারাই বা কেন তাদের শৈশব নিয়ে এত সংশয়ে আছে? কেন প্রথম সাক্ষী, সবচেয়ে জটিল চরিত্রের আন্ট লিডিয়া একই সঙ্গে জিলিডের সব জায়গায় আছে এবং কোথাও নেই! কেন তার সাক্ষ্য তিনি গোপনে “আমার অজানা পাঠক” সম্বোধনে লিখছেন! কীভাবে তিনি জিলিডের সর্বশক্তিমান কমান্ডার জুডকে আঙুলের ডগায় ঘোরাচ্ছেন তার দুর্দান্ত কৌশল আর গোপন তথ্য ব্যবহার করে! লিডিয়া কেন সকল তথ্য সংগ্রহে রাখছেন যত্ন করে! লিডিয়া ভালো, না খারাপ! প্রায় সাড়ে চারশো পাতার উপন্যাসের দেড়শ’ পাতা পর্যন্ত আসতে থামতে হয়েছে বারবার।
শীতল-ভয়াল অত্যাচার আর মানসিক পীড়নের বর্ণনা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে অ্যাডউডের খুঁটিনাটি বর্ণনা করার স্বভাবের কারণে। শ’দেড়েক পাতা হাতড়ে হাতড়ে পড়ার পর কাহিনি অর্থবহ হতে শুরু করে। হ্যান্ডমেইড টেলের টানটান উত্তেজনার পর টেস্টামেন্টস পড়ে ধপ করে বসে পড়ার মতো অবস্থা। অন্য সবার মতোই আশা করেছিলাম অফরেডের পরবর্তী জীবন পড়তে যাচ্ছি, সেটা হয়নি, হ্যান্ডমেইডে মূল চরিত্র টেস্টামেন্টসে এসে হারিয়ে গেছে। অফরেডকে কি পাওয়া যায়নি তবে! হ্যাঁ মিলিয়ে মিলিয়ে পাওয়া গেছে, বোঝা গেছে জিলিডে আটকাপড়া অ্যাগনেস এবং কানাডায় লুকিয়ে রাখা ডেইজিই হলো অফরেডের দুই কন্যা। এক জায়গায় বলা হয় যে কানাডায় পালিয়ে দুই কন্যাকে দেখতে তিনি আসেন তাদের মা। আর আমাদের ধারণা হয় ইনিই অফরেড, জীবন বাঁচিয়ে কানাডায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ওই সময়ে গোপন অ্যান্টি-জিলিড বাহিনীতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
হ্যান্ডমেইডে চলমান বর্তমান সময়কে ধরা হয়েছে এবং অপরদিকে সেটা টেস্টামেন্টসে এসে অতীত কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি শুধু টেস্টামেন্টস পড়ে তবে আলাদাভাবে সেটিও একটি পরিপূর্ণ এবং দুর্দান্ত উপন্যাসই হিসেবেই মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হবে বলে আমার ধারণা।
আন্ট লিডিয়া অতি শক্তিশালী একটি বহুমুখী চরিত্র টেস্টামেন্টে। এককথায় তাকে ভিলেন বা হিরো কিছুই বলা যাবে না, তিনি অনেকগুলো ব্যক্তিত্বের মিশ্রণ। তাহলে কি সময় এবং পরিস্থিতি তাকে দিয়ে ওইভাবে ব্যবহার করিয়ে নিয়েছিল জিলিডের ধ্বংসের জন্য! লিডিয়ার অনেকগুলো চেহারা বেরিয়ে এসেছে পুরো উপন্যাসে এবং তিনি একাধারে ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী, প্রতিহিংসাপরায়ণ, নিষ্ঠুর, উদার, উপকারী, দূরদর্শী, প্রচণ্ড উইটি আর কূটনীতিক। জিলিড তৈরির আগে তিনি একজন ব্যারিস্টার ও ল’ ফার্মের মালিক ছিলেন। কিন্তু জিলিড তৈরির সঙ্গে সঙ্গে সকল ক্ষমতা হারিয়ে বন্দী হন সেনাপ্রধান জুডের সৈনিকদের হাতে। অবর্ণনীয় অত্যাচারের মুখে জিলিডের নারী সমাজকে পরিচালিত করার দায়িত্বটি নিতে হয়েছিল লিডিয়াকে।
আন্ট লিডিয়ারই ব্রেনচাইল্ড হলো নারীর ‘হ্যান্ডমেইড’ এর ভূমিকা গ্রহণ। অন্য প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে তিনি শক্ত হাতে নেতৃত্ব ধরে রাখেন। একপ্রকার জীবন বাঁচাতেই তাকে অতিরিক্ত কৌশলী আর ধুরন্ধরের ভূমিকা নিতে হয়েছে জিলিডের নারী শাসনের কেন্দ্রস্থল “আরডুয়া হল” পরিচালনায়। কী না কূটকৌশল, আড়িপাতা, আর কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেছেন তিনি! ব্যক্তি অ্যাটউডের শক্তিশালী উইট এবং হিউমার তার প্রতিটি উপন্যাসেরই কোনো না কোনো চরিত্রের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসে। এখানে আন্ট লিডিয়ার ভেতরে সেই ছাপ পাওয়া গেছে বারবার। যেমন, অন্ধকার সেলের মৃত্যু দশা থেকে তাকে যেদিন বাইরে আনা হলো তিনি তখন বলছেন, “তারা আমাকে আরও দুইবার লাথি দিল, জানতাম আমাদের একটি ম্যাজিক নাম্বার আছে!” টিপ্পনি কাটার সময়ই তিনি প্রতিশোধস্পৃহায় ভাবছেন, যদিও আমার দুই চোখ জলে ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু দুই চোখের মাঝখানের তৃতীয় চোখটি হয়ে উঠেছিল পাথরের মতো শক্ত। সেটি কাঁদেনি, কিন্তু দেখছিল আর সেই চোখের পেছনে যিনি ছিলেন তিনি ভাবছিলেন, একদিন আমি তোমাদের দেখে নেব! এই হচ্ছেন আন্ট লিডিয়া!
টেস্টামেন্টস অনেক বেশি রাজনৈতিক ও কূটনীতিক উপন্যাস যদিও জিলিড বিলুপ্ত হয়ে যাবার প্রক্রিয়াটি এতে পরিষ্কার পাওয়া গেল না। উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, ওই তিন নারীর সাক্ষ্যপ্রমাণের দলিলগুলো নিয়ে যে হইচই পড়ে গেছে পরবর্তী সময়ের ইতিহাসবিদদের ভেতরে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিন নারী একটি ধর্মীয় শাসন দ্বারা প্রভাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন, নিজেরা লিখিত সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখে যান। যেভাবে জিলিডের ধ্বংসের কারণ তারা হয়ে দাঁড়ান তার রোমহর্ষক শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা রয়েছে এ উপন্যাসে কিন্তু রাষ্ট্রটি ধ্বংসের ঘটনাটি কী উপায়ে ঘটল তার কোনো উত্তর নাই। আমার হাহাকার লাগে, তাহলে লিডিয়া কিংবা অন্যান্যদের শেষমেশ কী হয়! অনুমান করে নিতে পারি ডেইজি এবং অ্যাগনেস হয়তো বেঁচে ছিল, কিন্তু আন্ট লিডিয়ার মৃত্যু সুইসাইড ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।
আরও আছে, জিলিডের আপামর পুরুষেরা কোথায়! কেবলমাত্র কতিপয় কমান্ডারদের পাওয়া গেল। বিশেষ করে সেনাপ্রধান জুডকে বিস্তারিত পাই যিনি কিনা একাধিক কিশোরীকে বিয়ে এবং একটু পুরোনো হলেই নানা উপায়ে হত্যা করেছেন। আরও আছেন দাঁতের ডাক্তার যিনিও চেম্বারে যেসব নারী রোগী আসেন তাদের ধর্ষণ করেন। এইসব পুরুষদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিযুক্ত করা অসম্ভব এবং বিচারও অসম্ভব জিলিডে। ধূর্ত আন্ট লিডিয়া বুদ্ধির মারপ্যাঁচে বেশ কিছু পুরুষ অত্যাচারীকে স্বল্প বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা করেন। জিলিডের বাকি পুরুষেরা তাহলে কোথায়? অর্থনৈতিক-সামাজিক-উৎপাদন ব্যবস্থায় তাদের অবদান কী, জিলিডকে তারা কীভাবে গ্রহণ করলো এসবের কোনো উত্তর নাই। কমান্ডারদের পরিবারগুলো ছাড়া বাইরের নাগরিক জীবনের কোনো ধারণা পাওয়া যায় না, শহরগুলো অথবা গ্রামগুলোর অন্য অর্থনৈতিক-সামাজিক চেহারাই বা কী তারও কোনো ইঙ্গিত নাই।
দমন-পীড়নের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষ কীভাবে এনকাউন্টার করে, কীভাবে প্রতিটি মানুষ টিকে থাকার জন্য নিজ নিজ রাস্তা খুঁজে বের করে, দ্বন্দ্ব-বিপন্নতার কত নানা রঙ থাকতে পারে, প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতার, ভালোবাসার— ইত্যাদির গভীর মনস্তাত্ত্বিক দলিল এ দুটি উপন্যাস।
সেরীন ফেরদৌস: প্রবাসী সাংবাদিক ও কানাডায় কর্মরত নার্স
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন