ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের কারণে জলীয় বাষ্প ও মেঘ তৈরি হওয়ায় গত কিছুদিন ধরেই তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। ফলে এবার সারা দেশে শীত আসতে আসতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। সেই সঙ্গে এ বছর আবহাওয়ার বিশেষ ধরন এল নিনো সক্রিয় থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবার শীতকালের স্থায়িত্ব বা ব্যাপ্তিকাল অন্যান্যবারের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।
শীত মৌসুমে অন্যান্য বছরের তুলনায় তাপমাত্রাও কিছুটা বেশি থাকতে পারে।
গত ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ আন্দামান সাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে এসে ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমে রূপ নেয়। এর প্রভাবে নভেম্বরের শেষদিকে ও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের প্রায় পুরোটা জুড়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল। তবে গত দুইদিন বৃষ্টি হওয়ায় আকাশের মেঘ ও বাতাসের জলীয়বাষ্প কেটে যাচ্ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদরা।
ফলে দুই-একদিনের মধ্যেই দেশে পুরোদস্তুর শীত শুরু হতে পারে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন এ বছর শীতের বিলম্বের কারণ বিশ্লেষণ করে আজ শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাগরে বেশ কম সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটা লঘুচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ মিগজাউম নভেম্বরের শেষ দিকে উৎপত্তি হয়ে ডিসেম্বরের প্রায় প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলল। ফলে তাপমাত্রা বেশি ছিল।
তবে এর (ঘূর্ণিঝড়) প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে। এখন সারা দেশেই মেঘ কেটে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তাপমাত্রা কমে আসবে। শীতও শুরু হবে।’
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামীকাল শনিবার অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
ভোরের দিকে সারা দেশে হালকা থেকে মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে। দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও রাতের তাপমাত্রা কমতে পারে ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের শীত, বাংলা ঋতুর শীত ও এবারের বাস্তবতা
বাংলা ষড়ঋতু অনুযায়ী পৌষ-মাঘ (ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি) দুই মাসকে শীতকাল ধরা হয়। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস সময়কে শীতকাল বা শুষ্ক মৌসুম ধরে থাকে। সাধারণত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের পর তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং শেষ দিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে শীতের অনুভূতি টের পাওয়া যায় ভালোভাবেই।
এবারও উত্তরাঞ্চলের ক্ষেত্রে এর তেমন একটা ব্যতিক্রম হয়নি। গত ২৭ নভেম্বর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই তাপমাত্রা নির্দেশ করে ওই অঞ্চলে শীত শুরু হয়ে গেছে তখনই।
কিন্তু বঙ্গোপসাগরে একাধিক লঘুচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এবার সারা দেশে সামগ্রিকভাবে শীত শুরু হতে কিছুটা বিলম্বই দেখা যাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এবার শীতের স্থায়িত্ব কম হচ্ছে। তবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আগামী দুই-একদিনের মধ্যে আকাশের মেঘ কেটে গেলে সারা দেশেই শীত শুরু হবে।
আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখ। সাগরে সিস্টেম (ঘূর্ণিঝড়) না থাকলে আরেকটু আগেই শীতের অনুভূতি পাওয়া যেত। হ্যাঁ, এবার শীতের সময়কাল কম হবে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু অন্যান্যবারের মতো শীতের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলো থাকবে। এবারও ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের পর মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। জানুয়ারি মাসেও একাধিক শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।’
তবে গত কয়েক বছর ধরে শীতকালের বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এর স্থায়িত্বকালে। আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে শীতকালের মূল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে শীতের ব্যাপ্তিকালে। শীতের ব্যাপ্তি কমে গিয়েছে। অন্যদিকে গরমের সময় বেড়ে গেছে। গরমকালে আগে আমরা যে পরিমাণ তাপপ্রবাহ দেখতাম এখন তার চেয়ে অনেক বেশি তাপপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। ঠিক একইভাবে, শীতের সময়কালই যেহেতু কমে গেছে তাই শৈত্যপ্রবাহের সময়ও কমে গেছে।’
দেশে ডিসেম্বর মাসে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬.৪ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৩.৫ ডিগ্রি। কিছু অঞ্চল ছাড়া দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলেই দিনের তাপমাত্রা ২৩ থেকে ২৪ ডিগ্রির আশপাশে ছিল। এর মানে দিনের তাপমাত্রা গড়ের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি কম।
আবার অন্যদিকে রাতের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি থাকছে। ঢাকায় বৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৯.৫ ডিগ্রি। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল দিনাজপুরে ১৭.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ রাতের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি থাকছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মূলত মিগজাউমের প্রভাবে মেঘ চলে আসায় সূর্যের আলো ঠিকমতো আসতে না পারায় দিনের তাপমাত্রা বাড়েনি। একইভাবে রাতের আকাশে মেঘ থাকায় ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বের হয়ে যেতে পারছে না। ফলে রাতের তাপমাত্রাও সেভাবে কমছে না।
আবহাওয়াবিদরা জানান, বৃষ্টি হওয়ায় আকাশের মেঘ কেটে যাওয়ায় রাতের তাপমাত্রা দ্রুতই নামতে শুরু করবে। রাত ও দিনের তাপমাত্রাও ক্রমশ কাছাকছি চলে আসবে। হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়বে সারা দেশেই। দুপুর থেকেই রোদ দেখা যাবে। তাপমাত্রা ক্রমশ কমবে। বাড়বে শীতের অনুভূতি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি- এই দুই মাসে দেশে ২ থেকে ৭টি মৃদু (তাপমাত্রা ৮-১০ ডিগ্রি) থেকে মাঝারি (৬-৮ ডিগ্রি) শৈত্যপ্রবাহও বয়ে যেতে পারে। তবে উত্তর-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে ৩টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহে (৪-৬ ডিগ্রি) রূপ নিতে পারে।
এবারের শীতে এল নিনোর উত্তাপ কতটা
এ বছর আবহাওয়ার একটি বিশেষ ধরন এল নিনো সক্রিয় থাকায় শীত মৌসুমে অন্যান্য বছরের তুলনায় তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। কিন্তু সেটা ঠিক কতটা বা কত ডিগ্রি বেশি থাকতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলে জানান আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এল নিনোর কারণে বিশ্বের আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ থাকে। এর অর্থ এই নয় যে, এবার তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকবে বা শীতের অনুভূতি অনেক কম হবে। মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এল নিনোর প্রভাবে তাপমাত্রা কতটুকু বেশি থাকতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী আমরা এতটুকু বলতে পারি যে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকতে পারে।’
অন্যদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত (নভেম্বর) মাসে সারা দেশের গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি বেশি ছিল। চলতি (ডিসেম্বর) ও আগামী জানুয়ারি মাসেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে। আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার চলতি বছরের নভেম্বরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। এবার শীতেও তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি থাকবে। এর মূল কারণ অবশ্যই এল নিনো।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর মাসের স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬.৪ ও স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জানুয়ারি মাসের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ ২৫.২ ও সর্বনিম্ন ১২.৫ এবং ফেব্রুয়ারি মাসের স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৭.৮ ও স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন