এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ৩০ জুন। ঠিক একই সময়ে কোটা পদ্ধতি পুনরায় বহালে শিক্ষার্থীদের মনে দানা বাঁধছিল ক্ষোভ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক এ আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের নিপীড়ন ও পুলিশের নির্মমতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হলেও কিছু দিনের মধ্যেই তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। অসংখ্য এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষার্থীও আন্দোলনে মাঠে নেমে পড়েন। অনেকে শহীদ হন। কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান, কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আহত হয়ে এখনো অনেকে চিকিৎসাধীন।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। এরপরই সামনে আসছে ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া অনেক পরীক্ষার্থীর ফলাফল। অনেকে চমকপ্রদ ফলও করেছেন। সন্তানহারা বাবা-মা এখন এ ফল পেয়ে আরও বেদনাকাতর হয়ে পড়ছেন। সহপাঠী, শিক্ষক, শুভাকাঙ্ক্ষীরাও আহাজারি করছেন।
শেরপুরের শহীদ সবুজের ফল হাতে মায়ের আহাজারি
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার মেধাবী শিক্ষার্থী সবুজ মিয়া। শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র হলে তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন সবুজ। ৪ আগস্ট সরকার পতনের ঠিক একদিন আগে, পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সবুজ মিয়া। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, সবুজ মিয়া ৪.৩৩ জিপিএ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
তার এমন ফলাফল যেন মা-বাবার বুকে গোলা হয়ে বিঁধছে। সবার মধ্যে হাহাকার। সবুজের শিক্ষক, সহপাঠী, স্বজনদের মনে আনন্দের বদলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এইচএসসিতে সবুজের ফলাফলের একটি কপি তার মা শমেজা খাতুনের হাতে পৌঁছে দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তা নিয়ে আহাজারি করছেন ছেলেহারা মা।
শমেজা খাতুন বলেন, ছেলে আজ বেঁচে থাকলে রেজাল্টটা নিয়ে আমার কাছে আসতো সবার আগে। সবাইকে খুশিতে মিষ্টি খাওয়াতো। আজ আমার ছেলে নাই। সবই অন্ধকার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে লক্ষ্মীপুরে প্রথম শহীদ হন সাদ আল আফনান। ৪ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেধাবী এ তরুণ। লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন আফনান। চারটি বিষয়ের পরীক্ষাও দেন। প্রকাশিত ফলাফলে আফনান জিপিএ-৪.১৭ পেয়ে পাস করেছেন।
ছেলের এমন ফলাফল জেনে আফনানের মা নাছিমা আক্তার আরও বেদনাকাতর হয়ে পড়েছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছেলে আমার পাস করেছে, এটা তো খুশির খবর। কিন্তু এ খুশি আমি উদযাপন করবো কার সঙ্গে? আফনানের মায়ের এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না সহপাঠীরাও।
আফনানের কলেজের অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ বলেন, আফনান ভালো ফল করেছে। এটা আনন্দের। কিন্তু সেই তো আমাদের মাঝে নেই। তার ফলাফল শুনে আনন্দিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। আমাদের মন ভারাক্রান্ত।
পুলিশের গুলিতে নিহত নাফিসা পেয়েছে জিপিএ-৪.২৫
বাবা-মা বাধা দেবেন, এজন্য বাসায় না জানিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়েছিলেন নাফিসা আক্তার মারওয়া। শেখ হাসিনার পতনের শেষ দিনগুলোতে রাজপথে সম্মুখভাগে থেকে আন্দোলন করেছেন। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে থানা রোডে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন এ শিক্ষার্থী।
এইচএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে নাফিসা জিপিএ-৪.২৫ পেয়ে পাস করেছেন। মেয়ের ফল জানার পর অঝোরে কাঁদছেন চা দোকানি বাবা আবুল হোসেন। তিনি বলেন, মেয়ের যাতে লেখাপড়া নষ্ট না হয়, সে জন্য রান্না করতে দিতাম না। চায়ের দোকান দিয়ে যা দুই টাকা উপার্জন করেছি, মারওয়ার লেখাপড়ায় দিয়েছি। আজ ওর ফল প্রকাশ হলো, কিন্তু মেয়েটা আমার নেই।
যাত্রাবাড়ীর রণক্ষেত্রে শহীদ পান্থও পাস করেছেন
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। সেখানে আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন মাহাদী হাসান পান্থ। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় পান্থ জিপিএ-৩.১৭ পেয়ে পাস করেছেন। পান্থ গত ১৯ জুলাই রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হন। সেদিন সন্ধ্যাতেই তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কুমড়াশাসন উত্তরপাড়া গ্রামের মেধাবী তরুণ শাহরিয়ার বিন মতিন। ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। কর্মসূত্রে তার মা থাকতেন ঢাকায়।
পরীক্ষা স্থগিত থাকায় মায়ের কাছে চলে আসেন শাহরিয়ার। যোগ দেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে। গত ১৮ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বরের গোলচত্বরে গুলিবিদ্ধ হন শাহরিয়ার। তার ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে মাথা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
শাহরিয়ার এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। খুশির এ সংবাদই বিষাদে পরিণত হয়েছে পরিবার, স্বজন ও সহপাঠীদের মনে। বর্তমানে শাহরিয়ারের বাবা-মা ও বোন সৌদি আরবে। সেখানে ওমরাহ করতে গেছেন তারা। সৌদি থেকে নিহত ছেলের ফলাফল জেনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বাবা আব্দুল মতিন।
আর ভাতিজার ফলাফলের কপি হাতে নিয়ে শাহরিয়ারের চাচা মোতালেব মিয়া বলেন, ভাতিজা আমার মেধাবী ছিল। দুই মাস আগে ও দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আজ ওর ফলাফল জানার পর থেকে কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে।
বাড্ডায় নিহত রায়হানের ফল পেয়ে কাঁদছেন বাবা-মা
নোয়াখালী সদরের বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেন। রাজধানীর বাড্ডায় একটি বাড়িতে কেয়ারটেকার পদে চাকরি করেন। নিজের কাছে ছেলে রায়হানকে রাখতেন। ভর্তি করে দিয়েছিলেন গুলশান কমার্স কলেজে। গত ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে বাড্ডায় মারা যান রায়হান।
আজ তার এইচএসসির ফল প্রকাশ হয়েছে, তাতে ২.৯২ জিপিএ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ছেলে নিহত হওয়ার পরই কেয়ারটেকার পদে চাকরি করা বাবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে। ছেলে পাস করার খবর জানার পর বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে বলে জানান মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, রায়হানকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উপরের কয়েকজন ছাড়া আরও অসংখ্য এইচএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হন। প্রকাশিত ফলাফলে তারা পাস করেছেন। অনেকে চমকপ্রদ ফলাফলও করেছেন। তাদের তথ্য ফেসবুকে শেয়ার করে নেটিজেনরা আবেগঘন পোস্ট দিচ্ছেন। তাছাড়া চোখ হারানো, পঙ্গুত্ব বরণ করা অনেক শিক্ষার্থীও এবার এইচএসসি পাস করেছেন। ভালো ফল করলেও জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় সময় পার করছেন তারা। মন ভালো নেই তাদের স্বজনদেরও।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন