বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরই চাঙ্গা হতে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। কেবলমাত্র ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব ছাত্র সংগঠনই নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছে। কারণ, আওয়ামী লীগের হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে রাজনীতির মাঠে নেই ছাত্রলীগ। এরই মধ্যে তাদের বেশিরভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। ফলে বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির মাঠ বিএনপির সহযোগী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও জামায়াতের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরে দখলে।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের মিথস্ক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম পরিবেশ পরিষদে ১৯৯০ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির ও জাতীয় ছাত্রসমাজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে না দেওয়ার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল। এর পর থেকে ঢাবিতে শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেনি। মাঝে-মধ্যে ঝটিকা মিছিল করে আবার আত্মগোপনে চলে যেত। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতে তারা ঢাবির ছাত্র রাজনীতিতে প্রকাশ্যে এসেছে। এরই মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ- ঢাবিতে কি তারা এই ১৪ জন দিয়েই রাজনীতি করে, নাকি রয়েছে আরও অনেক নেতাকর্মী? ঢাবিতে ছাত্রশিবিরের আরও কোনো কমিটি আছে কি না- সেটাও জানতে চায় তারা।
শিবিরের একটা সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ৩৪টি বিভাগে কমিটি রয়েছে। সভাপতি ও সেক্রেটারি জেনারেল ছাড়া বাকি পদগুলো হলো- সাংগঠনিক সম্পাদক, অফিস সম্পাদক, শিক্ষা সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক, প্রকাশনা সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক, বায়তুল মাল সম্পাদক, গবেষণা সম্পাদক, আইটি সম্পাদক, কোচিং সম্পাদক, আন্তর্জাতিক সম্পাদক, বিতর্ক সম্পাদক, মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক, অঞ্চল পরিচালক, অনুষদের সভাপতি, হল সভাপতি, হল সেক্রেটারি, ইনস্টিটিউট পরিচালক, উপশাখা পরিচালক ইত্যাদি।
কিন্তু তারা সম্প্রতি যে কমিটিটি প্রকাশ করেছে সেখান স্থান পেয়েছে শুধুমাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী। বাকিরা কখন সামনে আসবে?- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কমিটির প্রয়োজনে তারা যেকোনো সময় সাংগঠনিক কার্যক্রমে সামনে আসবে।’
আরেক সূত্র জানায়, ছাত্রশিবিরের কমিটিতে স্থান পাওয়া পদ-পদবি ছাড়াও কর্মী, সাথী, সদস্য ও সমর্থকসহ নানা স্তর থাকে। এই স্তরের সদস্যদের মাসিক তথ্য সংগ্রহের পর তাদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়। ফলে একসঙ্গে সবাইকে প্রকাশ্যে আসতে দেখা যাবে না।
নারী নেতৃত্ব নেই শিবিরে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম-ডান প্রতিটি ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে নারীদের অবস্থান দেখে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো নারীকে ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম কিংবা কমিটিতে দেখা যায়নি। ফলে শিবিরের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের একটা সংকট আছে। এ বিষয়ে ঢাবি শিক্ষার্থী সীমা আকতার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ছাত্রশিবিরের কমিটি দেখেছি। কিন্তু সেখানে কোনো নারীর স্থান হয়নি। যারা শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি করবে তারা যদি নারী নেতৃত্বে জোর না দেয়, তাহলে কীভাবে নারীদের অধিকার নিশ্চিত করবে?’
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এস এম ফরহাদ বলেন, ‘আমরা নারীদের স্বাধীন প্ল্যাটফর্মে বিশ্বাসী। যেখানে নারীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের অধিকার নিশ্চিতে নিজেরাই ভূমিকা রাখবে। নারীরা পুরুষের অধীনস্থ না হয়ে নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাবি ছাত্রশিবিরের এক কর্মী সারাবাংলাকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামায়াতের ‘ইসলামী ছাত্রী সংস্থা’ বলে একটি সংগঠন আছে। যারা ঢাবির হলগুলোতে তাদের কার্যক্রম চালায়।” এ প্রসঙ্গে এস এম ফরহাদ বলেন, ‘ইসলামী ছাত্রী সংস্থা একটা স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম। এ রকম অনেক স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম আছে, যেগুলো নারীদের নিয়ে কাজ করে। তবে আমাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিকভাবে এরা সম্পৃক্ত নয়।’
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যা বলছে ছাত্রশিবির
জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ফের উজ্জীবিত ছাত্রসংগঠনগুলো ও শিক্ষার্থীরা। বিগত পাঁচ বছরে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি না থাকায় ডাকসুতে একচ্ছত্র আধিপত্য করে গেছে ছাত্রলীগ। সেই আধিপত্যবাদকে কাটিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনে জয়ী হওয়ার লড়াইয়ে কাজ করছে ঢাবিতে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন হলে ছাত্রশিবির প্যানেল দেবে কি না- এ বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।
ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন তাদের অফিসিয়াল তফসিল ঘোষণা করবে তখনই আমরা আমাদের মতামত দেবো।’
ঢাবির হল নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার
জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অনেকে দাবি করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হল ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এমনকি তারাই প্রশাসনকে চাপ দিয়ে মবের সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রশিবিরের ইতিহাসই হচ্ছে গুপ্ত রাজনীতি। তারা সবসময় অ্যান্ডারগ্রাউন্ডে থেকে রাজনীতি করে এসেছে এবং করছে। কারণ, তারা জানে, প্রকাশ্যে এলে তাদের মুখোশ খুলে যাবে। তাই তারা হলগুলোতে এখনো গোপন রাজনীতি করে যাচ্ছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের এক শিক্ষার্থী সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঢাবির প্রতিটি হলে ছাত্রশিবির অবস্থান আছে। আমার পরিচিতও অনেকে শিবির করে বলে জানি। তবে তারা প্রকাশ্যে না কিছু বলেন না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম ফরহাদ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে এবং করবে। আমরা আমাদের জনশক্তিকে হলের নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কাজ থেকে বিরত রেখেছি। তবে অন্য কোনো দল যদি প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তাহলে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হল প্রশাসনকে শিবির সাহায্য করবে।’
প্রসঙ্গ ‘একাত্তর’
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করেছেন। ফলে অনেকেই তাদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলে থাকে। ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি বলেন, ‘ছাত্রশিবির এরই মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সেই ধোঁয়াশা এখন পরিষ্কার করেনি। তারা যদি বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চায়, তাহলে একাত্তর নিয়ে তাদের অবস্থানটা পরিষ্কার করতে হবে। তার পরই তারা আমাদের সঙ্গে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে।’
এ ব্যাপারে ঢাবি শিবিরের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘যে সংগঠনের জন্মই ১৯৭৭ সালে এবং সামগ্রিক কার্যক্রমও তখন থেকে, তাহলে সেটাকে কীভাবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলবেন? আর যারা এমন প্রশ্ন করছে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের হেয় করতে চায়।’
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যা ভাবছে ছাত্রশিবির
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল পলিসি ও গুণগত মানের বিষয়টি চিন্তা করে নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সেই জায়গায় পিছিয়ে নেই ছাত্রসংগঠনগুলোও। ছাত্রশিবিরের কর্মপরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে জানতে চাইলে এস এম ফরহাদ বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্যেই হলো শিক্ষার্থীদের সেবা ও তাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করা। অধিকারে ঘাটতি দেখা দিলে দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করা ও সেটা নিয়ে কাজ করাই ছাত্ররাজনীতি। এ ছাড়া প্রয়োজনে তারা পলিসি সাজেস্ট ও ডায়লগের আয়োজন করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি হবে আইডিয়ার কম্পিটিশন। যেখানে একটি সংগঠনের সঙ্গে অন্য আরেকটি সংগঠনের আইডিয়ার কম্পিটিশন হবে। কোনো একটা সংগঠন তাদের আইডিয়া অন্য কোনো সংগঠনের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। কেউ যদি আইডিয়া চাপিয়ে দেয়, নির্যাতন করে, হামলা করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চলেছিল তার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রসংগঠন হিসেবে সবসময় শিক্ষার্থীবান্ধব প্রোগ্রাম হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সেবা করার জন্য, ভ্যানগার্ড হওয়ার জন্য কিংবা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে কোনো প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হবে- এমন আইডিয়ার সঙ্গে আমরা পরিচালিত হব না। বরং শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে, তাদের সংকটে পাশা থাকার প্র্যাকটিসগুলো করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘হল প্রশাসন কিংবা ইউনিভার্সিটি কতৃপক্ষের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ও হল প্রশাসনসহ সব জায়গা দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। এ ছাড়া, যেসব প্রতিষ্ঠান দলীয় প্রভাবে চলছে সেগুলোকে সেখান থেকে মুক্ত করে স্বতন্ত্র পলিসি মেকিংয়ে সাহায্যের চেষ্টা করব।’
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন