একসময় আওয়ামী লীগে যোগদান করার জন্য মাহবুব-উল আলম হানিফ দলের কুষ্টিয়া জেলা সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ার আলীর পেছন পেছন ঘুরতেন। অর্থ সংকটে ছিলেন দিশাহারা। অর্থাভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার নয়াপল্টনে অবস্থিত সিটি হার্টের অফিস ভাড়া পর্যন্ত দিতে পারতেন না। সেই হানিফ গত দেড় যুগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদকে পুঁজি করে সারাদেশে তার জাল বিস্তার করে তৈরি করেন অবৈধ উপায়ে টাকা কামানোর নেটওয়ার্ক। দলীয় পদ ছাড়াও শেখ পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা এবং অঘোষিত ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ার সুবাদে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি বাগিয়ে নেন বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডার ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে হানিফ হয়ে ওঠেন দল ও সরকারের অন্যতম ক্ষমতাকেন্দ্র। সেই সুবাদে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজ রাজধানী ঢাকা ও জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও আরও অন্তত ৪টি জেলায় এবং দেশের বাইরে কানাডাসহ কয়েকটি দেশে তার সম্পদ ও ব্যবসা আছে। হাসিনার দেশত্যাগের পর
তিনি অবৈধ পথে ভারতে গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ার বালুমহল, হাট-ঘাট, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে চাঁদাবাজি, হাসপাতালে খাবার সরবরাহ, মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়া থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই, যা নিয়ন্ত্রণ করতেন না কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ। কুষ্টিয়ার এসব কাজের দায়িত্বে ছিলেন তার চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর গত ২ অক্টোবর সুপ্রিমকোটের আইনজীবী সালাউদ্দিন রিগ্যান কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ এনে তা অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হানিফের নামে থাকা সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গত ৬ অক্টোবর তার ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয়।
১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে কুষ্টিয়া-২ আসনে মনোনয়ন পান মাহবুবউল আলম হানিফ। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অর্থ সংকটে তিনি পরাজিত হন। ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফ দল থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। তবে দল ক্ষমতায় এলে তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী করা হয়।
এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে কুষ্টিয়া সদর আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। এর আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে পেয়ে যান দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মতো শীর্ষস্থানীয় পদ। এরপর হানিফকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাড়াতে থাকেন তার প্রভাব-প্রতিপত্তি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে একটি সাধারণ মানের গাড়িতে চড়লেও পরবর্তী সময়ে তিনি একাধিক দামি গাড়ি ক্রয় করেন। ঢাকায় গুলশানে তার বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, আছে বনানীতে। এ ছাড়া খুলনায় তার মাছের ঘেরের সঙ্গে আছে রিসোর্ট। জমি আছে পাবনার ঈশ্বরদী, কক্সবাজারের টেকনাফে। গাজীপুরে নির্মাণ করেছেন একাধিক রিসোর্ট।
হানিফের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল। কারওয়ানবাজারে বিএমটিসি ভবনে তার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক অফিস। মূলত হানিফের নেশা ছিল রাজনীতির আড়ালে সম্পদ অর্জন। ইউপি নির্বাচনে কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কাছে দুবার নৌকা প্রতীক বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছিলেন কয়েক কোটি টাকা। এভাবে নৌকা প্রতীক পাওয়ার কথা স্বীকার করেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আব্দালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী আরব আলী।
এ ছাড়া কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, জিকে প্রজেক্ট, হরিপুর সেতু, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সব সরকারি দপ্তরের বড় বড় প্রকল্প থেকে তিনি নিতে মোটা অঙ্কের নিতেন। প্রতিটি প্রকল্প থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন আদায় করতেন হানিফ। এভাবে গত ১৫ বছরে অগাধ সম্পদের মালিক বনে যান তিনি। হানিফের পুরো পরিবার থাকে কানাডায়, সেখানে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে তার।
জানা গেছে, শহরের বহুতল বিপণিবিতান পরিমল টাওয়ারে কোটি টাকা দামের দুটি দোকান আছে তার। সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। শহরের হাউজিংয়ে হানিফ পরিবারের ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০ তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা সলেমান শেখ জানান, হাউজিংয়ে জমির সঙ্গে স্থানীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। এসব ফ্ল্যাট সজ্জিত করতে দেশের বাইওে থেকে টাইলসসহ ফিটিংসের মালামাল আনা হয়। পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন হানিফ। খেলার মাঠের পাশে দোতলা নতুন মার্কেটে আটটি দোকান আছে তার। জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় তার ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হানিফ দলীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সারাদেশে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। তার নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতি ড্রেজারের দাম ৩০ কোটি টাকার বেশি বলে জানা গেছে। কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদী শাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকার অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কব্জায় নিয়ে নেন, যা পরে বিক্রি করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
ব্যবসা ও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ : হানিফ কুষ্টিয়ার রাজনীতি ছাড়াও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি স্কুল কমিটির সভাপতি কে হবে সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন হানিফ। কুষ্টিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে হানিফের লোকজন গড়ে তুলে সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়। সিন্ডিকেটর অন্যতম সদস্য হলেন দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরের রশিদ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক আব্দুর রশিদ। তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ চাল ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি। হানিফ তাকে দিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। ফলে দেশের চালের বাজারে সৃষ্টি হতো অস্থিরতা। রশিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে গেলেই বাদ সাধতেন হানিফ।
কুষ্টিয়া শহরের ফোর লেন সড়ক নির্মাণ কাজের একটি প্যাকেজ পায় হানিফের ব্যবসায়িক অংশীদার স্পেকট্রা লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পে গত ৪ বছরে শত শত কোটি কোটি টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে।
শুধু লুটপাট নয়Ñ বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দল এবং নিজ দলের প্রতিপক্ষ নেতাকর্মীদের প্রতি দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগও রয়েছে হানিফের বিরুদ্ধে। জেলা যুবদল নেতা আল আমিন রানা অভিযোগ করেন, গত সংসদ নির্বাচনের সময় তাকে ডাকা হলে তিনি হানিফের কাছে যেতে রাজি হননি। এ বারণে তার বাড়ির ওপর মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্তা করা হয়। তিনি বলেন, ‘তখন আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। এখন আমি ব্রেন স্ট্রোকের রোগী। হানিফ ও আতার চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির বিরোধিতা করার কারণে তাদের চরম রোষানলে পড়েন কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জনপ্রিয় তরুণ নেতা সাজ্জাদ হোসেন সবুজ (৪০)। ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে গুলি করা হলে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও সেদিন সবুজ (২৩) নামে এক যুবক নিহত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, হানিফ-আতা এই দুই ভাইয়ের কারণে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। একক আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুতি হয়েছিল। তাদের কারণে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের মতো এত বড় সংগঠনের আজ চরম দুর্দিন।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য মাহবুবউল আলম হানিফ ও আতার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও দুজনের ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন