মন্ত্রিসভা থেকে ঠিক কী কারণে পদত্যাগ করেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ? সেটি এখনো অনেকের কাছে অজানা। রাজনৈতিক পরিবারের এই সদস্য অনেক আগ্রহ নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। গাজীপুর-কাপাসিয়া থেকে ২০০১ সালে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির মধ্যে ৫৮ আসনের একটিও তার ছিল। পরবর্তীতে ১/১১ এর পর ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। কিন্তু বেশি দিন তিনি দায়িত্ব পালন করেননি। স্বেচ্ছায় দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কেন পদত্যাগ করেছিলেন তা স্পষ্ট করেননি সোহেল তাজ। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মানবজমিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। খোলাসা করেছেন পদত্যাগের নেপথ্য কারণ। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করায় ক্ষোভে ও অভিমানে পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন সোহেল তাজ।
প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম না বললেও তখন আলোচনা ছিল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম পুলিশের বদলিসহ সব নিয়ন্ত্রণ করতেন যা মেনে নিতে পারেননি সোহেল তাজ। শেখ সেলিম তখন সরকারের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সোহেল তাজ এমনই ইঙ্গিত দেন।
তার ভাষায় সরকারের ৯০ ভাগ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত হতো শেখ হাসিনার লোকদের দ্বারা। মন্ত্রণালয়গুলো চলতো ম্যাজিক্যালি। সোহেল তাজ বলেন, ১৫ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের এখন যে পরিস্থিতি হয়েছে মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার সময়ই তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। সোহেল তাজ জানান, তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অথচ তার নির্দেশ পালন করতেন না সচিবরা। তাদেরকে বলা হয়েছিল সোহেল তাজের কথা না শোনার জন্য। তার অজান্তেই এসপি বদলি হয়ে যেত। পরে তিনি বাধ্য হয়েই পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পর দৃশ্যপট অন্যদিকে যায়। তাকে জীবন-মরণ লড়াই করতে হয়। বিভিন্নভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়। তার ভাগ্নেকে পর্যন্ত গুম করা হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব পেয়ে ওই বছরের মে মাসে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালের ২৩শে এপ্রিল তিনি এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ওই সময় তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করায় ৭ই জুলাই তিনি আবার পদত্যাগপত্র দিলে সেটি গ্রহণ করা হয়।
সোহেল তাজ বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাই। আমি খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে। আমার ইচ্ছা ছিল দেশটাকে একটি সুন্দর, প্রগতিশীল উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। তার মানে আমি এটাও জানি আমাকে কী করতে হবে? সিস্টেমিক চেঞ্জ করতে হবে। সিস্টেমিক চেঞ্জ করতে চেয়েছিলাম আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনীতি ও দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। যাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য কাজ করে। আওয়ামী লীগ এরকমই একটা ইশতেহার দিয়েছিল যেটি আমাকে সাংঘাতিকভাবে উৎসাহিত করে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল নির্বাচন কমিশন। একদম একটা স্বাধীন নির্বাচন কমিশন হবে। যেখানে কোনো ভোটের কারচুপি হবে না। আপনার ভোট আমার ভোট স্বদিচ্ছায় দিতে পারবো। এমনই একটা বাংলাদেশ হবে। এরকম একটা চিন্তা নিয়ে আমি মনে-প্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, নতুন একটা বাংলাদেশ বিনির্মাণে। তিনি বলেন, যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চেঞ্জ, মজবুত ও রিফর্ম করতে চাই তাহলে এনসিউর করতে হবে সুশাসন ও গুড গভর্নেন্স। আমরা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করবো গুড গভর্নেন্সের মাধ্যমে। সুশাসনের পূর্বশর্ত আইনের শাসন। যে সমাজে জাস্টিস থাকবে না সেখানে আপনি কখনো সুশাসন কায়েম করতে পারবেন না। আপনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান তবে দেখতে হবে আইনগুলো প্রয়োগ করছে কে। হাতিয়ারটা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই রিফর্ম করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আগে ডি পলিটিসাইজ করতে হবে বাহিনীগুলোকে। তাদেরকে একটি পেশাদার, শৃঙ্খলা ও জনগণের বন্ধু বানাতে হবে। আমি সেদিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম। আমার চিন্তা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে। তাদেরকে সঠিকভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুর্নীতি দূর করতে হবে। দুর্নীতির ক্যান্সার সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি ঠিক করতে না পারলে অনিয়ম ঠিক করা যায় না। করাপশন কলাপস এভরিথিং। করাপশনকে থামাতে হলে লাগবে একটি দক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমি এসব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখি আমি একাই এটা চেয়েছি। একা চাওয়ার কারণে এটা সম্ভব হয়নি। বরং উল্টো আমাকেই ভিকটিমাইজ করা হতো। আমি যখন পদত্যাগ করেছিলাম তখন অনেক মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছে।
সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর একটা মিটিং ডেকে ছিলাম। আইজিপি, এসবি প্রধান, র্যাব প্রধান, ডিবি প্রধান এবং সকল সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। আমি তাদেরকে স্পষ্ট করে বলেছিলাম বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য এখন থেকে বন্ধ। এখানে কোনো ব্যবসা চলবে না। আমি যতদিন থাকবো ততদিন এটা অ্যালাও করবো না। এটা শুধু পুলিশের মধ্যে না। এই লিংকেজটা অনেক উপরের দিকে যায়। এখানে অনেক অদৃশ্য শক্তি আছে যারা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক ক্ষেত্রে আমার অজান্তেই একটা অদৃশ্য শক্তি কাজ করে নেয়। এসপি বদলি হয়ে যায় অথচ আমি নিজেই জানতাম না। এ ধরনের ঘটনা যখনই ঘটতে লাগলো তখন আমি মনে করলাম এখানে একটা পদ নিয়ে বসে থাকার মানে হয় না। আমি বলেছিলাম পুলিশকে রিফর্ম করতে হলে তাদের বেসিক চাহিদাগুলো আমাদের পূরণ করতে হবে। তাদেরকে মধ্যবিত্ত স্ট্যাটাসে রাখতে হবে যাতে তাদের পরিবার স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে। তাদের যাতে কোনো চাহিদা না থাকে। পরে আমরা তাদের কাছে ডিমান্ড করবো আপনাদেরকে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। ঘটনা আরও আছে। মন্ত্রণালয়গুলো ম্যাজিকেলি চলতো। ৯০ শতাংশ মন্ত্রী জানেন না তাদের মন্ত্রণালয় কীভাবে চলছে।
উপর মহল বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, উপর মহল হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক কালচারে যা হয়ে এসেছে। যারা দলীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আছেন। এ ছাড়া যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক কালচার হচ্ছে পরিবারতান্ত্রিক। এখানে অনেক পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। যারা কলকাঠি নেড়েছেন। মন্ত্রীরা অনেক ক্ষেত্রে জানতেন না কী হচ্ছে তাদের মন্ত্রণালয়ে। সচিবদের ম্যানেজ করে কন্ট্রোল করা হতো। আমি আমার মন্ত্রণালয়ে অনেক নির্দেশ দিতাম কিন্তু সেগুলো দেখতাম হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? পরবর্তীতে আমি জানতে পারলাম বলা হয়েছে আমার কথা না শোনার জন্য। আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম জনগণকে সার্ভ করার জন্য। এমন হলে কেন থাকবো আমি? আমি তো এখানে টাকা বানাবার জন্য আসিনি। তো কেন আমি এই সিটে থাকবো।
পদত্যাগের সুনির্দিষ্ট কি কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সিরিজ অব ইভেন্টস। একটার পর একটা ঘটনা জমতে জমতে তখন যা হয়। আমি একটা টাইমফ্রেম হাতে রেখেছিলাম আগেই। আমরা যদি সঠিক পথে যাই তার চিহ্ন প্রথম ৬ মাসেই পেয়ে যাবো। আপনি কোন ডিরেকশনে যাবেন সেটার ম্যাপিং করতে হবে না? তাহলেই তো ব্লুপ্রিন্টটা চলে আসবে। বলা হচ্ছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এক ব্যক্তির সঙ্গে আপনার ঝামেলা হয়েছিল? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে অন্যভাবে জিনিসগুলো এসেছে। কিন্তু আমাকে কেউ মারবে আর সে বাসায় বসে থাকবে- এটা হতে পারে না। আমার গায়ে টাচ্ করলে হাসপাতালে যাবে সে। এখানে মারধরের কোনো বিষয় ছিল না। এখানে বিষয়গুলো ছিল আরও সূক্ষ্ম। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্যে আঘাত পড়েছে। কারণ তারা যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে কাজগুলো করতে পারেনি। এজন্যই তারা পদত্যাগের পর মিষ্টি বিতরণ করেছিল। কারা মিষ্টি বিতরণ করেছে এবং কারা কলকাঠি নাড়তো? শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ওনার পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। যাদের কোনো সরকারি পজিশন না থাকা সত্ত্বেও হস্তক্ষেপ করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। বিভিন্ন এজেন্সির উপর তারা প্রভাব বিস্তার করতেন। পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও হস্তক্ষেপ ফিল করেছি। যতটুকু পেরেছি আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছি।
১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসন ও ৫ই আগস্ট মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নিয়ে সোহেল তাজ বলেন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিল। ছাত্র সংগঠন ও পুলিশ দিয়ে তাদেরকে বেধড়কভাবে পেটানো হয়েছিল রাস্তায়। তখন কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। তখন আমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা ছিল এমন-একটা পাতিলের মধ্যে পানি ফুটছে। নিচে আগুন জ্বলছে। আমি বলেছিলাম ঢাকনাটা যদি চাপ দিয়ে রাখা হয় তবে একদিন বিস্ফোরণ হবে। ১৫ বছর এই ঢাকনাটাকে চাপা দিয়ে রাখার বহিঃপ্রকাশ পেয়েছি ৫ই আগস্ট। এটা হচ্ছে ২০১৪ সালের নির্বাচন, হত্যা, গুম, নির্যাতন, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতনের কারণে। আমরা দেখেছি খালেদা জিয়াকে যেটা করা হয়েছে যেটা আমি একেবারেই সমর্থন করি না। এটা অন্যায় হয়েছে; অবিচার হয়েছে। আমার বিবেক বলে আমি গিয়ে ওনার কাছে সরি বলবো। এটা হওয়া উচিত হয়নি। তার একটি সন্তান মারা গিয়েছে। তার বাসার সামনে ট্রাক নিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলো জঘন্য নিকৃষ্ট কাজ। এগুলো কেন করবো? এটাতো আমাদের পলিটিক্যাল কালচার হওয়ার কথা না। একটি ডেমোক্রেসির ভেন্টিং প্রসেস হচ্ছে নির্বাচন। আপনি একটা টার্ম আসবেন মানুষ আপনাকে পছন্দ করবে না। তারা ফুঁসে উঠবে। ভোটের মাধ্যমে আপনাকে আউট করবে। আপনি ওই পথটাকে বন্ধ করে দিলেন। একের পর এক নির্বাচন আপনি করলেন। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে দ্রব্যমূল্য। দ্বিগুণ-তিনগুণ-চারগুণ দাম। মানুষ দিশাহারা। এটা হচ্ছে গান পাউডার কেক। ওটার ফিউজটা ছাত্ররা জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরণটার জন্য রেডি ছিল। আপনি মানুষের ওপর বোঝা দিতে দিতে শেষমেশ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
দায়টা আওয়ামী লীগের না সরকার প্রধানের ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল তাজ বলেন, এখানে একটা সমস্যা আছে দল ও সরকারকে আমরা একাকার করে ফেলি। গণতন্ত্র এভাবে চলে না। রাষ্ট্র, সরকার, দল আলাদা আলাদা বিষয়। আমাদের পলিটিক্যাল পার্টির মধ্যে কোনো ডেমোক্রেসি নাই। সরকারে এসে আপনি ডেমোক্রেসি চর্চা করবেন কীভাবে? দলের ভেতর ডেমোক্রেসি নাই অথচ বলছেন অন্যদের ডেমোক্রেসি দিবেন। দলের ভেতরে লিডারশিপটা রিজার্ভ করে রাখা হয়েছে। আপনি চাইলে সেখানে উঠতে পারবেন না। আপনার জন্য একটা সীমানা দেয়া হয়েছে আপনি এর উপরে উঠতে পারবেন না। এটা হচ্ছে প্রধান সমস্যা। তিনি বলেন, দলের কাজটা ছিল তারা প্রান্তিক লেবেলে জনগণের পালসটা বুঝবে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকবে। জনগণের মনের কথা বুঝবে। সেই কথাগুলো তুলে ধরবে দলীয় প্ল্যাটফরমে। দলীয় প্ল্যাটফরম সেগুলো অনুধাবন করবে বোঝার চেষ্টা করবে। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার রিফ্লেকশন হবে দলের পলিসিতে। সেই দল যদি ক্ষমতায় যেতে পারে তবে রিফ্লেকশন আসবে সরকারের কার্যক্রমের উপরে। কিন্তু এসব চর্চা আমরা দেখতে পারছি না। সরকারের সমালোচনা করলে বলা হবে রাষ্ট্রবিরোধী। তিনি বলেন, কারও কথা বলার অধিকার নাই। আইন করে করে মানুষের মুখ বন্ধ করে রাখছেন। ৫ই আগস্ট অনিবার্য ছিল। এটাতো হওয়ার কথা ছিল।
ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদের শাস্তির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শত শত নিরীহ মানুষ, ছাত্র-ভাইবোনদের হত্যা করা হলো। আবু সাঈদ, মুগ্ধ থেকে শুরু করে চার বছরের শিশুকে মারা হলো। আমরা নিজের চোখে দেখেছি। এটার বিচার করতে হবে না? এটা কি করে সম্ভব। একবিংশ শতাব্দীতে নিজের দেশের মানুষকে জঘন্য একটি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যা করা হলো। তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘটনার সঠিক সুস্পষ্ট তদন্ত করতে হবে।
এত কিছুর পরেও কী মনে করেন আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে পারবে? সোহেল তাজ বলেন, আত্মসমালোচনা নাই, অনুশোচনা নাই, কোনো উপলব্ধি নাই যে দলের তারা কোথায় ফিরবে? যেটা করেছি, যেটাকে সমর্থন দিয়েছি এটা আনএথিকেল, ক্রিমিনাল কাজ। দেখতে পাচ্ছেন কোনো আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা। তাহলে আওয়ামী লীগ কোথায় আসবে। এখানে জনগণ এবং নতুন প্রজন্মের ভেতরে কি চলছে সেটা বুঝতে হবে না? মানুষ কি চায় সেটা বুঝতে হবে না? আপনি লুটপাট করে লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে দিবেন বিদেশে, আরাম আয়েশে থাকবেন। এটাতো জনগণ চায় না। তিনি বলেন, তাজউদ্দীন আহমেদের পরিবারের সদস্যদের সময়ে সময়ে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৯ সালে যখন আমি রিজাইন করেছিলাম তখন বলেছিলাম আর ঢাল হবো না। জাতীয় চার নেতার অবদান ছিল মুক্তিযুদ্ধে। তাদেরকে অবমূল্যায়ন অবহেলা করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ওনাকে রাজাকার বানানো হয়েছে। যারাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে তাদের জীবনী জানতে নতুন প্রজন্ম ডিজার্ব করে। যাতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে পারে। আমি চাই না আমার বাবার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে আমি কিছু করবো। আমার দাবি ছিল- জেলহত্যা দিবস, মুক্তিযুদ্ধে যারা অবদান রেখেছে ও মুজিবনগর সরকারকে স্মরণ করে ওই দিনটাকে রিপাবলিক ডে ঘোষণা করা।
ফেসবুকে নৃশংস ছবি ও ভিডিও ভাসছে যেগুলো খুবই হৃদয়বিদারক, আপনি বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন? এ নিয়ে সোহেল তাজ বলেন, গুলি করে মারার দৃশ্য দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। ছাত্রবাহিনীদের নামিয়ে দেয়া হলো। পুলিশ নামানো হলো। শুরুটা এমনই ছিল। তারপর দেখলাম আবু সাঈদকে গুলি করে মেরে দিলো। আমি ছটপট করেছি এগুলো দেখে। আমার একটা লিমিটেশন আছে। কিন্তু আমি সেটি মানিনি। আমি ১৮ তারিখে একটা পোস্ট দিয়েছি। যেখানে আমার দলের তো দূরের কথা কেউ সাহসই করে নাই। আমি পুলিশের গুলি নিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। কারফিউ শুরু হলো। আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবিতে নেয়া হলো। বলা হলো- সেইফ কাস্টডিতে নেয়া হয়েছে এবং তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। আমি গিয়েছিলাম ডিবি অফিসে তারা গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা সেটা জানতে। যদি গ্রেপ্তার হয় তবে অ্যানি স্টেটমেন্ট গিভেন ইজ নট ভেলিড। আর সেইফ কাস্টডি যদি হয় তাহলে তাদের চাইতে হবে। না চাইলে এটা এরেস্ট। আমি তখন বলেছিলাম আমার বিবেকের কারণে গিয়েছিলাম। কারণ আমি জানি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীতে আমার অনেক ভক্ত আছে। আমি তাদের কাছে আপিল করেছি আর গুলি চালাবেন না। ১০ জনকেও যদি থামাতে পারি তাহলে দশটা গুলি কম যাবে।
পদত্যাগের পর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দাবি করে সোহেল তাজ বলেন, ২০১৩ সালে আমার ভাগ্নে মেজো বোনের ছেলেকে ধরে নিয়ে পুলিশ নির্যাতন করলো। বেধড়ক পেটালো। দুলাভাই যখন থানাতে গেল তখন আরেক রুম থেকে শুনলো এই যে সোহেল তাজের ভাগিনাকে পেয়েছি একদম বানাই দিতেছি। আমার ভাগ্নে সৌরভকে গুম করে নিয়ে আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। ব্যক্তিগত হিংসার কারণে এই ঘটনাটা ঘটে। কিন্তু সেটার মধ্যদিয়েও বের হয়েছে রাষ্ট্রের মেশিনারিকে ব্যবহার করছেন ব্যক্তিগত বিষয়ে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান, রাজনৈতিক দলের চাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। মানুষের ১৫/১৬ বছরের কষ্টের বিস্ফোরণ হয়েছে। মানুষ চায় দুর্নীতিমুক্ত একটা সমাজ যেখানে অনিয়ম থাকবে না। মেধাই হবে সবকিছু্র মাপকাঠি। বৈষম্যহীন সমাজ। এটার জন্য সিস্টেমিক চেইঞ্জ লাগবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রিফর্ম করে মজবুত করতে হবে। শক্ত পিলার করতে হবে। তবে এটা রাতারাতি করা সম্ভব নয়। জনগণ এই সরকারকে ম্যান্ডেট দিয়েছে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে এটা ঠিক করার জন্য। এখন সেটা ঠিক করতে যতটুকু সময় দরকার ততটুকু সময় নেয়া দরকার। তাড়াহুড়া করার দরকার নাই। অনেকে বলবে এটা ডেমোক্রেটিকিলি ইলেকট্রেড না। আমি মনে করি এটাই ইলেকট্রেড। তিনি বলেন, মানুষের অধিকার আছে নতুন কিছু চাওয়ার, কিছু পাওয়ার। আমি রাজনৈতিক দলকে বলবো একটু ধৈর্য ধরার জন্য। সিস্টেমেটিকভাবে সবকিছু পরিবর্তন হোক। নির্বাচন কমিশনকে কেউ ইনফ্লুয়েন্স করতে পারবে না। টাকা দিয়েও পারবে না। বলপ্রয়োগ করেও পারবে না। এমন একটা পুলিশ প্রশাসন হোক কেউ ইনফ্লুয়েন্স করতে পারবে না। তারা শুধু আইন প্রয়োগ করে। প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত হোক। যেখানে প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি করতে পারবে না। তিনি বলেন, এই যে করাপটেড, নোংরা, নষ্ট, পচা রাজনৈতিক সংস্কৃতি এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বিএনপি থেকে সিনিয়র নেতারা বার বার আহ্বান করছেন অনিয়ম থেকে দূরে থাকার জন্য। আমি তাদেরকে বলবো আপনারা আরও শক্ত হয়ে বলেন। কারণ এটা আপনাদের পার্টির ইমেজটাকে নষ্ট করে দিবে। আপনারা প্রমাণ করেন আপনারা গণতন্ত্রের পক্ষে। মুদ্রার এপিট-ওপিট নন। রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই নোংরা, পচা রাজনীতির মধ্যে আসবো না। কিন্তু এই কালচারটাকে যারা পরিবর্তন করতে চায় তাদেরকে পূর্ণ সমর্থন দিবো। কারণ ছাত্ররা যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছে তার সঙ্গে হবহু মিলে যায় আমার চিন্তা-চেতনা। এটাই আমি চেয়েছিলাম। এজন্য আমি রাজনীতি করতে এসেছিলাম। আমি মনে করি এটাই রাজনীতির মূলমন্ত্র।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন