নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনায় নবগঠিত ‘সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী’ সরকার মহাজোট সরকারের নতুন সংস্করণ বলে বিরোধীদলীয় জোটের উত্থাপিত অভিযোগ খণ্ডানো এবং চলমান সংকট নিয়ে জাতিসংঘ, মার্কিন কংগ্রেস, ইউরোপীয় পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন দেশের উদ্বেগ প্রশমনে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে নতুন করে সংলাপ আয়োজনের তৎপরতা শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপে বসতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত যদি দুই দলের সমঝোতা হয় তাহলে বিএনপিকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে সর্বদলীয় সরকারের অধীনেই আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সমঝাতা না হলে অপবাদ ঘোচানোর বিকল্প পথও করে রেখেছে সরকার। এক্ষেত্রে মহাজোটের বাইরে থাকা ছোট দলগুলো এবং ১৮ দলীয় জোটের অংশীদারদের ভাগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন ‘কোয়ালিশন সরকার’ গঠন করা হবে। খুব শিগগিরই ১৮ দলীয় জোট ছেড়ে এসব দল মহাজোট অথবা এরশাদের নেতৃত্বাধীন নতুন জোটে যোগ দেয়ার পাশাপাশি কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেবে। এছাড়া সদ্য নিবন্ধনপ্রাপ্ত বিএনএফের ব্যানারে বিএনপির দলত্যাগী অনেক নেতাও নবগঠিত এ মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেতে পারেন। আগামী ৩ দিনের মধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকারের চূড়ান্ত রূপরেখা ও পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভার তালিকা প্রকাশ পাবে। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের নাম ‘সর্বদলীয়’ নাকি ‘কোয়ালিশন’ সরকার হবে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনকালীন কোয়ালিশন সরকার গঠনের চিন্তাধারা সরকারি দলের নতুন কিছু নয়। এর আগেও নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯১ সালে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু জামায়াত রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এবারো এমনটি করার কথাই ভাবা হচ্ছে। তবে এবার নির্বাচন পরবর্তী নয়, নির্বাচনকালীন এ সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সংবিধান সংশোধনের পর থেকেই আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আভাস পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন থেকেই সংকট উত্তরণে বিভিন্ন ছকও তৈরি করে রেখেছিলেন তিনি। এর মধ্যে এ বিষয়টিও ছিল। তবে সমাধানের সর্বশেষ বিকল্প হিসেবেই এ পদ্ধতিটিকে ব্যবহার করার ইচ্ছে ছিল তার।
মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত মার্চ মাসেই এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। গণমাধ্যম সম্পাদকদের সঙ্গে গত ৩০ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত প্রাক বাজেট আলোচনায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আগামীতে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হবে বলে জানিয়েছিলেন। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ ১০ মাস। এর মধ্যে বিরোধী দল তাদের দাবি আদায়ে হরতাল, বিক্ষোভ চালিয়ে আসলেও সরকার কৌশলে তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে এ বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। এরই মধ্যে নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা চালায় সরকার। কিন্তু বিরোধী দলের কঠিন প্রতিরোধের ঘোষণা এবং একই সঙ্গে জাতিসংঘ, মার্কিন কংগ্রেস, ইউরোপীয় পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উদ্বেগ প্রকাশ ও তীব্র সমালোচনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। বিরোধী দল এরই মধ্যে নবগঠিত ‘সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী’ মন্ত্রিসভাকে মহাজোটের নতুন সংস্করণ বলে অভিযোগ তোলে এবং যে কোনো মূল্যে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে কঠোর আন্দোলনের হুমকি অব্যাহত রাখে।
সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন সম্পন্ন করার মিশন বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে দীর্ঘ ৫ বছরের সঙ্গী জাতীয় পার্টি মহাজোট থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা ৩০০ আসনে একক নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রিও শুরু করেছে। কিন্তু বিরোধী দলের তীব্র প্রতিরোধের হুমকির সঙ্গে সঙ্গে চলমান সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অব্যাহত উদ্বেগ প্রকাশ ও চাপ প্রয়োগ মিশন বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে নির্বাচন করলে আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা মিলবে না এটা বুঝতে পেরেই নতুন কৌশল অবলম্বন করছে সরকার। এজন্য বিএনপিকে আবারো সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে এটি কেবলই আইওয়াশ। কোনো শর্তযুক্ত আলোচনা করতে সম্মত নন তারা। সাময়িকভাবে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ প্রশমন ও দেশের জনগণের কাছে বিরোধী দলকে একগুঁয়ে প্রমাণ করতেই এটি করা হচ্ছে। এতে বিরোধী দল সাড়া দেবে না ধরে নিয়েই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে সর্বশেষ বিকল্প ‘কোয়ালিশন সরকার’ গঠনের পথে হাঁটছে সরকার।
সূত্র জানায়, আগামী সোমবারই আসন্ন দশম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। এর আগেই সব কাজ সেরে নিতে চায় সরকার। এরই মধ্যে দুই জোটের বাইরে থাকা ছোট দলগুলোর সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিকদের ভাগিয়ে আনতে সরকারের লোভনীয় পদে তাদের অধিষ্ঠিত করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। বেশ কিছু দল ইতিমধ্যে সরকারের এ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে বলেও জানা গেছে। খুব শিগগিরই ১৮ দলীয় জোট ছেড়ে এসব দল মহাজোট অথবা এরশাদের নেতৃত্বাধীন নতুন জোটে যোগ দেয়ার পাশাপাশি কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেবে। এদের কেউ কেউ মন্ত্রিসভায় এবং কেউ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে আসীন হবেন। এছাড়া বিএনএফের ব্যানারে বিএনপির দলত্যাগী অনেক নেতাও নবগঠিত এ মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাবেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সদ্য পদত্যাগী মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিপরিষদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। দেশবাসীর প্রত্যাশা এ সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করবে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ প্রকাশের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে আজও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। তবে সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে বিএনপিকে আশ্বস্ত করে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বান জানায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন