রাজধানীর গাবতলী থেকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ। মিরপুর ১ নম্বর থেকে ১০ নম্বর গোলচত্বর হয়ে আগারগাঁও। যেখানেই যাবেন, আর কিছু পান না পান, নাকে-চোখে ধুলা আর ধোঁয়া ঠিকই পাবেন। সকাল থেকে বিকেল বা রাত—কোনো সময়ই এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি নেই। ডিসেম্বর থেকে আবহাওয়া শুষ্ক হওয়া শুরু করলে, শীত জেঁকে বসলে ধুলার দূষণও বাড়তে থাকে।
চলতি সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালের ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হলো বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর গত বছর সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়। ঢাকার বায়ুদূষণের এই চিত্র সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজেদের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে ১৯ জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমান ছিল মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। বিশ্বের প্রায় বেশির ভাগ শহরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দূতাবাস ও কার্যালয়ে বায়ুমান পর্যবেক্ষণ যন্ত্র রয়েছে। ওই যন্ত্রে শহরগুলোর বায়ুমান প্রতি ঘণ্টায় হালনাগাদ করা হয়। ওই তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাব অনুযায়ী, ১৯ ও ২০ জানুরারি বাংলাদেশ সময় রাত ১১টার দিকে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল এক নম্বরে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল নয়াদিল্লি।
তবে ঢাকায় দূষণে এবার আরেক বিপদ নতুন মাত্রা পেয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারী ধাতু ধুলার সঙ্গে যোগ হচ্ছে। ঘরের বাইরে তো বটেই, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ ও খেলার মাঠেও ভর করছে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে নগরবাসী, বিশেষ করে শিশুরা। শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ রোগবালাই।
ঢাকার সড়ক ও ঘরের ভেতর বায়ুদূষণ বিষয়ে দুটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। গবেষণা দুটি যথাক্রমে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলুশন রিসার্চ-এ চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি সংস্থা পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা দুটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ।
গবেষণায় ঢাকার রাস্তার ধুলায় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাটিতে যে মাত্রায় ক্যাডমিয়াম থাকার কথা, ধুলায় তার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। আর নিকেল ও সিসার মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটি ও পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের ঝুঁকি আগেই ছিল, এবার ঢাকার রাস্তার ধুলার মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছে গবেষক দল। এসব ভারী ধাতু কণার আকার এতটাই সূক্ষ্ম যে তা মানুষের চুলের চেয়ে ২৫ থেকে ১০০ গুণের বেশি ছোট। ফলে খুব সহজেই এসব সূক্ষ্ম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসছে; শ্বাসপ্রশ্বাস, খাদ্য ও পানীয়র মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে।
দুই গবেষণাতেই যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করছেন। আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ভারী ধাতুমিশ্রিত অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা আগের তুলনায় বাতাসে অনেক বেড়েছে। ঢাকায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি উন্নত দেশের শহরগুলোর চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তবে দিল্লি, লাহোরের তুলনায় তা এখনো কিছুটা কম আছে। সবচেয়ে বড় বিপদের দিক হলো, এগুলো স্বাভাবিক ধুলা নয়। শীত মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় এসব সূক্ষ্ম বস্তুকণা বাতাসে ভাসতে থাকে, যা অক্ষত অবস্থায় মানবদেহে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে বড় ধরনের ক্ষতি করে।
নতুন বিপদ ধুলাদূষণ
অধ্যাপক আবদুস সালাম ও পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শফিউর রহমান ঢাকার রাস্তার ধুলায় ভারী ধাতুতে স্বাস্থ্যঝুঁকি–বিষয়ক গবেষণাটি যৌথভাবে করেছেন। গবেষক দল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর ২২টি সড়কের ৮৮টি এলাকার রাস্তা, ফুটপাত, নর্দমার পাশের মাটি ও গর্ত থেকে ৩০০ গ্রাম করে ধুলার নমুনা সংগ্রহ করে। এলাকাগুলো নির্বাচন করা হয় দৈবচয়নের ভিত্তিতে। এসব এলাকা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরে পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে রাজধানীর ৮৮টি এলাকার সবখানেই কমবেশি ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে জিপিও এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভারী ধাতু (ক্যাডমিয়াম, সিসা, নিকেল, আর্সেনিক, কপার ও ক্রোমিয়াম) শনাক্ত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল, যানজট ও বেশ কিছু ধাতু গলানোর কারখানার দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জিপিও, বঙ্গভবন ও রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকার ধুলায় ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ মাটির স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। এখানে মাটির স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে সিসা কিছুটা কম পাওয়া গেলেও আর্সেনিক ও নিকেলের মাত্রা বেশি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যাটারিচালিত যানবাহন ঢাকা শহরে চলাচল করছে। এসব যানবাহনে নিকেল ও ক্যাডমিয়ামের ব্যাটারি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কারখানা। এসব কারখানায় সংকর ধাতু ও ধাতব প্লেট তৈরি এবং এনামেল, প্লাস্টিক ও গ্লাসে রঙের কাজে ক্যাডমিয়াম ব্যবহৃত হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের এফডিসি রেলক্রসিং, বাংলামোটর ও জিপিও এলাকার ধুলায় উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়াম শনাক্ত করেছে গবেষক দল। মাটির স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এই ভারী ধাতু তিন গুণ বেশি। ঢাকা শহর ও এর কাছাকাছি গড়ে ওঠা অনেক ট্যানারি ও ডাইং শিল্প মূলত এই উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়ামের উৎস। মাটি থেকেও সীমিত পরিমাণে এই ভারী ধাতু এসে নির্দিষ্ট সময় পরে ধুলায় যুক্ত হচ্ছে। যানবাহন ও কারখানার দূষণে যা আরও বাড়ছে।
ফার্মগেট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, আসাদ গেট থেকে কল্যাণপুর এবং মহাখালী থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় দস্তার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। অবশ্য গবেষণার জন্য নির্বাচিত স্থানগুলোর বেশির ভাগেই মাটির স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে দস্তা বেশি পাওয়া গেছে।
ঘরের মধ্যে বায়ুদূষণ
ঘরের মধ্যে পরিবেশে সূক্ষ্ম বস্তুকণা ও গ্যাসীয় পদার্থের দূষণ বিষয়ে যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন অধ্যাপক আবদুস সালাম ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গবেষক মোহাম্মদ সোহেল। গবেষণায় ঢাকার পাঁচটি আবাসিক এলাকা বেছে নেওয়া হয়। গবেষক দল ঘরের বাতাসে সূক্ষ্ম বস্তুকণার ভেতর ভারী ধাতু সিসা, দস্তা ও নিকেলের উপস্থিতি শনাক্ত করেছে। এমন দূষণের জন্য যানবাহনের ধোঁয়া, অনিয়ন্ত্রিত কলকারখানা ও নির্মাণকাজকে দায়ী করা হয়েছে। সিসার উপস্থিতির আরেকটি কারণ ঘরের দেয়ালের রং।
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরে পাঁচটি আবাসিক এলাকার ২৫ জন বাসিন্দার ঘরের ভেতর থেকে বাতাসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এলাকাগুলো হলো মিরপুর, খিলক্ষেত, রামপুরা, দোলাইরপাড় ও টঙ্গী। ভবনগুলো ১ থেকে ২৪ বছরের পুরোনো। একতলা থেকে ছয়তলার এসব ভবনের ভেতরে বায়ুতে ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণার (পিএম ওয়ান, পিএম টু পয়েন্ট ফাইভ ও পিএম টেন) ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। এতে দেখা গেছে, ক্ষতিকর বস্তুকণা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ঘরের বাসিন্দাদের শরীরে ঢুকে পড়ছে, যা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। যাকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ভবনের ওই সব তলায় দূষণের উৎস হিসেবে বলা হয়, বাইরের দূষিত বায়ুর ৪২ শতাংশ ঘরে চলে আসে। একই সঙ্গে ঘরের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা, ডিটারজেন্ট, রান্না ও টয়লেট থেকেও দূষিত পদার্থ বাতাসে যুক্ত হয়।
গবেষণায় খিলক্ষেত এলাকার বাসাবাড়িতে সবচেয়ে বেশি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পাওয়া গেছে। এরপর বেশি সূক্ষ্ম বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল দোলাইরপাড় ও রামপুরার বাসাবাড়িতে। সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে মিরপুরে। তবে গবেষণাটির সময়কাল ছিল আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। ওই সময়ে মিরপুরে নিয়মিত বৃষ্টি হয়েছে। আর অন্য তিনটি এলাকা ছিল বৃষ্টিহীন। বৃষ্টি হলে বাতাসে সূক্ষ্ম বস্তুকণার পরিমাণ কমে যায়। ফলে মিরপুর এলাকার ঘরের মধ্যে বায়ুদূষণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
পরিবেশদূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কাজী রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে যখন বেবিট্যাক্সি (দুই স্ট্রোকের ইঞ্জিন) চলত, তখন বাতাসে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে ওই যানবাহনগুলো বন্ধ করা হয়। বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। পাঁচ বছর ধরে এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে এসব বিষাক্ত ভারী ধাতু বাতাসে কেন ফিরে এল, তা গভীর উদ্বেগজনক।
দূষণে অনেকে, নিয়ন্ত্রণে কেউ নেই
পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দুই দফায় ১২ বছর ধরে প্রকল্প চালাচ্ছে। এর সঙ্গে নিয়মিত কিছু তৎপরতাও রয়েছে। কিন্তু বায়ুর মান ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, ধুলাদূষণ নিয়ন্ত্রণে তারা ভবন ও সড়কে নির্মাণকাজ এবং মেট্রোরেল ও উড়ালসড়ক নির্মাণকারী সংস্থাগুলোকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর বৈঠকও করেছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।
রাজধানীর সড়কগুলোতে ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন সকালে দুই সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সংস্থা দুটি তা সঠিকভাবে করছে না বলে অভিযোগ আছে। ভবনগুলো ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না বলে অভিযোগ আছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দূষণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে অন্য সরকারি সংস্থাগুলোকে বড়জোর ধুলা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাতে পারি। দূষণের চিত্র তুলে ধরতে পারি। কিন্তু দূষণের জন্য দায়ী সংস্থাগুলো যদি এ ব্যাপারে তৎপর না হয়, তাহলে আমরা কী করতে পারি।’
বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ নগর এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা: দেশের পরিবেশগত বিশ্লেষণ-২০১৮’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ২০১৫ সালেই নগর এলাকায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু দূষণের কারণে হয়েছে। বিশ্বে ১৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় দূষণে। বাংলাদেশে তা ২৮ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশ উৎস এখনো ইটভাটা। আর রাস্তা ও মাটির ধুলা এবং মোটরগাড়ির দূষণ মিলে ২৬ শতাংশ। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে পাঁচ বছর আগেও বায়ুদূষণে ওই তিন খাতের অবদান ছিল ১৫ শতাংশ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দেশে দ্রুত উন্নয়ন হতে থাকলে প্রচুর নির্মাণকাজ ও শিল্পায়ন হয়, এর প্রভাব পরিবেশের ওপর পড়ে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজধানীতে অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পকারখানা স্থাপনের সময় পরিবেশগত সুরক্ষার ন্যূনতম বিষয়গুলো মানা হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক। এগুলো দেখার জন্য সরকারি সংস্থা আছে। তারা সঠিকভাবে যে দায়িত্ব পালন করছে না, দূষণের চিত্র সেটা বলে দেয়। সামগ্রিকভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে নেতৃত্ব ও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এখনই যদি জরুরি কাজ হিসেবে দূষণ নিয়ন্ত্রণকে না দেখা হয়, তাহলে সামনে আরও বড় পরিবেশ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
ঝুঁকিতে শিশুরা
বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা শিশুদের স্বাস্থ্যেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাস–প্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা জটিলতা খুঁজে পেয়েছেন একদল গবেষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের পক্ষ থেকে গত বছর রাজধানীর ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করে দেখা গেছে, সেখানকার শ্রেণিকক্ষ ও মাঠের বায়ুতে সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম ওয়ান, পিএম টু পয়েন্ট ফাইভ ও পিএম টেন) ও উদ্বায়ী জৈব যৌগ উপাদান পরিমাপ করে দেখা গেছে, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক এসব উপাদান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। এ গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম।
মুগদা বিশ্বরোড, কাকরাইল, ফুলার রোড, যাত্রাবাড়ী, আহমদাবাগ, মতিঝিল, গুলশান, নীলক্ষেত ও খিলক্ষেত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯ থেকে ১০ বছর বয়সী ২৫০ জন শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব শিশুর ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ কফ ও কাশিতে ভুগছে, ৬ শতাংশের শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রয়েছে এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মাইগ্রেন বা মাথাব্যথা সমস্যায় ভুগছে। এর বাইরে আগে থেকে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল না এমন শিশুদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, গড়ে ৫৫ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না।
আবাসিক এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে সড়কের পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণিকক্ষ ও খেলার মাঠের বায়ুতে সূক্ষ্ম বস্তুকণার উপস্থিতি বেশি বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ঘনবসতি ও যানজটপ্রবণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের এসব সমস্যার পেছনে অনেক ধরনের কারণ রয়েছে। সমস্যাগুলো আগে থেকেও থাকতে পারে। আবার এ সমস্যার পেছনে ধুলা ও ধোঁয়ার মতো দূষণেরও ভূমিকা থাকতে পারে। তাই কোনো কারণে শিশুরা এসব সমস্যায় ভুগছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে আরও বিস্তারিত গবেষণা হওয়া দরকার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন