কাউন্সিল ও সাংগঠনিক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে বিএনপি। দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর সাংগঠনিক পুনর্গঠনের দাবি উঠেছে দলটির অভ্যন্তরে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা এ নিয়ে দারুণভাবে সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সবমিলিয়ে জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে শূন্য হয়ে পড়া পদগুলো পূরণ ও বার্ধক্যজনিত কারণে অক্ষম নেতাদের সরিয়ে শারীরিকভাবে সক্ষম, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞাবান নেতাদের নিয়ে কমিটি পুনর্গঠনের দাবি এখন বেশ জোরালো। সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দাবিটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা এ ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করেন।
বৈঠকেই আগামী মার্চে দলের কাউন্সিল আয়োজনের প্রাথমিক নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। শুক্রবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম বলেন- ‘আমি একটু ভিন্ন ভাষায় বলতে চাই, কেউ মাইন্ড করবেন না।
যারা বর্তমানে দলের নেতৃত্বে আছেন, তাদেরকে আরো অ্যাকটিভ হতে হবে। জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে আমাদের নেতৃত্বকে এগিয়ে যেতে হবে। এটা করতে না পারলে নেতৃত্বে থাকার প্রয়োজন নেই।’ তার কথার সূত্র ধরে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের বিষয়ে ইঙ্গিত দেন নীতিনির্ধারক ফোরামের দুই সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তারাও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাস্তবতায় কাউন্সিল ডেকে দলের নেতৃত্বে পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেন। নেতারা পরিষ্কার বলেন, বর্তমান অবস্থা থেকে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন- ‘আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। এখন আমাদের দুটি কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো পুনর্বাসন, অন্যটি পুনর্গঠন। ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ নেতাকর্মীকে পুনর্বাসন করতে হবে। যারা দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন, তাদের সামনে এনে পুনর্গঠন করতে হবে। দরকার হলে আমাদের যাদের বয়স হয়ে গেছে, আমরা সরে যাবো। তারপরেও এই দলটাকে রাখতে হবে। দলকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পুনর্গঠন করতে হবে।’ ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন- ‘ঘুরে দাঁড়াতে হলে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। নেতাকর্মীদের মামলা থেকে পরিত্রাণ ও জেল থেকে মুক্ত করতে হবে। তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। নির্বাচনে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের সামনে আনতে হবে। তুলনামূলকভাবে ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে আনতে হবে। আমরা যারা ব্যর্থ বলে পরিচিত হয়েছি, তরুণদের জন্য আমাদের পদ ছেড়ে দিতে হবে। তাহলেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পরও আমরা দলের কাউন্সিল করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। সারা দেশে আমাদের নেতাকর্মীরা সাহসের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।’ উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯শে মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল।
ওই কাউন্সিলে নীতিনির্ধারক ফোরামের পরিধি বাড়িয়ে উনিশে উন্নীত করেছিল বিএনপি। কিন্তু কাউন্সিলের পর পুনর্গঠিত কমিটিতে দুইটি পদ ছিল শূন্য। ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির দুইজন তারেক রহমান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ আইনি জটিলতার কারণে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন দেশের বাইরে। মূলত ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিই ছিল বিএনপি নীতিনির্ধারক ফোরামের। আবার এই ১৫ জনের মধ্যে বিগত পৌনে তিন বছরে তরিকুল ইসলাম, ব্রি. জে. (অব.) আ স ম হান্নান শাহ ও এমকে আনোয়ার মৃত্যুবরণ করেছেন। এক বছর ধরে কারাবন্দি রয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শারীরিক অসুস্থতার কারণে লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বেশিরভাগ সভাতেই অংশ নিতে পারেন না। সবমিলিয়ে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতামতের ভিত্তিতেই হচ্ছে দলটির সকল সিদ্ধান্ত নির্ধারণ। মূলত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে স্থায়ী কমিটির নেতাদের নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই কার্যত দল পরিচালনা করে আসছেন।
রাজনৈতিক মহলের বিবেচনায় ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন প্রতিকূল রাজনৈতিক সময় পার করছে বিএনপি। দীর্ঘ একযুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির চেয়ারপারসন কারাবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও অবস্থান করতে হচ্ছে দেশের বাইরে। দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সকল স্তরের নেতাকর্মীদের ঘাড়ে এখন মামলার পাহাড়। ক্ষমতার বাইরে থাকার পাশাপাশি চরমভাবে সংকুচিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধিকার। সরকারের কঠোর নিপীড়নের মুখে খাদের একেবারে কিনারে দলটির অবস্থান। এই ধরনের একটি পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দলের একটি শক্তিশালী নীতিনির্ধারক ফোরামের প্রয়োজন। যারা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও স্থায়ী কমিটিসহ দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠনে বিএনপি কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
এ অবস্থায় ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর পুনর্গঠিত কমিটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের মধ্যে- হারুন অর রশিদ খান মুন্নু, ফজলুর রহমান পটল, আকতার হামিদ সিদ্দিকী, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, সঞ্জীব চৌধুরী, গবেষণা সম্পাদক আবু সাঈদ খান খোকন, ধর্ম সম্পাদক বদরুজ্জামান খসরু, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে- মোজাহার হোসেন, এমএ মজিদ, সরওয়ার আজম খান, আবুল কাশেম চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাহী কমিটির অন্তত অর্ধশতাধিক নেতা বার্ধক্যজনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এদিকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বেশিরভাগই চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির মাধ্যমে।
২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর রাজীব আহসান ও মো. আকরামুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ছাত্রদলের কমিটি দুই বছরের বেশি সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় দায়িত্ব পালন করছেন। শফিউল বারী বাবু ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠন হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। দুই দশক ধরে সম্মেলন হচ্ছে না জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সংগঠনটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ভারপ্রাপ্তের মাধ্যমে। এছাড়া তাঁতীদল ২০০৮ সালে, মৎস্যজীবী দল ২০১১ সালে, শ্রমিক দল ২০১৪ সালে, যুক্তিযোদ্ধা দল ও মহিলা দল ২০১৬ সালে এবং যুবদল ২০১৭ সালে গঠিত কমিটি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। অন্যান্য সংগঠনগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের বিকল্প দেখছেন না নেতাকর্মীরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন