প্রায় দুই যুগ আগে স্টারপ্লাসের এক ধারাবাহিক ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বদলে দিয়েছিল টিভি সিরিয়ালের ধরন– ‘কিউ কি সাস ভি কাভি বহু থি’। কাছাকাছি বাংলা– শাশুড়িও কখনও বউ ছিল। খেলার পাতায় এই পুরোনো সিরিয়াল টেনে আনার কী এমন হলো? কারণ কিছুটা আছে বৈকি।
এই যে গেল কয়েক দিনে তামিমের ফেসবুক লাইভে আসা, তার পরপরই সাকিবের রেকর্ডেড সাক্ষাৎকারে তামিম ইস্যু সামনে আসা। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটা মেগা সিরিয়ালের প্লট তৈরি হয়েছে। কিন্তু সব ঘটনাতেই কে সঠিক, কে ভুল– এমন একটা সারাংশ খুঁজতে চায় জনমন। এ ঘটনাতেও সেই কৌতূহলের কমতি নেই। সেটা মেটানোর চেষ্টা করতে গিয়েই ২৩ বছর আগের স্মৃতি ইরানির সেই শাশুড়ি-বউয়ের গল্প টেনে আনা।
গল্পের শুরুটা সবারই জানা। বিশ্বকাপ দলে অন্তুর্ভুক্তি না হওয়ার পর প্রথম লাইভে আসেন তামিম ইকবাল। তাঁর অভিযোগগুলো ছিল এমন– তিনি বিশ্বকাপ খেলার জন্য গত দুই মাস ধরে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ড সিরিজের মাঝামাঝি সময়ে বোর্ডের টপ লেভেল থেকে একজন (সমকাল বিসিবি সূত্রে নিশ্চিত হয়েছে ব্যক্তিটি নাজমুল হাসান পাপন) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে তামিমকে বলেন, ‘তুমি বিশ্বকাপে যাবা, কিন্তু তোমাকে তো ম্যানেজ করে খেলতে হবে। একটা কাজ কর, তুমি প্রথম ম্যাচ খেলিও না। তুমি যদি খেল, তাহলে আমরা পরিকল্পনা করেছি, তুমি নিচের দিকে খেলবা।’
অপ্রকাশিত ঘটনা, সেখানেই গালাগাল শুরু হয়ে যায়। বিব্রত হয়ে পড়েন নাজমুল হাসান পাপন। সাদা চোখে মনে হতে পারে, সেখানেই যদি তামিম বলতেন দলের স্বার্থে যে কোনো জায়গাতেই ব্যাটিং করতে প্রস্তুত। তাহলে হয়তো জল এত দূর গড়াত না। কিন্তু তামিম কেন তা বলতে পারলেন না? এখানেই সেই শাশুড়ি-বউয়ের গল্প।
কারণ তামিম নিজে তো জানেন, দলে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত হলে, কাউকে বাদ দিতে চাইলে– কোন কোন কৌশল নিতে হয়। টিম ম্যানেজমেন্ট কীভাবে তা প্রয়োগ করে, কাকে দিয়ে প্রয়োগ করে। মিডিয়াতে কাকে দিয়ে কোন সময় কোন খবর ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করতে হয়। বাকিরা এসব বুঝতে না পারলেও একসময় বাংলাদেশ দলের সংসার সামলানো তামিমের তা না বোঝার কারণ নেই।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ আফগানিস্তানের বিপক্ষে। খেয়াল করলে দেখা যায়, দলটির স্পিনার মুজিবের সামনে ওপেন না করে নন-স্ট্রাইকে থাকেন তামিম। এমনকি গত কয়েক ম্যাচে আফগান পেসার ফারুকির বলে উইকেট দিয়েছেন। যে তামিম তাঁর চার শতাধিক ইনিংসে প্রথম বলে স্ট্রাইক নিয়েছেন, সেখানে মুজিবের সামনে কেন নন-স্ট্রাইকে থাকেন। এসব বিশ্লেষণ করে হাথুরু যদি তাঁকে প্রথম ম্যাচ নাই খেলাতে চাইতেন, তাহলে সেখানে যুক্তির কম ছিল না। আসলে হাথুরু হচ্ছেন বাজিকর কোচ, যিনি কিনা প্রথাগত ক্রিকেট ম্যানুয়ালের বাইরে গিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন। সেখানে তামিম হচ্ছেন নব্বই দশকের ওয়ানডে ঘরানার ওপেনার, যিনি কিনা হাথুরুর দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই সংসারের চাবি বদল হওয়ার মতো ঘটনায় বিতর্ক তৈরি হবেই এবং সেটাই হয়েছে।
একসময় লোকের মুখে মুখে ছিল সাকিব-তামিমের বন্ধুত্বের কথা। আসলে সেটাও ছিল মিডিয়ারই তৈরি। দু’জনই ভাতের বদলে কন্টিনেন্টাল পছন্দ করতেন, এ জন্য দলের মধ্যে তাদের দু’জনকেই আলাদাভাবে ধরে নিয়ে বন্ধুত্বের গল্পটা তৈরি হয়েছিল। তবে সম্পর্কেরও রং বদলায়– সেই হিন্দি সিরিয়ালের গল্পতেও ছিল তেমনটি।
এখন সাকিবের চোখে তামিম ‘বাচ্চা ছেলে’। কড়া কড়া কথা বলেছেন তিনি। ‘দল আগে না, ব্যক্তি আগে। রোহিত শর্মার মতো খেলোয়াড় সাত নম্বর থেকে ওপেনার হিসেবে ১০ হাজার রান করেছেন। ও (তামিম ইকবাল) যদি মাঝে মাঝে তিন-চারে নামে বা ব্যাটিংয়ে না নামে, এটা কি খুব একটা সমস্যা হয়? এটা আসলে আমার মনে হয়, অনেকটা বাচ্চা মানুষের মতো, যে আমার ব্যাট আমিই খেলব আর কেউ খেলতে পারবে না। দলের প্রয়োজনে যে কেউ যে কোনো জায়গায় খেলতে রাজি থাকা উচিত। দল আগে, তার পর অন্য কিছু। পার্সোনাল অ্যাচিভমেন্ট দিয়ে আপনি কী করবেন আসলে। আপনার নিজের নাম কামাবেন, তার মানে আপনি নিজের কথা চিন্তা করছেন। আপনি দলের কথা চিন্তা করছেন না। মানুষ এই পয়েন্টগুলো বোঝে না।’ সঠিক কথাই বলেছেন সাকিব।
দলীয় খেলায় ব্যক্তিস্বার্থ কখনোই প্রাধান্য পেতে পারে না। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন থেকে যায়। হাথুরু তাঁর প্রথম মেয়াদে সাকিবকে টি২০ ম্যাচে সাত নম্বরে নামার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যেখানে সাকিব খেলছিলেন তিন এবং চার নম্বর পজিশনে। ২০১৭ সালে হাথুরুর সেই প্রস্তাব শুনে রেগে গিয়েছিলেন সাকিব, তখন হাথুরু পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন– ‘তোমাকে তোমার আইপিএল দল কয় নম্বর ব্যাটিং পজিশনে খেলায়।’
কলকাতা নাইট রাইডার্সে তখন ৭ ও ৮ নম্বরে নামতেন সাকিব। হাথুরুর সেদিনের প্রস্তাব ছিল দলের স্বার্থেই। সাকিব তামিমের দিকে টিমম্যান না– এমন অভিযোগ এনেছেন। আঙুল তুলেছেন অধিনায়ক হয়ে আফগান সিরিজে হঠাৎ অবসরের ঘোষণার নৈতিকতা নিয়েও। কিন্তু সাকিবও সব সময় এমনটা করেন। যখন দলকে টুর্নামেন্টে রেখে অন্য শহরে গিয়ে বিজ্ঞাপন কিংবা শোরুম উদ্বোধন করেন, সেটা কি ‘টিমম্যানশিপের’ মধ্যে পড়ে। যদি তাঁর দেখাদেখি বাকি ১০ জন এমন আবদার করেন, তখন বিসিবি কী সিদ্ধান্ত দেবে?
আসলে কেউই ‘ধোয়া তুলসি পাতা’ নন। কিংবা যে জলে ধোয়া হচ্ছে, সেই জলটাই হয়তো বিশুদ্ধ নয়। এখানেই বিসিবির ভূমিকা সামনে চলে আসে। যার ইঙ্গিত কিছুটা দিয়েছেন মাশরাফি তাঁর সর্বশেষ ভিডিওতে। ‘এই যে পাঁচ ম্যাচ নিয়ে এত কিছু ঘটে গেল, সেখানে দায় সাকিবেরও না, তামিমেরও না; এমনকি নান্নু ভাইয়েরও না। এখানে যে বা যারা এই মেসেজটা মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের আসলে খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ।’
যে সাপ দিয়ে খেলা দেখিয়েছেন সাপুড়ে, সেই সাপের দংশনেই কিনা তামিমের আজকের পরিণতি। চারপাশের সব বিষণ্নতায় জড়িয়ে তামিম এখন জলসাঘরের সেই বিশ্বম্বর রায়– এর মতোই বড্ড নিঃসঙ্গ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন