“বিটিআরসি এই অ্যাপগুলো বন্ধ করে দিলে তারা ভিপিএন এর মাধ্যমে চালাচ্ছে। এই ধরনের অ্যাপের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট আইন নেই, এটা করাও জরুরি হয়ে পড়েছে,” বলেন র্যাবের মুখপাত্র।
রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন; মাস নয়েক আগে টাইলস মিস্ত্রি সবুজ আলী সেই ফাঁদেই পা বাড়িয়েছিলেন। এক লাখ ৬০ হাজার টাকা খাটিয়েছিলেন ‘আলটিমা’ নামের এক অ্যাপে। প্রথম মাসে ৫ শতাংশ হারে লভ্যাংশ পেয়েছেন আট হাজার টাকা, কিন্তু এরপর আর কিছু মেলেনি।
রাজশাহী নগরীর ডাঁশমারী পূর্বপাড়া এলাকার ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ কেবল নিজেকেই ফাঁদে ফেলেননি, জড়িয়েছেন পরিবারকেও। অ্যাপে ‘বিনিয়োগের’ আগে সবুজের সঞ্চয়ে ছিল ৪০ হাজার টাকা, বাকি টাকা মায়ের নামে কর্জ করেছেন এনজিও থেকে।
ভার্চুয়াল জগতে বিনিয়োগের পাশাপাশি বাজি, জুয়া, গেইমিং, ক্যাসিনোর নামে নানা ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সবুজের মত অনেকে। বছরের পর বছর ধরে বাহারি বেশে প্রতারকরা সক্রিয় থাকলেও তা ঠেকানোর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোও দায় নিতে রাজি নয়, তারা একে অপরের উপর দায় চাপিয়ে খালাস।
কয়েক মাস ধরে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা যায়, ফেইসবুক, ইউটিউব ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটের পেইজে বাহারি বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। গ্রাহকরা ওয়েবপেইজ ঢুকে ও প্লে স্টোর থেকে অ্যাপ নামিয়ে এসব ফাঁদে পা দিচ্ছেন। টাকা লেনদেনের জন্য অনুমোদন ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল ওয়ালেট। কারসাজির মাধ্যমে দেশীয় বৈধ আর্থিক চ্যানেল থেকেই এসব ওয়ালেটে করা যাচ্ছে লেনদেন।
সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু সক্রিয় প্রতারক কোম্পানির নাম পাওয়া গেছে, যার মধ্যে আছে- এক্সপার্ট অপশন, মডার্ন ইনকাম অ্যাসিসটেন্স, লাস্টিং ডিজগাইজ, বিগ লাকি বেল, গোল্ড ফ্রম অলিম্পিয়া, স্পিন অ্যান্ড উইন, ভিক্টরিয়াস বেল, প্লিংকো অ্যাডভেনচার, ক্যাশ বক্স, বিগবুক উইন, রিচ ওলিম্পাস, জোকার টুইনস, বিগ উইন লাকি, ভিক্টোরিয়াস বেল, র্যাপিড ক্যাশ, ওয়ানএক্সবেট, ড্রিমইলেভেন, বেট৩৬৫, হুইল অব লাক, গ্লোরি ক্যাসিনো, বাজি৯৯৯, এমটিএফই, মুভিঅ্যাপ।
টাকা বানানোর ‘ভার্চুয়াল মেশিনে’ নিঃস্ব মানুষ, দেখবে কে?
এসব প্রতিষ্ঠান ও তাদের প্রতিনিধিরা লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে বিকাশ, রকেট, নগদ, ওকে, ট্যাপকে দেখাচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আর্থিক যে কোনো অপরাধ বা অনিয়ম ঠেকানোর দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কেউ যদি বিদেশি অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইটে কিংবা অন্য কোনোভাবে টাকা পাচার বা অন্য কোনো আর্থিক অপরাধ করে, সেটা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখিয়ে দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে আইনগত ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা।
সর্বস্বান্ত রাজশাহীর হাজারও মানুষ
উত্তরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীতে অ্যাপে বিনিয়োগ এমন পর্যায়ে গেছে যে অনেকেই অফিস খুলে বসেছেন। বর্তমানে শহরটিতে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পাচ্ছে ‘এমটিএফই’ নামের একটি অ্যাপ।
এ অ্যাপে বিনিয়োগকারীদের একজন রুবেল হোসেন বলেন, “আমার মাধ্যমে যদি কেউ অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করে, তার কিছু কমিশন আমার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। যতি বেশি টাকা বিনিয়োগ করবে, তত বেশি কমিশন পাব।
“এভাবে যদি ১০০ জনকে বিনিয়োগ করাতে পারি, তাহলে নিজেরই অফিস করতে পারব, আর আমার পদ হবে সিইও।”
টাকা বানানোর ‘ভার্চুয়াল মেশিনে’ নিঃস্ব মানুষ, দেখবে কে?
দুর্গাপুর উপজেলার অর্ধশত বিনিয়োগকারী তার মাধ্যমে এমটিফই অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করেছে বলে জানান রুবেল।
রাজশাহীতে এমটিএফই অ্যাপের অফিস খুলে নিজেকে সিইও পরিচয় দেওয়া মো. সবুজ বলেন, “এমটিএফই অ্যাপের অফিসও বলতে পারেন, আবার আমার চেম্বারও বলতে পারেন। আমার মত সারাদেশে এই অ্যাপের ৯ জন সিইও রয়েছেন।
“কাউকে জোর করে ওই অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করতে বলা হয় না। একজন বেকার যুবক যদি একটি কর্ম পায় তাহলে তো আমাদের ভালো।”
তবে টাইলস মিস্ত্রি সবুজ আলীর পরিণতি কিন্তু তা বলছে না। গত ২০ জুন তিনি রাজশাহী নগরীর উপশহর ৩ নম্বর সেক্টরের মাহবুবুর রহমানের ‘প্লেটিং কয়েন’ নামের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেটি বন্ধ পেয়েছেন। বাধ্য হয়ে ২৬ জুন সবুজ আলী প্রতারক চক্রের আটজনের নাম উল্লেখ করে ১৩ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছেন। পরে পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তারও করেছে।
সবুজ আলীর মত তার এলাকার একলাসুর রহমান (২৫), লিটন ইসলাম (২৮), টিটু ইসলাম (৩৮) এবং শ্যামপুর পশ্চিমপাড়ার সিটন (২৫) ‘আলটিমা’ অ্যাপে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন।
একইভাবে ‘ই-মুভি’ নামের আরেক অ্যাপে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়েছে শতশত মানুষ। এই অ্যাপের নামে মহানগরীর শিরোইলে অফিস খুলে মানিক নামের এক যুবক প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিলেন। তার মাধ্যমে ওই অ্যাপে বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়েছে গোদাগাড়ীর প্রেমতলী এলাকার শতাধিক মানুষ। এ নিয়ে নগরীর চন্দ্রিমা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে গ্রেপ্তার হন মানিক।
টাকা বানানোর ‘ভার্চুয়াল মেশিনে’ নিঃস্ব মানুষ, দেখবে কে?
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, “দেশে এসব অ্যাপের অনুমোদন নেই। এই অ্যাপের মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। যে কোনো সময় অ্যাপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
“এসব বিষয় প্রতারণার শিকার হয়ে যদি কেউ অভিযোগ করে, তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া দুটি অ্যাপের বিরুদ্ধে দুটি মামলাও হয়েছে। পুলিশ ১০/১২ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে।”
বিষয়টি আরএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট খতিয়ে দেখছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
নানা প্রতারণা নানা রূপে
ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপ ও ওয়েবসাইট থেকে টাকা কামানোর লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে অ্যাপগুলো ইনস্টল করতে বলা হচ্ছে।
কোনো মোবাইল ফিন্যানসিয়াল সার্ভিসের এজেন্ট নম্বর ব্যবহার করে এসব অ্যাপে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা জমা নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এমএফএসগুলোর একটি এজেন্ট নম্বরে ক্যাশ আউট অপশন ব্যবহার করে টাকা পাঠাতে হয়। অ্যাপের মধ্যে একটি এজেন্ট নম্বর প্রদর্শনের কয়েক দিনের মধ্যে তা পরিবর্তন করে নতুন নম্বর বসানো হয়।
বিভিন্ন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠানো এসব টাকা অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইটগুলোর অনুমোদনহীন ওয়ালেটে জমা হয়ে যায়।
ক্যাসিনো হুইলের চাকা ঘোরা শুরুর আগে একজন গ্রাহক কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘরে ২০/৫০ কিংবা আরও বড় কোনো অংকের টাকা জমা করতে পারেন। ভাগ্যের চাকা তার ঘরে এসে থামলে কতগুণ টাকা ফেরত চান সেটাও উল্লেখ করতে হয়।
প্রথম দিকে জমা টাকার কয়েকশগুণ টাকা ফেরত দেওয়া হয়। ৫০ টাকা কয়েক হাজার টাকায় রূপান্তরিত হয়ে ফেরত আসে ডিজিটাল ওয়ালেটে। আবার কখনও কখনও মূল টাকাও হারান গ্রাহক। চাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুরছে বলে দেখানো হলেও ভার্চুয়াল হওয়ায় এর পেছনে কারও নিয়ন্ত্রণ আছে কি না সেটা স্পষ্ট হওয়া যায় না।
আবার লাইভ ক্যাসিনো নামে একটি গেইম রয়েছে, যেখানে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি ক্যাসিনো ঘরে এসে নিজেই চাকা ঘুরাচ্ছেন। ফলে গ্রাহক একধরনের ক্যাসিনো উত্তেজনা অনুভব করেন।
খেলার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন খেলার আয়োজন থাকে এসব অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইটে।
আবার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান বিভিন্ন খেলার ফলের উপরে অ্যাপ ব্যবহার করে বাজি ধরার সুযোগ পান গ্রাহকরা।
কেউ এই প্রক্রিয়ায় কয়েক লাখ টাকা আয় করলেও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী একটি এমএফএস নম্বর ব্যবহার করে ২০ হাজার টাকা ফেরত আনা যায়। অবশ্য একাধিক নম্বর ব্যবহার করে একই হারে টাকা উত্তোলন করতে পারেন গ্রাহক।
টাকা বানানোর ‘ভার্চুয়াল মেশিনে’ নিঃস্ব মানুষ, দেখবে কে?
কেবল ক্যাসিনো বা অন্য খেলা নয়, শেয়ার বাজারের উত্থান-পতনের আদলেও গ্রাহকের কাছ থেকে কথিত বিনিয়োগ নিচ্ছে এসব অচেনা কোম্পানির অ্যাপ।
একলাছুর রহমান নামে এক ক্যাসিনো গ্রাহক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে যখন লাভ হয়, একসঙ্গে অনেক টাকা লাভ হয়। যেমন কেউ ১০০ টাকা ধরলে এর বিপরীতে এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হতে পারে। আবার সব টাকা চলেও যেতে পারে।
“দিন শেষে দেখা যায়, ১০০ টাকা নিয়ে এক ঘণ্টা খেলার পর কোনো এক সময় তা বেড়ে ১০ লাখ টাকা হয়ে গেছে। আবার কমে গিয়ে ৫০ টাকায় এসে নেমেছে।”
এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতারকদের কাছে চলে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
দেশজুড়ে বিভিন্ন পার্কে, দোকানে বা খেলার মাঠের দর্শক গ্যালারিতে অনেকেই এ ধরনের খেলায় আসক্ত হচ্ছেন। বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হলেও প্রতিবাদ করার জায়গা থাকছে না খেলাটি বেআইনি ও অনুমোদনহীন হওয়ার কারণে। প্রতারকরা সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছেন।
সম্প্রতি অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হওয়ার দুটি বড় ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে এসেছে কয়েক কোটি টাকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ক্যাশ ইনচার্জ শামসুল ইসলাম ব্যাংকের ভল্ট থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা সরিয়ে নেন। এসব টাকায় অনলাইনে জুয়া খেলতে গিয়ে সব হারিয়ে ফেলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে নেওয়া এসব টাকার হিসাব মেলাতে না পারায় পরে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
২০২১ সালের জুনে ঢাকা ব্যাংকের বংশাল শাখা থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা ধারাবাহিকভাবে সরিয়ে জুয়ার অ্যাপে জুয়া খেলার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দুই কর্মকর্তা। তবে এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট অ্যাপের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করেনি।
সম্প্রতি গ্লোরি ক্যাসিনোর ফেইসবুক পেইজে একটি বিজ্ঞাপনের নিচে একজন গ্রাহক লেখেন, “ভাই কেসিনো এইভাবে চিটারি বাটপারি করে, এইটা আগে জানা ছিল না। এই দেশের কত মানুষ পথে পথে কষ্ট পাচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
“এখনও সময় আছে আপনার যারা না জেনে এই খেলায় টাকা ডিপোজিট করতেছেন, তারা এইটার পিছনে এক টাকাও ব্যয় করবেন না। আমি গত ১১/৫/২০২৩ এর ৩০০০০০ তিন লাখ টাকা এখন পর্যন্ত পাই নাই। তার আগে ১১/৪/এর ৪০ হাজার টাকা। আপনারা আমার মোবাইলে (নম্বর প্রকাশ করা হল না) যোগাযোগ করে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন।”
দায় নিচ্ছে না কেউ
নিজস্ব পর্যবেক্ষণে অনুমোদনহীন কারেন্সি ব্যবহার করে অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন এমএফএস ও ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করা যেসব হিসাবের তথ্য পেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, ওইসব হিসাব বন্ধ করা হয়েছে বলে সোমবার জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। (পরে তাকে বদলি করা হয়েছে)
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হল অর্থ পরিশোধ ব্যবস্থাকে নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত ও সহজসাধ্য করা। কেউ যদি এটিকে অসাধু বা অবৈধ কাজে ব্যবহার করে তা অভিযোগ পেলে হিসাব বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
মেজবাউল হক বলেন, “সন্দেহযুক্ত লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী অর্থ লেনদেন করছে তার পর্যবেক্ষণ অসাধ্য।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহার ও অনুমোদনহীন পেমেন্টে চ্যানেলের বিজ্ঞাপন দিয়ে যেসব ওয়েবসাইট ও অ্যাপ বাংলাদেশে চলছে, তা বন্ধ করার দায়িত্ব বিটিআরসির।”
টাকা বানানোর ‘ভার্চুয়াল মেশিনে’ নিঃস্ব মানুষ, দেখবে কে?
তবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, “ভার্চুয়াল জগৎ অনেক বিস্তৃত এবং এ ধরনের অপরাধমূলক প্রতিষ্ঠানও অসংখ্য। সে কারণে চাইলেই একদিনে সবগুলো নজরে এনে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, যেসব ওয়েবসাইট এসব কর্মকাণ্ড করছে, সেগুলো বিটিআরসি নজরে এলেই ‘ব্লক’ করে দিচ্ছে। কিন্তু প্লে স্টোরে থাকা অ্যাপগুলো সব সময় বন্ধ করা সম্ভব হয় না।
বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালে প্লে স্টোরের ১৫০টি ক্যাসিনো অ্যাপ বন্ধের অনুরোধ করা হলে সেখানে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি অ্যাপ তারা বন্ধ করেছে। বাকিগুলো বন্ধ করা যায়নি।
ফেইসবুক ও স্যোশাল মিডিয়ায় এসব বিজ্ঞাপন বন্ধে অনুরোধ করা হয়েছে জানিয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, “ফেইসবুক কিছু কিছু অনুরোধ রাখলেও অনেক সময় তারা ব্যবস্থা নিতে দেরি করে। সে কারণে বাংলাদেশে সোশাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বিষয়ক প্রতিবেদন যেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বিটিআরসিকেও দেওয়া হয়, সেই অনুরোধ জানিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।”
গত এক বছরে প্রায় এক হাজার জুয়ার সাইট বন্ধ করা হয়েছে জানিয়ে বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সংস্থায় ১২ জনের একটি টিম নিয়মিত ওয়েবসাইট মনিটরিংয়ের কাজটি করছেন। পাশাপাশি জুয়া বা ক্যাসিনো সাইট নজরে এলে বা অভিযোগ পেলে তারা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও এমএফএস (মোবাইলি আর্থিক সেবা) মাধ্যমকে ব্যবহার করে যেসব ওয়েবসাইট ও অ্যাপ ডিজিটাল জুয়া, ক্যাসিনো ও বাজি ধরার মত অবৈধ কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাপভিত্তিক জুয়া কিংবা কথিত বিনিয়োগ বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু লোকজন গ্রেপ্তার করলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে ৪২০ ধারায় প্রতারণার মামলা করা হচ্ছে।
গতবছর অ্যাপভিত্তিক বেটিং ও চ্যাটিং অ্যাপের বিষয়ে অভিযান চালানো ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন সহকারী কমিশনার বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অ্যাপভিত্তিক একটি চক্রের কয়েকজন সদস্যকে গত বছর গ্রেপ্তার করেছিলেন তারা। এখন অ্যাপগুলোতে একই সঙ্গে বেটিং বা জুয়া এবং লাইভ চ্যাট একই সঙ্গে থাকছে।
“লাইভ চ্যাটে বিভিন্ন বয়সী নারীদের সঙ্গে ভিডিও কলে ‘গল্প করার’ সুযোগ দেয় অ্যাপগুলো। এদের টার্গেট মূলত প্রবাসী বাংলাদেশীরা। অনেকে রাতভর লাইভ চ্যাটরুমে থেকে নিজেদের অর্থ নষ্ট করছেন।”
টাকা বানানোর ‘ভার্চুয়াল মেশিনে’ নিঃস্ব মানুষ, দেখবে কে?
ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, এই অ্যাপগুলো দেশে এজেন্ট ও ডিলার নিয়োগ দিয়েছে। এদের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি নগদ অর্থ দিয়ে (এফএফএসও আছে) চ্যাটরুমে বা বেটিংয়ে যুক্ত হওয়ার জন্য ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ সংগ্রহ করেন। তারা কেবল এই এজেন্ট ও ডিলার পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন। পুলিশের অভিযোগের ভিত্তিতে বিটিআরসি যখন ওই অ্যাপগুলো এই দেশে বন্ধ করতে পারে।
গত বছর এরকম কয়েকজন এজেন্ট ও ডিলারকে গ্রেপ্তারের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ওই অ্যাপগুলোর হয়ে কিছু তরুণী রাতভর চ্যাটরুমে অংশ নেন। চ্যাটরুমে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত ডিজিটাল কারেন্সির ওপর ভিত্তি করে তাদের মজুরি নির্ধারিত হয়। চ্যাটরুমগুলোতে দেশীয় কিছু অভিনয় শিল্পীও অংশ নেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “বিটিআরসি এই অ্যাপগুলো বন্ধ করে দিলে তারা ভিপিএন এর মাধ্যমে চালাচ্ছে। এই ধরনের অ্যাপের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই, এটা করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
“কোনো ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেলে আমরা অভিযান চালিয়ে তাদের ধরি। তবে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দিতে হয়।”
(সমন্বিতভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন রাজশাহী প্রতিনিধি বদরুল হাসান লিটন, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফয়সাল আতিক, গোলাম মর্তুজা অন্তু ও নিজস্ব প্রতিবেক শেখ আবু তালেব)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন