চাপ দিয়ে দুর্বল ১০ ব্যাংকের সঙ্গে সবল ১০টি ব্যাংকের মার্জার বা একীভূতকরণের পরিকল্পনা নিয়েও হঠাৎ করেই এই উদ্যোগ থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূত সংক্রান্ত নীতিমালা ঘোষণা করে, সেই নীতিমালা প্রকাশের আগেই তিনটি ব্যাংক ও পরে দুটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা স্বেচ্ছায়; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এই নীতিমালা মানছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পথনকশা দেয়ার পর ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিছুটা সবল ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে দুর্বল ব্যাংকের বোঝা। এই সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ভীত গ্রাহকদের আমানত তোলার হিড়িক এবং ব্যাংকের পরিচালকসহ প্রভাবশালীদের চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, ইতিমধ্যেই যে পাঁচটি একীভূতকরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তার বাইরে আগামী তিন বছরে নতুন কোনো ব্যাংক মার্জারের অনুমোদন দেয়া হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে বেশকিছু ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানত ব্যাপকভাবে তুলে নেয়ার খবর উঠে এসেছে।
যেমন বেসিক ব্যাংক। এই ব্যাংকটি একীভূত হতে চলেছে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে। এই তথ্য গণমাধ্যমে আসার পর ব্যাংকের বড় বড় আমানতকারীরা চিঠি দিয়ে আমানত তুলে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন বলে জানান বেসিক ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু মোহাম্মদ মোফাজ্জল। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে মার্জারের সিদ্ধান্তের ফলে গ্রাহকরা ডিপোজিট (আমানত) তুলে নেয়া শুরু করেছে।
এতে আমাদের তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা সার্বিক এই ক্ষতির বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরবো।
একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চলা আরেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ব্যাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল); এবং কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চলা রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)-ও গ্রাহকের আমানত তুলে নেয়ার চাপের মুখে পড়েছে। রাকাবের সিনিয়র এক কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ গ্রাহকদের এভাবে আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতাটি অব্যাহত থাকলে সংকট আরও বাড়বে।
বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) একীভূত হবে অপর বেসরকারি ঋণদাতা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে। এই ব্যাংকেও মার্জারের সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সম্প্রতি পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা সত্ত্বেও একীভূতকরণের প্রস্তাবে বোর্ডের থেকে অনুমোদন নিতে পারেনি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত দুই মাস আগে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে একাধিক পরিচালক পদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। কিন্তু একীভূত করার সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, বোর্ড পুনর্গঠনের পর ব্যাংকের অনেক সূচক ভালোর দিকে আসছে। তবে সূচকগুলো আরও ভালোর দিকে নিতে আরও বছরখানেক সময় প্রয়োজন। এরই মধ্যে জোরপূর্বক একীভূত করার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক গ্রাহক আমাদের ব্যাংকে আসছেন তাদের জমা টাকা তোলার জন্য।
জানা গেছে, বেসরকারি খাতের ব্যাংক ইউসিবি’র শীর্ষ নির্বাহীদের গত ৯ই এপ্রিল হঠাৎ ডেকে পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদরী। সেখানে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়, ন্যাশনাল ব্যাংককে ইউসিবি’র সঙ্গে একীভূত করতে হবে।
ব্যাংকটির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগই পাননি ইউসিবি নেতৃত্ব।
বিডিবিএল বোর্ড সভায় উপস্থিত থাকেন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে একীভূত করা নিয়ে কোনো প্রস্তাব দেইনি।
সভায় বোর্ড সদস্যরা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের ব্যাংককে অন্য একটি সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করা হবে বলে তারা জানিয়েছে। সরকার চাইলে আমাদের আপত্তি করার কোনো সুযোগ নেই। তবে বিডিবিএল ভালো অবস্থানেই ছিল।
এনবিএলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ডেকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল। তবে আমাদের পরিচালনা পর্ষদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেনি। ফলে আমাদের ব্যাংক একীভূত হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়।
অর্থনীতিবিদরা এই প্রক্রিয়াকে ‘ফোর্সড ম্যারেজ’ বলে উল্লেখ করেছেন। বিদ্যমান তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর জন্য তাদের একীভূত হওয়ার অংশীদার বেছে নেয়ার সুযোগ রাখা উচিত।
গত ৪ঠা মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এর গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতৃবৃন্দকে ডেকে ব্যাংক একীভূতকরণের পরিকল্পনা জানান। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালা ঘোষণা করে। যেখানে বলা হয়, কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাইলে নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নেবে।
‘বাধ্যতামূলক একত্রীকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা’য় বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংককে ২০২৫ সাল থেকে বাধ্যতামূলক একীভূত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক একীভূত হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এ কাজের খরচ জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায় ও সম্পদ গ্রহণের দরপত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করতে হবে, যাতে ওই ব্যাংকের সব ধরনের তথ্য থাকবে। এতে সাড়া না মিললে, যেকোনো ব্যাংকের সঙ্গে ওই ব্যাংককে একীভূত করে দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইতিমধ্যেই যে পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তার বাইরে অন্য কোনো ব্যাংক একীভূত করা হবে কি-না জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসির বলেন, কোনো ব্যাংক নিজে থেকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করতে চাইলে আমরা অবশ্যই তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবো। তারা অফিশিয়ালি আমাদেরকে তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের সম্পদ ও দায় মূল্যায়নের জন্য অডিটর নিয়োগ করেছে এবং তাদের একীভূতকরণের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে।
বাকি চারটি মার্জারের জন্য এ ধরনের কোনো প্রাথমিক অনুমোদন এখনো দেয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ফলে এই মুহূর্তে ওই চারটি দুর্বল ব্যাংকের একীভূতকরণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। অডিট রিপোর্ট পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতিতে দুইপক্ষ আদালতে যাবে। সেখানে আদালত অনুমোদন দেয়ার পর ব্যাংক দুটি একীভূত হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছিলেন, ব্যাংক একীভূত করতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অডিটর নিয়োগ, সম্পদ ও দায় ঠিক করা, শেয়ার দর ঠিক করা, শেয়ার অংশ নির্ধারণও আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এতে সময় লাগবে। এই পাঁচ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) অভিজ্ঞতা নেবো। অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন আছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হওয়া ব্যাংকগুলোর মালিকদের অধিকাংশই প্রভাবশালী। একীভূতকরণের প্রক্রিয়া তাদের চাপেও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শুধু একীভূত করে ব্যাংক খাতকে ভালো করা সম্ভব নয়। ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মে যুক্ত পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। জোর করে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করে দিলে ভালো ব্যাংকও খারাপ হয়ে যেতে পারে। এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো পুরো ব্যাংক খাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংক কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ শুরু করেছে, এটা ভালো দিক। এখন দেখার বিষয় কতোটা পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে এই ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। সেটি না হলে মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন