- ১০০ টাকার কমলায় সরকারের কর ১৬৯ টাকা
- ১০০ টাকার খেজুরে শুল্ক ১৪৩ টাকা
- মাল্টার দর ঢাকায় ২৮০ ভারতে ৭৯, পাকিস্তানে ৩২ টাকা
রমজান আসার আগেই ফলের বাজারে আগুন ধরে গেছে। বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রোগীর পথ্য হিসেবে দেশী-বিদেশী ফল নিত্য অনুসঙ্গ হলেও ফলকে বিলাসপণ্য হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুল্ক আদায় করছে। এতে রোজায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া কমলা/মাল্টায় ১০০ টাকার ফলে ১১৩ টাকার বেশি শুল্ক আদায় করা হচ্ছিল। রমজানে বিদেশী ফলের মধ্যে সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে কমলা ও মাল্টার। এর পরে থাকে আপেল ও নাশপাতির। কিন্তু রমজান ঘনিয়ে আসার আগ মুহূর্তেই ক’দিন আগে কমলা ও নাশপাতি আমদানিতে এসেসমেন্ট ভ্যালু ৭৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে কর/শুল্ক বেড়ে যাবে সমহারে। এসব ফলের দাম ভারত পাকিস্তানের তুলনায় ২ থেকে ৮ গুণ বেশি বাংলাদেশে।
অস্বাভাবিক শুল্ক : বাংলাদেশে ডলার সঙ্কটের মধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে সব ধরনের বিদেশী ফল আমদানিতে ২০% নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। খাদ্য-পণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিদেশী ফলকে ২০১২ সালে বিলাস-পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এনবিআর। আগে যেখানে বিদেশী ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩%, সেটি বাড়িয়ে করা হয় ২০ শতাংশ। তার সাথে আমদানিতে ২৫% কাস্টমস ডিউটি, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি (এসডি) ২০%, ভ্যাট ১৫%, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ৫% এবং ৫% অ্যাডভান্সড ট্যাক্স (এটি) দিতে হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে ফল আমদানিতে ১১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ এক কেজি মাল্টা বা কমলা যদি বিদেশ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে কোনো আমদানিকারক কিনে আনেন সেই ১০০ টাকার উপর আরো ১১৩.৮০ টাকা সরকারকে দিয়ে সেটির মূল্য ২১৩.৮০ টাকা দরের ফল হিসেবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এর উপর কয়েক দিন আগে নতুন করে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো কমলা ও নাশপাতির শুল্কায়নের ভিত্তিমূল্য কেজি প্রতি ৪০ সেন্ট থেকে ৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৭০ সেন্ট করা হয়েছে। এতে সমহারে শুল্ক বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। এর ফলে কয়েক দিন ধরে অস্থির হয়ে উঠেছে ফলের বাজার।
ফল কিনতে পারছে না মানুষ : পাইকারি বিক্রেতা মো: আলাউদ্দিন নয়াদিগন্তকে বলেন, মানুষের চাহিদা থাকলেও দাম বেশি হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ পর্যাপ্ত ফল কিনতে পারে না। ফলে বাজারে অবিক্রীত ফলের পরিমাণ যেমনি বাড়ছে, তেমনি অনেক ফল নষ্টও হয়ে যাচ্ছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ফল ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় টিকে থাকাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চাইলেই ফলের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসবে। তিনি বলেন, ফল ক্রয়ে সর্বোচ্চ চাহিদা কমেছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, অল্প আয়ের মানুষরা সাধারণত ভ্যান থেকে ফল কিনেন। আগে যেখানে একজন ভ্যান ওয়ালা ৬-৮ ক্যারেট ফল বিক্রি করত, তারা এখন ২ ক্যারেটও বিক্রি করতে পারছে না।
এদিকে ভোক্তাদের অভিযোগ, সরকার বিদেশী ফলকে বিলাসপণ্য বানিয়ে উচ্চ শুল্ক আহরণের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। ফলে মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে পারছে না পরিবারের সদস্যদের।
লোকমান নামের এক ক্রেতার সাথে খুচরা ফলের দোকানে কথা হয় গত শুক্রবার। তিনি বলেন, আপেল আগে সর্বোচ্চ দেড় শ’ টাকা কেজি কিনতাম এখন সেটা আড়াই শ’ টাকার নীচে দেয় না। আবার তিন শ’ টাকাও চায়। মাল্টা ছিল এক শ’-দেড় শ’ টাকার মতো, সেটা এখন ২৭০ টাকা টাকার মতো। কমলা আগে ডজন হিসেবে কিনতাম, এখন সেটা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে আড়াই শ’ টাকায়। এত দাম দিয়ে মানুষ কিভাবে ফল খাবে। তাই আগে যা কিনতাম ওই টাকায় এখন অর্ধেক পাই।
ফলের দাম রাজধানী বন্দর নগরি নির্বিশেষে সব শহরেই বাড়ছে। বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী দেলোয়ার জানান, সেখানে ভালো মানের সবুজ আপেল সাড়ে ৩০০ টাকা এবং আনার ৩৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার অন্যান্য বাজারে এর দাম কেজি প্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি হবে।
পুষ্টিবিদদের মতে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন ৮০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে নাগরিকদের পুষ্টি চাহিদার অর্ধেকও স্থানীয়ভাবে পূরণ করা সম্ভব হয় না। এরপরও নিত্য চাহিদার ফলকে বিলাসপণ্য হিসেবে রীতিমতো উচ্চ শুল্ক-কর আহরণের ফলে এটিকে সাধারণ মানুষের ধরা ছোয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমদানি কমছে : বাংলাদেশে মূলত ফ্রেশ ফ্রুটস ও ড্রাই ফ্রুুটস এই দুই ক্যাটাগরিতে বিদেশ থেকে ফল আমদানি করা হয়ে থাকে। একাধিক আমদানিকারক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ মূলত মিসর, ভারত, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই দুই ক্যাটাগরির ফল আমদানি করে। প্রতি বছর বিদেশ থেকে গড়ে সাত লাখ টনের অধিক ফল আমদানি হলেও গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ফল আমদানি কমেছে। সেই অর্থ বছরে ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে প্রায় ৮০% হচ্ছে আপেল ও মালটা। আবার রমজানে সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে মাল্টা ও কমলার। এর পরে থাকে আপেলের চাহিদা।
ভারত পাকিস্তানের তুলনায় ৮ গুণ পর্যন্ত দাম বাংলাদেশে : গত শুক্রবার চট্টগ্রামের ফলমন্ডির পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি সবুজ আঙুর বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা দরে (২০ কেজির ক্যারেট ৪০০০ টাকায়), যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২৬০ টাকায়। আর প্রতি কেজি কালো আঙুর পাইকারিতে ২৬০ টাকায় (২০ কেজির ক্যারেট ৫২০০ টাকা) যা খুচরা বাজারে গড়ে ৩৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি কমলা পাইকারি বাজারে ১৬৮ টাকা (২৫ কেজির ক্যারেট ৪২০০ টাকা) দরে যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৬৫ টাকা দরে। প্রতি কেজি মাল্টা পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা দরে (২০ কেজি ক্যারেট ৪৪শ’-৪৫শ’ টাকা), যা খুচরায় গড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা দরে। প্রতি কেজি আনার পাইকারিতে ২২৫-২৭৫ টাকা দরে (২০ কেজি ক্যারেট ৪৫শ’-৫৫শ’ টাকা), যা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৩০০ টাকা দরে।
গতকাল প্রতিবেশী ভারতের বাজারে প্রতি কেজি কমলা বাংলাদেশী টাকায় ৯২ টাকা (ভারতীয় ৭০ রুপি), মাল্টা ৭৯ টাকা (ভারতীয় ৬০ রুপি), সবুজ আঙ্গুর ৯২ টাকা (ভারতীয় ৭০ রুপি), কালো আঙুর ৭৯ টাকা (ভারতীয় ৬০ রুপি), আপেল ২৬৩ টাকা (ভারতীয় ২০০ রুপি) এবং আনার ২০৩ টাকা (ভারতীয় ১৫০ রুপি) দরে বিক্রি হয়েছে।
এতে দেখা যায়, ভারতীয় খুচরা বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে মাল্টার দাম ৩.৫৪ গুণ, কমলার দাম ২.৪৩ গুণ, সবুজ আঙুরের দাম ২.৮২ গুণ, আর কালো আঙুরের দাম ৪.১৭ গুণ এবং আনারের দাম ১.৪৭ গুণ।
পাকিস্তানে বাংলাদেশী টাকায় প্রতি কেজি কমলার খুচরা দাম ৭৮ টাকা (১৯৯ পাকিস্তান রুপি), মাল্টা সাড়ে ৩১ টাকা (৭৯ পাকিস্তান রুপি), আনার ১১৮ টাকা (৩০০ পাকিস্তানি রুপি), সবুজ আপেল ছিল ৯৮ টাকা (২৪৯ পাকিস্তানি রুপি)। এতে দেখা যায়, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে কমলার দাম ৩.৩৯ গুণ, মাল্টার দাম ৮.৮৮ গুণ, আনারের দাম ২.৫৪ গুণ, আপেলের দাম ৩.৫৭ গুণ আর আঙুরের দাম ২.৭৯ গুণ।
বাংলাদেশে শুল্কায়নের জন্য যে ভিত্তিমূল্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হিসাব করে অধিকাংশ ফল ভারত ও পাকিস্তানে তার চেয়ে কম দামে খুচরা বাজারেই বিক্রি হয়। এভাবে অবাস্তব শুল্কায়ন ভিত্তিমূল্যে এসব ফলের আমদানি কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে মানুষ ফল কিনে খেতে না পারলেও সরকার খুব একটা বেশি রাজস্ব পাচ্ছে এমন নয়।
১০০ টাকার খেজুরে ১৪৩ টাকা শুল্ক : বাংলাদেশ ফ্রেুশ ফ্রুুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ কামাল নয়া দিগন্তকে জানান, ফ্রেশ ও ড্রাই ফ্রুটে অত্যধিক শুল্ক আরোপের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালে আসছে না ফলের মূল্য। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ্এক কেজি খেজুর ১০০ টাকায় কিনে এনে এখানে ১৪৩ টাকা শুল্ক-কর দিতে হচ্ছে। আবার কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানিকারকের ক্রয়মূল্যে শুল্কারোপ না করে নিজেদের নির্ধারণ করা দামে শুল্কায়ন করার ফলে শুল্ক অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এমনিতেই ফল আমদানিতে বাড়তি শুল্ক বহাল রয়েছে, এর ওপর নতুন করে নাশপাতি ও কমলার কেজিতে শুল্কায়ন ভ্যালু ৪০ সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ৭০ সেন্ট করা হয়েছে। তাতে ৯ কেজির নাশপাতির কার্টনে এখন ৫০০ টাকা বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কাস্টমস বলে খেজুর খাওয়ার দরকার নেই, ফল খাওয়ার দরকার নেই, তাহলে মানুষ খাবে কি? তিনি বলেন, বাড়তি শুল্ক ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে মাঝে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আগে যেখানে ২২ দিনে জাহাজ আসতো সেই জাহাজ চট্টগ্রাম পৌঁছতে ৪৫-৫০ দিন সময় যায়। ওই সময়ে মিসরের ফল আসতে যে দেরি হয় তার একটা প্রভাবও বাজারে আছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন