বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করে ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আলতামাশ কবীর বলেছেন, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হলে বিচার বিভাগ আর রইল কোথায়? যারা আইন হাতে তুলে নেয়, অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত।”
বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারের ডেইলি স্টার সেন্টারের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত ‘সবার জন্য সুবিচার’’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিচার বিভাগে রাজনৈতিক চাপের কথা উল্লেখ করে আলতামাশ কবীর বলেন,“বিচারপতিদের রাজনৈতিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে বিচারকাজ করতে।রাজনৈতিক চাপ থাকবেই। এটি চলমান একটি বিষয়। এই রাজনৈতিক চাপ মোকাবেলা করেই সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।” ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রাজনৈতিক প্রভাব বলতে গেলে তেমন নেই বলেও জানান তিনি।
ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, “মানুষ যদি বিচারের কাছে আসতে না পারে, তবে বিচারকে যেতে হবে মানুষের কাছে। এ জন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে জ্ঞান ও সচেতনতা বাড়ানো।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে এ আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. সুলতান হাফিজ রহমান। এ ছাড়া আলোচনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আইনুন নিশাত।
প্রধান আলোচক হিসেবে ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, বলিষ্ঠ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু বিচারব্যবস্থার প্রসার ছাড়া সুবিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আর এ জন্য বিচারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণরে পাশাপাশি নাগরিকের চেতনা জাগ্রত করা, সচেতনতা বাড়ানো ও ক্ষুদ্রতা জয় করতে হবে।
আলতামাশ কবীর বলেন, “ভারতে প্রান্তিক পর্যায়ে বিচারব্যবস্থা ছড়িয়ে দিতে ‘প্রাথমিক আইনি সহায়তা কেন্দ্র’ এবং গ্রাম্য আদালত গড়ে তুলেছি। বাংলাদেশের আদালতের মামলাজট কমাতে এটা উদাহরণ হতে পারে।” এ সময় তিনি ভারতের ঝাড়খণ্ডের একটি লোক আদালতে এক দিনে ২৯ লাখ মামলা মীমাংসার উদাহরণ তুলে ধরেন।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধান এবং ১৯৪৯ সালের ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো প্রায় একই রকম। সংবিধান কর্তৃক স্বাধীতার মৌলিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব হলো সর্বোচ্চ আদালতের। একজন বিচারপতিকে তার ক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য নাগরিকের স্বাধীনতা, সমতা ও সার্বভৌমত্ব থাকতে হবে।
সুবিচারকে নাগরিকের আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার উল্লেখ করে ভারতের সাবেক এ প্রধান বিচারপতি বলেন, “শুধু বড় মাপের মানুষদের জন্য নয়,বিচার অবশ্যই সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। সবার জন্য সুবিচার নির্ভর করে সরকারের পরিকল্পনা বিভাগ, সরকারের সদিচ্ছা, গণমাধ্যম এবং তথ্যপ্রযুক্তির ওপর।”
সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ““যেখানে ন্যায়বিচার থাকবে, সেখানে সুশাসন ও মানবাধিকার থাকতে হবে। মানবসত্তার মহিমা সমুন্নত রাখার বিষয়ে আমাদের সংবিধানে বলা আছে। যখন প্রত্যেক ব্যক্তি সার্বভৌমত্ব পায়, তখন তা ক্রমশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে পরিণত হয়।”
নিজস্ব অবস্থান থেকে পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করতে হবে তরুণদের্- এমন আহ্বান জানিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, নিজের ক্ষমতা কতটুকু তা জানতে হবে এবং তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক প্রশ্নের উত্তরে আলতামাশ কবীর বলেন, বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন ও অভ্যন্তরীণ আইন যদি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, তবে অভ্যন্তরীণ আইন প্রাধান্য পাবে।
বিচারপ্রার্থী ও আদালতের ভাষা যদি ভিন্ন হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার কীভাবে নিশ্চিত হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমাদের দেশে সব জেলা আদালতে স্থানীয় ভাষায় মামলা পরিচালিত হয়। হাইকোর্টেও মাঝে মাঝে বিচারপ্রার্থীর ভাষায় মামলা পরিচালিত হয়ে থাকে। শুধু সুপ্রিম কোর্টে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় মামলা পরিচালিত হয়।”
এর আগে বক্তব্যের শুরুতে তিনি বাংলাদেশের ট্রাফিক জ্যামের বিষয়টি তুলে ধরে রসিকতা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতোই ঘনবসতি ভারতে, কিন্তু সেখানে এত যানজট নেই। ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আসার পথে ঢাকার যানজটের অভিজ্ঞতা পান।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজমালুল হক কিউসি, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, জানিপপে’র চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রমুখ।
এর আগে বেলা পৌনে তিনটায় ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আলতামাশ কবীর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনসহ আপিল বিভাগের বিচারপতি ও আইনজীবী সমিতির নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
নতুন বার্তা
পাঠক মন্তব্য
মোদ্দা কথা হইল মজলুম, ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ তার অধীকার ফিরে পাওয়ার জন্য আদালতের ধারস্থ হয়। আদালতের বিচারকেরা যদি জালেম দ্ধারা নিয়োগ প্রাপ্ত হয় এবং জালেমের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য নির্দেশিত হয় তাহলে মজলুম ক্ষতিগ্রস্থরা আদালতে যাবে কেন? কারণ সে তো জানে জালেম দ্ধারা প্রতিষ্টিত আদালত থেকে কি রায় আসবে। মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিচারালয়, সেখানে গিয়ে মানুষ যখন ন্যায় বিচার তথা তার অলীকার থেকে বঞ্চিত হয় তখন বিচার প্রার্থীরা নিজেরাই বিচারক বনে যায় এবং নিজের হাতে তোলে নেয় যার নাম প্রতিশোধ।
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন