কাগজে-কলমে শতভাগ কাজ দেখিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের ৩ কোটি টাকা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রেখেছেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনিরুজ্জামান সরকার। গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি (টিআর-কাবিটা-কাবিখা প্রকল্প) বাস্তবায়নের নামে অনিয়ম-দুর্নীতি করে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। ঘুষবাণিজ্যের জন্য রেখেছেন ভাড়াটে লোকও। নানান অনিয়মের অভিযোগে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর তাকে বদলির আদেশও দেয়। কিন্তু ওই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি উল্টো মামলা করেছেন।
মিঠাপুকুর পিআইওর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জুনের আগে ব্রিজ নির্মাণ, টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের কাজ কাগজে-কলমে শতভাগ দেখিয়ে বিল পাস করে ট্রেজারি অফিসের মাধ্যমে পিআইও নিজ অ্যাকাউন্টে প্রায় ৩ কোটি টাকা রেখেছেন পিআইও মনিরুজ্জামান সরকার। যার অ্যাকাউন্ট নম্বর ৫১...০০৪৩, এনআরবিসি ব্যাংক মিঠাপুকুর শাখা। তবে ৩০ জুনের পর প্রকল্পের কিছু টাকা ওই অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে চেয়ারম্যানদের দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পে ১০ থেকে ২০ শতাংশ কাজও বাস্তবায়ন না হলেও রহস্যজনক কারণে প্রকল্পের টাকা ছাড় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুকুরেরহাট ডিগ্রি কলেজের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় টিআরের ৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের চেয়ারম্যান ছিলেন সহকারী অধ্যাপক শওকত হোসেন। তাকে দুই দফায় ৩ লাখ টাকার কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শওকত হোসেন। শুকুরেরহাট ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসায়ও উন্নয়নের জন্য টিআরের ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পেও দুই দফায় ১ লাখ ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। নিশ্চিত করেছেন ওই প্রকল্পের চেয়ারম্যান সহকারী শিক্ষক আবদুল কাইয়ূম।
শুধু ওই দুই প্রকল্পের নয়, ঠাকুরবাড়ি বাজার হতে পূর্ব জামে মসজিদের মাঠে মাটি ভরাটের জন্য ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা, দুর্গাপুর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে মাটি ভরাট ও উন্নয়নের জন্য কাবিখা ও কাবিটার তিন দফায় ২০ টন ১৭৪ কেজি গম এবং ২ লাখ টাকা, বড়বালা ইউনিয়নের তাজুলের বাড়ি হতে খালেকের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ৩ লাখ ৫ হাজার, রানীপুকুরের বুজরুক নূরপুর বাড়ি হতে মনজুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা ভরাটের জন্য ৩ লাখ, ইমাদপুর ইউনিয়নে মসজিদপাড়া পাকা রাস্তা হতে চড়পাড়াগামী রাস্তা সংস্কারের জন্য ৫ লাখ, বড়বালা ইউনিয়নের রতনের বাড়ি হতে মাঝিপাড়া ঘাট পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ৫ লাখ, উপজেলা পরিষদ রাস্তা নির্মাণের জন্য ৪ লাখ টাকা এবং উপজেলা পরিষদ মাঠে মাটি ভরাটের জন্য ১৩ টন গম বরাদ্দসহ অন্তত আরও ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে নয়ছয় কাজ করে টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পিআইও নিজ অফিস খরচের কথা বলে সাবেক এমপির কাছ থেকে টিআর ও কাবিটার ১৪ লাখ টাকা এবং কাবিখার ১৩ টন গম বরাদ্দ নিয়েছেন। যার কাজ দেখানো হয়েছে উপজেলা পরিষদের সংলগ্ন রাস্তা নির্মাণ ৪ লাখ টাকা, ইমাদপুর ইউনিয়নের মসজিদপাড়া পাকা রাস্তা হতে চড়পাড়াগামী রাস্তা সংস্কার ৫ লাখ, বড়বালা ইউনিয়নের রতনের বাড়ি হতে মাঝিপাড়া ঘাট পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৫ লাখ এবং উপজেলা পরিষদ মাঠে মাটি ভরাট ১৩ টন গম। এসব প্রকল্পের চেয়ারম্যান করা হয় সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্যদের। তবে এসব কাজ না করে চেয়ারম্যান মেম্বারদের মাধ্যমে প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন পিআইও। যদিও চেয়ারম্যানদের দাবি, তারা প্রকল্পের টাকা ব্যাংক থেকে তোলার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
ইমাদপুর ইউনিয়নের মসজিদপাড়া পাকা রাস্তা হতে চড়পাড়াগামী রাস্তা সংস্কার প্রকল্পের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলামকে। তিনি বলেন, শুনেছিলাম ওই রাস্তায় এমপির একটি বরাদ্দ ছিল। তবে কত টাকা বরাদ্দ তা জানি না। দেশের সরকার বদলের পর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পিআইওর কার্যালয়ে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ লাখ ২২ হাজার এবং গেল অর্থবছরে একই কাজের জন্য তিন দফায় বরাদ্দ বাড়িয়ে হয় ৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসের একজন স্টাফ জানান, অফিসে পিআইও তিন দফায় প্রায় ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়েও কোনো কাজেই করেননি। ওই স্টাফ আরও জানান, পিআইও টিআর প্রকল্প থেকে দুই দফায় কম্পিউটার সেট কেনার জন্য ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৯৭ টাকা বরাদ্দ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। আবার গেল মাসে মন্ত্রণালয় থেকে কম্পিউটার সেট কেনার জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়ে এসেছেন।
পিআইও মনিরুজ্জামান ঢাকা থেকে সোহেল রানা নামে এক ব্যক্তিকে অফিসে এনে ঘুষবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার কারণে অফিসের অন্য কেউ কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। কয়েক দিন আগে অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সোহেল রানা অফিসের ভেতর বসে ফাইলপত্র ঘাঁটছেন। কোন পদে চাকরি করেন? জানতে চাইলে সোহলে রানা বলেন, ‘আমি অফিসের কেউ না। একসময় মনিরুজ্জামান ও আমি ঢাকার একটি প্রজেক্টে চাকরি করেছিলাম। প্রজেক্টটা শেষ হলে আমি বেকার হয়ে যাই। পিআইও মনিরুজ্জামানের এখানে চাকরি হলে আমাকে নিয়ে আসেন। অফিসে অতিথি এলে আমি চা-পান এনে দিই। আমাকে মাসে ৮ হাজার টাকা ভাতা দেন।’ তবে অফিসে ঘুষ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করেন সোহেল রানা।
জানা গেছে, মনিরুজ্জামান সরকারের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের চিলমরই উপজেলায়। তিনি ২০১১ সালের ৭ জুলাই পিআইও (অ্যাডহক) হিসেবে যোগদান করেন ঠাকুরগাঁওর বোদাগঞ্জ উপজেলায়। যোগদানের ছয় মাস পর পূর্ণাঙ্গ পিআইও হন তিনি। এরপর তিনি বদলি হন কাহারোল উপজেলায়। দুর্নীতি করার কারণে তৎকালীন এমপি মনোরঞ্জনশীল গোপাল সেখানে বেশি দিন রাখেননি। তৃতীয় স্টেশন হিসেবে তিনি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা পান।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ‘২০১৪ থেকে ১৬ সালের দিকে তিনি নবাবগঞ্জ উপজেলায় থাকাকালে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার টিআর ও কাবিখার বিশেষ প্রকল্প নিয়ে আসেন। সেই প্রকল্পের কাজ না করে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেন। ওই সময়ে বিষয়টি জানাজানি হলে বগুড়ার দুদকের এক কর্মকর্তা তদন্তের দায়িত্ব পান। পরে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের কিছু কাজ করেন তিনি। এরপর পিআইও তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মাধ্যমে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করেন। তিনি ওই সময়ে ডিজির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে সারা দেশের পিআইওদের বদলিবাণিজ্য করতেন। এসব করে ওই সময়ে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন মনিরুজ্জামান।
সূত্রমতে, পিআইও মনিরুজ্জামানের মাসিক বেতন পান ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। চাকরি জীবনের শুরুতে তিনি কিছু করতে না পারলেও বিগত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে তিনি রংপুর নগরীর রাধাবল্লভ এলাকায় কোটি টাকায় জমি কিনে তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের চিলমারীতে থাকার জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। পাঁচ-সাতটি মাইক্রোবাস কিনে ভাড়া দিয়েছেন। নিজ এলাকায় তার আছে তেলের পাম্পও। কুড়িগ্রাম শহরের প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বিশাল ওষুধের দোকান দিয়েছেন। নিজ অফিসে যাতায়াত করেন অর্ধকোটি টাকার গাড়িতে। অফিস টাইমের বাইরে ঘোরেন সাড়ে ৪ লাখ টাকার মোটরসাইকেলে চড়েন।
সার্বিক বিষয়ে রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন বলেন, ‘ওই পিআইওর বিরুদ্ধে কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো ছাড় নেই।’
মিঠাপুকুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘প্রকল্পের টাকা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রাখার বিষয়ে যাচাই না করে কিছু বলতে পারছি না, তবে বদলি ও মামলা বিষয়টি অভ্যন্তরীণ। এর পাশাপাশি প্রকল্পে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ নেই। যদি হয়ে থাকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।’
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, ‘প্রকল্পের সরকারি টাকা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রাখার কোনো সুযোগ নেই। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে তদন্ত করে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া ওই পিআইওসহ আরও কিছু পিআইওর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো তদন্ত করতে দুদককে রেফার্ড করেছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন