ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন খাতভিত্তিক বেশ কিছু কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু পরিবহনের মতো বড় একটি খাত সংস্কারে কোনও কমিশন গঠন করা হয়নি। ফলে এই খাতের অব্যবস্থাপনা দূর করা, শৃঙ্খলা আনা এবং উন্নয়নে একটি স্বতন্ত্র সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পরিবহন খাতের সংস্কার ছাড়া কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না। তাই সরকারকে এই খাতের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা নতুন কিছু নয়, বেশ পুরনো অভিযোগ। শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সুফল মেলেনি। আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকায় পরিবহন খাতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বলয় গড়ে ওঠে। সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হন কয়েকজন নেতা। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন সাধারণ পরিবহন মালিক, শ্রমিকরা ও যাত্রীরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যাওয়া এসব নেতা গাঢাকা দিয়েছেন। পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে নতুন নেতাদের হাতে। তারা কিছু কর্মসূচি নিলেও ব্যাপক সংস্কার ছাড়া পরিবহনের অব্যবস্থাপনা দূর করা, শৃঙ্খলা আনা এবং উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
পরিবহন নেতাদের মতে, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিরও মহাসচিব ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর উভয় সংগঠনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগমুহূর্তে দেশ ছাড়েন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। দেড় দশকে তার গড়ে তোলা বলয়ের নেতারাও চলে যান আত্মগোপনে। গত ১৩ আগস্ট থেকে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপিপন্থি পরিবহন নেতারা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি হয়েছেন এম এ বাতেন আর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সাইফুল আলম। তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন কমিটির নিবন্ধনের আবেদন এবং কমিটি গঠনের নির্বাচনি ফলাফল বাতিল করে দিয়েছে শ্রম অধিদফতর। তবে এই কমিটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সমিতির কার্যালয়, চলছে সমিতির কার্যক্রম, মিটিং-সভা। কমিটির নেতারা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সভায়ও অংশ নিচ্ছেন। সাইফুল আলমদের কমিটি পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা কার্যত কোনও সংস্কার নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথমে চাঁদাবাজি বন্ধ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও মনোদৈহিক ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে আন্তজেলা ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমানোসহ আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সমিতির পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে, তা যথেষ্ট নয়। আবার সমিতির এই কমিটিও শ্রম অধিদফতর অনুমোদিত নয়। ফলে পরিবহন খাত এতটাই বিস্তৃত যে এখানে অন্যান্য খাতের মতো সংস্কার কমিশন করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে খাতটির ব্যাপক সংস্কারে একটা জনবান্ধব নীতিমালা তৈরি এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা জরুরি। যাতে পরিবহন খাতকে কেউ কুক্ষিগত করতে কিংবা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এম এ বাতেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকার কী কারণে সংস্কার কমিশন গঠন করছে না, তা আমরা জানি না। আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষে। তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সেটা হতে হবে মালিকদের নিয়ে। সরকারের কমিশনে কারা থাকে তা নিয়ে আমাদের কোনও ধারণা নেই। তবে পরিবহন খাতে সংস্কার কমিশন হলে, ভালো কিছু হলে, আমরা অবশ্যই সেটা চাই।
নতুন কমিটির শ্রম অধিদফতরের অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নতুন কমিটি গঠন করেছি। আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। কালকেও (শনিবার) আমাদের তলবি সভা আছে, সেখানে শ্রম অধিদফতরের প্রতিনিধি থাকবেন।
একাধিক পরিবহন শ্রমিক (চালক ও হেলপার) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দলটির রাজনীতি করা নেতাদের কাছে পরিবহন খাত জিম্মি ছিল। তারা আমাদের তাদের হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। সরকার পতনের পর এই খাতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিএনপিপন্থিরা। ফলে পরিবহনে চাঁদাবাজি কিছুটা কমলেও পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। সমিতির পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তার সুফলও মিলছে না। ব্যাপক সংস্কার ছাড়া আসলে পরিবহন খাতের কোনও উন্নতি হবে না, কোনও সুফলও পাওয়া যাবে না।
আতিক নামে ভিক্টোরিয়া ক্লাসিক পরিবহনের একজন বাসচালক বলেন, ‘সরকার পাল্টাইছে। কিন্তু পরিবহন খাতে কোনও পরিবর্তন আসেনি। আগে নিয়ন্ত্রণ করতো আওয়ামী লীগ নেতারা, এখন বিএনপি নেতারা। এটাই পরিবর্তন দেখছি আমি। পরিবহন খাতের সংস্কারে সরকার উদ্যোগ নিলে হয়তো আমরা সুফল পেতাম। সরকারিভাবে সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে ভালো কিছু হবে না, যেমন আছে তেমনই থাকবে।’
প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন আরও কয়েকটি পরিবহনের বাসচালক এবং যাত্রীসেবা নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, আগের কোনও সরকারই পরিবহন খাতের সংস্কার করেনি। আগামীতেও কোনও সরকার করবে বলে মনে হয় না। তাই এই সরকার যেহেতু বিভিন্ন খাতের সংস্কারে কমিশন করেছে, পরিবহন খাতের সংস্কারেও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। না হয় কোনও না কোনও গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি থাকবে পরিবহন খাত, হাতিয়ার হবেন তারা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খাতে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। এই সরকারের ১০০ দিনেও কাঠামোগত কোনও পরিবর্তন আসেনি, বিদ্যমান অবস্থায় তা আসার সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু গত ১৫ বছরে মালিকরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাদের মতো করে বাস ভাড়া ঠিক করেছে। যার পুনর্গঠন হওয়া জরুরি। যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির বদলে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার করা হয়েছে গণপরিবহনকে। পরিবহনকে যাত্রীবান্ধব করতে হবে। এই খাতের সামগ্রিক সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। সেটি শুধু আমলাদের দিয়ে করলে হবে না, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে করতে হবে।
আশিকুর রহমান নামে একজন বাসযাত্রী বলেন, ঢাকা তো বটেই, সারা দেশের পরিবহন খাতের বেহাল দশা। দেখার কেউ নেই, যেন এই খাতের উন্নয়নে সবাই উদাসীন। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে অনেক কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু পরিবহন খাতের মতো এত বড় একটি খাত নিয়ে এতদিনেও কোনও উদ্যোগ নেয়নি। ফলে এই খাতের সংস্কার তো দূরের কথা, খাতটি নিয়ে কোনও আলোচনাও হচ্ছে না— এটা খুবই দুঃখজনক। যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন নিশ্চিত করতে সংস্কার কমিশন করে একটি নীতিমালা তৈরি এবং নানা সংস্কার আনা প্রয়োজন। আমরা আশা করি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ সংস্কারের দায়িত্ব নেওয়া এই সরকার সেই উদ্যোগ নেবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন