ঔপনিবেশিক মানসিকতা নিয়ে আর চলতে চান না পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তারা আর শোষকের ভূমিকায়ও থাকতে চান না। এই ধারা থেকে বেরিয়ে জবাবদিহিমূলক ও জনমুখী পুলিশের ভূমিকায় নিজেদের নিয়োজিত করতে চান। এ জন্য ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পুলিশ আইন ও পিআরবিসহ অন্যান্য বিধি-বিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার চেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ছাড়া জনপ্রত্যাশা পূরণে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর বিধি-বিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং যুগোপযোগী নতুন আইন ও বিধি প্রণয়নেরও প্রস্তাব করেছে। পাশাপাশি পুলিশ ফোর্সের ব্যবস্থাপনা, গ্রেপ্তার, আটক, তল্লাশি, জব্দসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন গাইডলাইন প্রণয়নেরও প্রস্তাব করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সংস্কারে গঠিত কমিশনের কাছে এ ধরনের একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। কমিশন পুলিশের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের বাইরেও পুলিশ সংস্কারে ২৪ হাজারেরও বেশি মতামত পেয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। এসব মতামতের মধ্যে ঔপনিবেশিক মানসিকতা দূর করে জবাবদিহিমূলক জনমুখী পুলিশ গড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অংশীজনের পক্ষ থেকে। পুলিশকে যেন আর কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য দেড়শ বছরের পুরনো আইনের সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া
হয়েছে অংশীজনের মতামতে। অপরাধ
বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে পুলিশ তৈরি হয়েছিল দমন-পীড়নের জন্য। সেই জায়গা থেকে বদল হয়ে স্বাধীন দেশের পুলিশ হবে স্বাধীন এবং জনগণের। পুলিশকে সেবার মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দল পুলিশকে নিজস্ব লাঠিয়াল হিসেবে যাতে ব্যবহার করতে না পারে, আইনে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে কেউ যদি পুলিশকে দলীয় লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে নতুন আইন তাদের সুরক্ষা দেবে। শারীরিক ও আইনগত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মানসিকভাবে প্রশিক্ষিত করে সেবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সঠিক পদ্ধতি সংস্কারে যুক্ত করতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ব্রিটিশ আমলে গঠিত পুলিশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ব্রিটিশ শাসনকে পাকাপোক্ত করা। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত সেই আইনি কাঠামোতেই চলে আসছে বাংলাদেশ পুলিশ। ফলে বিগত সময়ে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ শোষকের ভূমিকা পালন করেছে জনগণের সঙ্গে। এতে পুলিশ বাহিনী জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মোকাবিলায় পুলিশ জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এতে পুলিশ বাহিনী চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ। ভবিষ্যতে পুলিশ আর জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না। জনবান্ধব পুলিশ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে চায়। যে কারণে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পুলিশ আইনসহ অন্যান্য বিধি-বিধানের সংস্কার চায় এ বাহিনী। এ ছাড়া যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন আইন ও বিধান প্রণয়ন চায়। আইনি কাঠামোর সংস্কার ছাড়া পুলিশের মৌলিক সমস্যা দূর করা সম্ভব নয় বলে মত পুলিশ কর্মকর্তাদের।
পুলিশ যে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের কোথাও তা বলা নেই। অথচ পুলিশ সেবাধর্মী বাহিনী। আবার ১৮৬১ সালের আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক পুলিশ কর্মকর্তা সর্বদা কর্মরত (অন ডিউটি) বলে বিবেচিত হবে। যে কোনো সময় সাধারণ পুলিশ জেলার যে কোনো স্থানে তাকে পুলিশ কর্মকর্তা নিযুক্ত করা যাবে। অর্থাৎ যে কোনো পুলিশ সদস্য ২৪ ঘণ্টায় অন ডিউটি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে পুলিশ আইনেই। এই ধারাতেও সংস্কার চায় পুলিশ। উন্নত বিশ্বে ৮ ঘণ্টার বেশি সরকারি দায়িত্ব পালন করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে নিয়মমাফিক ওভারটাইম হিসেবে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তা পান না। ৮ ঘণ্টার বেশি অতিরিক্ত ডিউটি করানো হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য যাতে আর্থিক সুবিধা পান পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে সুপারিশ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তরের ওই প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ ও জনগণের সংখ্যানুপাত (প্রায় ১ : ৮০০) এবং পুলিশের কাজের ব্যাপকতা বিবেচনা করলে পুলিশের প্রায়শই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দৈনিক ৮ ঘণ্টার অধিক সময় দায়িত্ব পালন করতে হয়। যা পুলিশ সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এতে প্রত্যাশিত সেবা প্রদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর জনগণের সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পুলিশের কর্মকাণ্ডে বহিঃ ও অভ্যন্তরীণ তদারকি ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, পুলিশের অপেশাদারি কর্মকাণ্ড রোধে পুলিশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা শাখা সুবিন্যস্তকরণ, পুলিশের নারী সদস্যদের যৌন হয়রানি, জেন্ডার বৈষম্য ও অপেশাদার আচরণ প্রতিরোধ, চাকরিবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন এবং আধুনিক দক্ষতা-মাপক সূচক নির্ণায়নের মাধ্যমে পুলিশের কাজের মূল্যায়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পুলিশের পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি করতে মানবাধিকার, জেন্ডার, পুলিশের অপারেশনাল ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে অধিকতর উন্নতমানের প্রশিক্ষণ; অপরাধ তদন্তে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ট্রান্সন্যাশনাল ও অর্গানাইজড ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, প্রণোদনা ও শাস্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ, আধুনিক ও যুগোপযোগী করা; বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি; তথ্য বিভ্রান্তি ও গুজব নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; বিভাগীয় ও ক্ষেত্রবিশেষে জেলা পর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন; বিশেষায়িত সাইবার ইউনিট গঠন এবং পরিবেশ পুলিশসহ সময়ের প্রয়োজনে অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট গঠনেরও প্রস্তাব করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ছাড়া পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ করতে এবং পদলেহনের সংস্কৃতি থেকে বের করে আনতে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব সফররাজ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এবং ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধান সেকেলে। এতদিন এর কোনো বড় পরিবর্তন করা হয়নি। পুলিশ আইন ও বিধিমালা সংশোধনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, যাতে পুলিশ বাহিনীকে সময়োপযোগী জনমুখী ও সেবামুখী করে তোলা যায়।
সফররাজ বলেন, কেমন পুলিশ চাইÑ জানতে আমরা ডিজিটালি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট ছকে সবার মতামত দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমরা ২৪ হাজারেরও বেশি মতামত পেয়েছি। আমরা আশা করি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করতে পারব।
জানা গেছে, মব নিয়ন্ত্রণে শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশকে জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালা ব্যবহার করার জন্য সুপারিশ করতে যাচ্ছে পুলিশ সংস্কার কমিশন, যাতে অনাকাক্সিক্ষত রক্তক্ষয়সহ প্রাণহানি ঠেকানো যায়।
শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের শক্তি প্রয়োগের নীতিমালায় সর্বনিম্ন শক্তি প্রয়োগ, সমানুপাতিক হারে শক্তি প্রয়োগ, যৌক্তিক বা আইনসিদ্ধভাবে শক্তি প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। এই শক্তি প্রয়োগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘের শক্তি প্রয়োগের নীতিমালায় যারা শক্তি প্রয়োগ করছেন শুধু তারা নন; যারা পরিকল্পনাকারী, কমান্ডার বা নির্দেশদাতা এবং প্রশিক্ষণ প্রদানকারীÑ তারাও এর দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়েন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন