একসময় পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী ছিলেন শাহরিয়ার আলম। ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে এসে যেন পেয়ে বসেন এক ‘রাজত্ব’। প্রথমে রাজশাহী-৬ আসনের (বাঘা-চারঘাট) সংসদ সদস্য (এমপি), পরে হন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তাঁর ক্ষমতার দাপটে বিরোধী দলের পাশাপাশি রেহাই পাননি নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও।
শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজি ও জমি দখলের অভিযোগ। টাকার নেশায় চারবার অবৈধভাবে বাঘা উপজেলা দলিল লেখক সমিতির কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। আর সেই কমিটির চাঁদাবাজির জেরে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের এক নেতা প্রাণও হারিয়েছেন।
এমপি হওয়ার পর শাহরিয়ার আলম গত ১৫ বছরে গড়েছেন কৃষি খামার, টেলিভিশন চ্যানেল, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে তাঁর শিল্পকারখানার সংখ্যা ছিল ১৯। ২০২৪ সালে শিল্পকারখানা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫টিতে।
শাহরিয়ার আলম মোট চারবার এমপি হয়েছেন। দশম ও একাদশ সংসদে দুইবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দ্বাদশ সংসদের এমপি হলেও মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গত ৯ সেপ্টেম্বর শাহরিয়ার আলম, তাঁর সাবেক ও বর্তমান স্ত্রী এবং ছেলের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন। এ কারণে নানা অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
রাজনৈতিক উত্থান
২০০৮ সালের আগে বাঘা ও চারঘাটে শাহরিয়ার আলমের কোনো বাড়ি ছিল না। পৈতৃক নিবাস রাজশাহী শহরের শিরোইল হলেও বাবা মো. শামসুদ্দিন রেলওয়ের কর্মচারী হওয়ায় তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে। রাজশাহীতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের পর প্রথমে কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এরপর গড়ে তোলেন বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা। রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা থেকে ২০০৮ সালে বাঘা ও চারঘাট এলাকায় দরিদ্রদের মধ্যে বস্ত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ শুরু করেন। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাদ দিয়ে ২০০৮ সালে শাহরিয়ার আলমকেই মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ।
২০০০ সালে উপনির্বাচনে এমপি হন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. রাহেনুল হক। ২০০৮ সালে তিনিও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ২০১৪ ও সর্বশেষ নির্বাচনেও রাহেনুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। রাহেনুল হকের দাবি, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তাঁকে হারানো হয়েছে। শাহরিয়ারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাইরের একজন এসে এখানে ১৫ বছর রাজত্ব করে গেছেন। আওয়ামী লীগে ভাঙন ঘটিয়েছেন।’
আওয়ামী লীগে দাপট
শাহরিয়ার আলম রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের কোনো পদে ছিলেন না। ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। পরে ২০১৪ সালে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এর পর থেকে সব পর্যায়ে নিজের লোককে কমিটিতে আনতে থাকেন। গত বছরের ২৭ মে চারঘাট ও বাঘা উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনের কথা জানতেনই না বাঘা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি ইকুল হাসনাত মাহমুদসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা। তাঁদের অনুপস্থিতিতে কমিটি ঘোষণা করা হয়। ইকুল হাসনাত মাহমুদের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় কথা বলা যায়নি। তবে সে সময় তিনি বলেছিলেন, তাঁকে সম্মেলনের ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। তাই তিনি ইউনিয়ন কমিটির কাউকেই জানাতে পারেননি। তাঁদের বাদ দিয়েই সম্মেলন করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশেই এমনটা হয়েছে।
নির্যাতন-মামলা
শাহরিয়ার আলমের সময়ে আধিপত্য বিস্তারসহ নানা বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোন্দল দেখা দেয়। এর জের ধরে কয়েক বছরে দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব মামলা চলাকালে নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে থাকতেন। এসব মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি মামলা করিয়েছিলেন শাহরিয়ার আলম। এসব মামলায় অনেকেই জেল খেটেছেন। অনেকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাছ আলী। একসময় শাহরিয়ার আলম আক্কাছ আলীকে সঙ্গে রাখলেও পরে তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ২০১২ সালে বিভিন্ন অভিযোগে শাহরিয়ার আলমের লোকজনের মামলায় তিনি জেল খাটেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে একাধিক। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। দলিল লেখক সমিতির চাঁদাবাজির জেরে গত ২২ জুন বাঘায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম নিহত যান। ওই ঘটনায় শাহরিয়ার আলমের অনুসারী উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহিনুর রহমান আক্কাছ আলী, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজুল ইসলামসহ ৪৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে তাঁদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
১৫ বছরের বেশির ভাগ সময় বাঘা ও চারঘাটে প্রকাশ্যে কর্মসূচি করতে পারেনি বিএনপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হত্যার হুমকির’ অভিযোগে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদের (চাঁদ) বিরুদ্ধে ২৬টির মতো মামলা হয়। তিনিই বিভিন্ন সভায় শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এ কারণে আবু সাঈদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন শাহরিয়ার আলম। আবু সাঈদ বলেন, তিনি সাত বছরের মতো জেল খেটেছেন। এ সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে প্রায় ৮০টি। তিনিসহ এলাকার লোকজনকে শান্তিতে থাকতে দেননি। অথচ শাহরিয়ার এখানকার কেউ ছিল না।
দলিল লেখক সমিতি ঘিরে চাঁদাবাজি
পাঁচ বছর ধরে অবৈধভাবে বাঘা সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ের দলিল লেখক সমিতির কমিটি গঠন করে দিচ্ছিলেন শাহরিয়ার আলম। তাঁর করে দেওয়া পকেট কমিটি মাসে অর্ধকোটি টাকার মতো চাঁদা আদায় করত। শাহরিয়ার আলম এই টাকার একটা বড় অংশ নিতেন বলে দলিল লেখক ও আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেন। এই বিতর্কিত কমিটির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আরেকটি পক্ষ মাঠে নামলে গত জুনে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল নিহত হন। এ ঘটনায় খুনের হুকুমদাতা হিসেবে রাজশাহীর সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান, রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. লায়েব উদ্দীন, বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্কাছের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দেন শাহরিয়ার। শাহরিয়ারের বক্তব্য ঘিরে ১৫ বছরে প্রথমবারের মতো রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্পদ
গত ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্পদ গড়ে তুলেছেন শাহরিয়ার। এর মধ্যে নর্থবেঙ্গল অ্যাগ্রো ফার্মস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের একটি খামার আছে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে। সেখানে শাহরিয়ার আলমের ৪০ বিঘার বেশি জমি রয়েছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায় ২০১০ সালে ২৫ বিঘা জমি কিনে খামার গড়েছেন। এ ছাড়া লালমনিরহাটে কালীগঞ্জ উপজেলায় ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কেনেন, সেখানেও গড়ে তোলা হয় খামার। ২০১১ সালে রাজশাহী নগরের পদ্মা আবাসিক এলাকায় তিন একরের বেশি জায়গায় বারিন্দ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন শাহরিয়ার আলম। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘দুরন্ত টেলিভিশন’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর। এটি শাহরিয়ার আলমের মালিকানাধীন রেনেসাঁ গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বারিন্দ মিডিয়া লিমিটেডের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার গুলশানে তাঁর নিজের নামে দুটি ও ছেলের নামে একটি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট আছে।
শাহরিয়ার আলমের দখলবাজি
শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন স্থানে বেশি দামের জমি কম দামে কিনে দখল করার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালে চারঘাটের লিলি সিনেমা হলের ৩৭ শতক জমি মাত্র ৫০ লাখ টাকায় কেনেন শাহরিয়ার আলম। হলের কয়েকজন মালিক জানান, হলসহ জমিটি ঢাকার এক প্রতিষ্ঠান কিনতে চেয়েছিল; কিন্তু শাহরিয়ারের লোকজনের বাধায় ঢাকার ওই প্রতিষ্ঠান কিনতে পারেনি। শাহরিয়ার আলম সেখানে পোশাক কারখানা করার কথা বলে ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কম দামে জমি কিনে নেন।
শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে এক পেট্রলপাম্পের মালিকের কাছ থেকে ৪১ বিঘা জমি কিনে সাড়ে চার কোটি টাকা কম দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী বাঘা পেট্রলপাম্পের মালিক গোলাম মোস্তফা বলেন, গোদাগাড়ীতে শাহরিয়ারের খামারবাড়ির জমিটি আগে তাঁর ছিল। ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য ২০২০ সালে জমিটি বিক্রি করতে চাইলে দাম ওঠে মোট ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। একজন বায়নাও করেন। শাহরিয়ার বিষয়টি জানতে পেরে তাঁর কাছে জমি কেনার প্রস্তাব দেন এবং ব্যাংকঋণ পরিশোধেরও দায়িত্ব নেন। তিনি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেন এবং জমি নিবন্ধনের সময় ২৫ লাখ করে দুই দফায় ৫০ লাখ টাকা দেন। এখনো তিনি তাঁর কাছে সাড়ে ৪ কোটি টাকা পাবেন। যখনই তিনি টাকা চাইতে গেছেন, শাহরিয়ার আলম তাঁকে হুমকি দিয়েছেন।
শাহরিয়ার আলম বাড়ি করেছেন বাঘার আড়ানী পৌরসভায়। ১৪ অক্টোবর সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, তিনতলা বাড়িতে সুনসান নীরবতা। বাড়ির মূল ফটক ভেতর থেকে লাগানো। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, শাহরিয়ার আলম গত ৫ আগস্ট ভোরেই ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরে তাঁরা শুনেছেন, সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে এখন তিনি রাশিয়ায় অবস্থান করছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন