বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে আবার অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক তৎপরতা শুরু হয়েছে। এক সময় জেলে, বাওয়ালি থেকে শুরু করে পর্যটকরাও থাকতেন আতঙ্কে। ছয় বছর আগে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এখন আবারও সুন্দরবনে তৎপর হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে পালানো দাগি আসামি এবং ছয় বছর আগে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা সুন্দরবনে গিয়ে শুরু করেছে দস্যুতা।
জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অপরাধ ঘটছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুর কবল থেকে ১০ জেলেকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। বনদস্যুদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনটি নৌকা, সোলার প্যানেল ও এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে বন বিভাগ। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৪ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে।
আরও জানা গেছে, আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু আলিম বাহিনীর প্রধান আব্দুল আলিম, মিলন, জিয়া, জনাব ও নুরু বর্তমানে ভারতে বসে চাঁদা দাবি করছে। গত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত থাকলেও বর্তমানে দু-একটি বাহিনী নতুন নামে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আনোয়ার আলী নামে এক জেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেন, ‘১০ থেকে ১২ জনের একটি ডাকাত দল (আব্দুল্লাহ বাহিনী) সুন্দরবনের দারগাং, আঠারোবেকী, কাচিকাটা, রায়মঙ্গল, কচুখালী, মাওন্দো নদীতে অবস্থান করছে। তারা আমাদের ধরে নৌকায় যা পাচ্ছে সেগুলো তুলে নিচ্ছে। পুনরায় বনে প্রবেশ করলে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রবেশ করতে বলছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের আকবর তরফদারের ছেলে আব্দুল্লাহ তরফদার (৪২) গত ১৪ সেপ্টেম্বর নারীপাচার মামলায় জেলে যায়। গত ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙা হলে সেখান থেকে পালিয়ে কৈখালী ইউপির পারাণপুর গ্রামে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নেয়। ৬ আগস্ট রাতে টেংরাখালি গ্রামের আরও কয়েকজন মিলে মিরগাং মোড় দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। বনদস্যুতায় নামা আব্দুল্লাহ বাহিনীর প্রধান আব্দুল্লাহর সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল রয়েছে। তাদের অধিকাংশ কারাগার থেকে পালানো বলে জানা গেছে।
সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার জেলেরা জানান, তাদের কয়েক জনকে টগিবগি এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে দস্যুরা। এরপর হাত-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে এক লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করে। এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠান। পরে একজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি টাকা দিলে অন্যদের ছাড়ার কথা বলে।
রুবেল হোসেন নামে এক জেলে বলেন, ‘অনেক দিন পর সুন্দরবনে আবার ডাকাত নেমেছে। নদীতে মাছ তেমন হয় না। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ডাকাতির টাকা দেবো নাকি ঋণ শোধ করবো! বড় চিন্তায় আছি।’
এলাকার জেলেরা জানান, সুন্দরবনে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল জেলেদের কাছে যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। তারা প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের দায়িত্বে থাকা হাসনা জাহান বিথী বলেন, ‘জেল থেকে সাত-আট জন আসামি এখনও পলাতক। তাদের ধরতে প্রশাসন কাজ করছে।’
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) ইকবাল হোসেন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় অভিযান চালানো হলে বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে বন বিভাগের সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যায়। ধ্বংস করা হয় বনদস্যুদের একটি আস্তানা। এর আগে গত ২৮ জুলাই সুন্দরবনের টগিবগি এলাকা থেকে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের ১৪ জেলেকে অপহরণ করে দস্যুরা।’
বন কর্মকর্তা বলছেন, ‘দীর্ঘদিন সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ বনদস্যুমুক্ত থাকার পর অতিসম্প্রতি আবারও বনদস্যুদের কয়েকটি বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বাহিনীর অত্যাচারে জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে ভারতে বসে এই বনদস্যু গ্রুপটি জেলেদের কাছে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি করছে বলে জেলে-বাওয়ালিরা অভিযোগ করেছেন।’
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা মো. হাবিবুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একটি গ্রুপ এ কাজটি করছে। তবে তারা কোনও সুবিধা করতে পারবে না। আমরা শক্ত অবস্থানে রয়েছি।’
র্যাব-৬ এর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট এম সারওয়ার হুসাইন বলেন, ‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে কেউ নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইলে কঠোর হাতে দমন করা হবে। জেলেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে র্যাব। এ ধরনের কোনও ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান জালাচ্ছি। নতুন করে কেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে আমরা কঠোর হাতে দমন করবো।’
সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের সুপার মো. এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘কারাগার থেকে পালানোর ঘটনার পর সদর থানায় ৮৭ জন হাজতি ও কয়েদির নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ জন ফিরে আসে। এখনও ৫৪ জন বাইরে রয়েছে। এর মধ্যে দুই জন রয়েছে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত।’
তিনি বলেন, ‘আব্দুল্লাহ তরফদার মানবপাচার মামলায় গত ১৫ জুলাই শ্যামনগর থানার মাধ্যমে কারাগারে আসে। ৫ আগস্ট রাতে পালিয়ে যায়। এখনও কারাগারে আসেনি। সে হাজতি ছিল।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন