বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তৃতীয় কোনও দেশে পাঠানো তো দূরের কথা– আপাতত ভারতেই তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুতি শুরু করেছে দিল্লি। ভারত সরকারের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলা ট্রিবিউনের কাছে এ কথা নিশ্চিত করেছেন।
গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে খবর বেরিয়েছে যে শেখ হাসিনা না কি যে কোনও সময় ভারত ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। এমনও লেখা হয়েছে যে তিনি ইতোমধ্যেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর আজমানে চলে গেছেন, যেখানে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের একটি বাড়ি আছে এবং তিনি না কি সেখানেই থাকছেন।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হাসান মন্তব্য করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কোথায় আছেন তা নিয়ে তারা ভারত ও আমিরাত উভয় দেশেই খোঁজখবর নিয়েছেন, কিন্তু কোনও ‘কনফার্মেশন’ পাননি। তার এই বক্তব্যের পর শেখ হাসিনার গতিবিধি নিয়ে যথারীতি জল্পনা আরও বাড়ে।
এই পটভূমিতে দিল্লিতে বিষয়টি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন বিশদে খোঁজ নিয়েছে এবং নিশ্চিত হতে পেরেছে যে শেখ হাসিনা আদৌ ভারত ত্যাগ করেননি।
তিনি গত ৫ আগস্ট এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে এসে নেমেছিলেন। তারপর থেকে ভারতের রাজধানীতেই অবস্থান করছেন তিনি, সঙ্গে আছেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। তার সেই অবস্থানের এখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি, যদিও দিল্লিতে তারা ঠিক কোথাও আছেন– সেই তথ্য ভারত সরকার কখনোই প্রকাশ করেনি।
তাহলে দিল্লিতে নামার পরে দু’মাস কেটে যাওয়ার পর এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে নিয়ে কী করা হবে, ভারত সরকার সেটা কি কিছু স্থির করেছে?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে যে উত্তরগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তার অন্তত তিনটি দিক আছে। সেগুলো হলো—
প্রথমত, তৃতীয় কোনও দেশে শেখ হাসিনার নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা এখনও পুরোপুরি থেমে যায়নি। এই ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে কাতার, সৌদি আরব, আমিরাত ছাড়াও ইউরোপের দু-তিনটি ছোটখাটো দেশের সঙ্গে ‘ইনফর্মালি’ কথাবার্তা হয়েছে– তবে শেষ পর্যন্ত সব শর্ত পূরণ করে শেখ হাসিনার জন্য সবদিক থেকে ‘উপযুক্ত’ কোনও ঠিকানা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কয়েকটি ক্ষেত্রে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েও ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত কোনও ‘ব্রেকথ্রু’ হয়নি। যদিও তার মানে এই নয় যে সেই চেষ্টায় ভারত পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় অপশনটা হলো, শেখ হাসিনা যেমন আছেন তাকে তেমনভাবেই আরও বেশ কিছুকালের জন্য ভারতে রেখে দেওয়া। তার ‘স্ট্যাটাস’ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও ঘোষণা না-করেই আসলে ভারত দীর্ঘ সময় তাকে নিজেদের কাছে রাখতে পারে। ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের সুবাদে ভারতে ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন থাকার যে মেয়াদ আছে, সেই শর্তও এখানে প্রযোজ্য নয়– কারণ ভারত মনে করছে শেখ হাসিনা ‘সম্পূর্ণ বৈধভাবেই’ ভারতে প্রবেশ করেছেন এবং তারপর তাকে ভারতে যতদিন খুশি থাকবার অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার ভারতের আছে। এরকম হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিত্ব ও সম্মানিত অতিথির জন্য সেই ব্যবস্থাটা করা ভারতের জন্য কোনও সমস্যাই নয়।
তৃতীয় রাস্তাটা হলো, শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় (‘পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম’) দিয়ে পাকাপাকিভাবে বা যতদিন খুশি তাকে ভারতে থাকার স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেওয়া। অতীতে তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা বা আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ’র পরিবারকেও ভারত এভাবে আশ্রয় দিয়েছে– এবং চীন বা আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে জেনেও সেই সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেনি। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে, যদিও তাতে ঢাকার বর্তমান সরকারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার আগে এই বিষয়টি অবশ্যই ভারতের বিবেচনায় থাকবে।
তবে যদি সরকার শেষ পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্তই নেয়, তাহলে ভারতের সব বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করেই সেটা নেওয়া হবে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে একটা বিরাট সুবিধা হলো– কংগ্রেস-সহ ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তার দারুণ সম্পর্ক। কংগ্রেসের ফার্স্ট ফ্যামিলি গান্ধী পরিবারের সঙ্গেও তার ব্যক্তিগত হৃদ্যতা দারুণ। ফলে ধরেই নেওয়া যায়, তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব ভারতে সব দলেরই সমর্থন পাবে এবং সেটি একটি ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্ত হবে।
ভারতে পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশনের (নভেম্বর-ডিসেম্বর) সময় এ জন্য সর্বদলীয় বৈঠকও ডাকা হতে পারে।
এই তিনটি অপশনের মধ্যে প্রথমটি পুরোপুরি ভারতের হাতে নেই– কারণ, সেটি তৃতীয় দেশের পরিস্থিতি বা শর্তর ওপরও নির্ভর করছে। কিন্তু অন্য দুটি অপশন পুরোপুরি ভারতের হাতে এ কথা বলাই চলে।
যার ভিত্তিতে এই মন্তব্যও বোধহয় করা যায় যে শেষ পর্যন্ত লম্বা সময়ের জন্য শেখ হাসিনাকে ভারতেই রেখে দিতে হবে– দিল্লি ধীরে ধীরে এই বাস্তবতার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন