অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বা আগামী নির্বাচন কবে হবে এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, "আমাদেরই বলতে হবে। আমাদেরকেই বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন তখন সেটাই হবে তারিখ।"
শুক্রবার, (২৭ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলাকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।
এ ব্যাপারে উপদেষ্টা পরিষদে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, "আমরা আলোচনা করেছি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেইনি।"
এর আগে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে দেশে আগামী আঠারো মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে যেন সক্ষম হয়, সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তার দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাবার কথা জানান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত ২৩ সেপ্টেম্বর, বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।
সেনা প্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে এ কথা থেকে কি ধরে নেয়া যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে ১৮ মাস, এ প্রশ্নটি করা হলে, জবাবে ইউনূস বলেন, "সেটা আপনি ইচ্ছা করলে ধরতে পারেন। কিন্তু, সরকারের মতামত তো না সেটা। সরকার তো কোনো মত দেয়নি এ পর্যন্ত। কাজেই সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে সেটা সরকারকে বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত সেটা তো সরকারের মেয়াদ হচ্ছে না।"
বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে ইউনূস জানান, এটি একটি আইনগত বিষয় এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "আমাদের দুজনেরই দুই দেশেরই স্বার্থ হলো যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা। মাঝে মাঝে কতগুলা প্রশ্ন এসে যায় যেখানে সম্পর্কে একটু চিড় ধরে। যেমন সীমান্তে গুলি করল, বাচ্চা মেয়ে মারা গেল, বাচ্চা ছেলে মারা গেল, এগুলো মনে কষ্ট দেয়।...এটাতে আমরা মনে করি না যে সরকার ইচ্ছা করে, ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে। যে সমস্ত কারণে এসব ঘটে, সেসব কারণগুলো যেন আমরা উৎখাত করতে পারি, যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, যাতে নিরাপদে মানুষ জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে।"
বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল ছাত্ররা। অন্তর্বর্তী সরকারেও ছাত্রদের প্রতিনিধি রয়েছে। তবে সরকারের বাইরে যারা আছে এমন অনেক ছাত্রকে আমরা দেশের নানা ক্ষেত্রে, নানা প্রতিষ্ঠানে কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরাই কি দেশ চালাচ্ছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "চালানো উচিত বলছি। চালাচ্ছে বলছি না। চালানো উচিত। তরুণদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, আমি বরাবরই বলে এসেছি, এখানে এ দায়িত্ব পালন করার আগে থেকেই বলছি যে তরুণদের হাতে, কারণ তারাই তাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে।"
ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় দেড় মাস পরে, এই সময়ে সেনাবাহিনীর কমিশন অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন কেন এই প্রশ্নের জবাবে ইউনূস জানান, গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ ছাত্রদের হত্যা করাসহ পুলিশের গণবিরোধী ভূমিকায় জনগণের মধ্যে পুলিশের ব্যাপারে যে নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়, সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে যাওয়ায় পুলিশকে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা যাচ্ছিল না। এ কাজে আনসার নিয়োগ করেও ফল আসেনি। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে দুমাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, "নানা রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সমাবেশ হচ্ছে। তাতে, বিশেষ করে আমাদের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা গেল। সেগুলো নিয়ে মনে করলাম যে, এভাবে চলতে দিলে তো বাড়তে আরম্ভ করবে, তখন এ প্রসঙ্গ উঠল যে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়ার জন্য।...তারা বলছে আমরা তো আছিই কিন্তু, আমাদেরকে তো কেউ পরোয়া করছে না। কারণ আমাদের তো কোনো ক্ষমতা নেই। আমাদেরকে একটা ক্ষমতা থাকলে তারা হয়তো আমাদেরকে গণ্য করবে...তখন আমরা তাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিলাম।"
এ সাক্ষাৎকারে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, সার্ক পুনরায় কার্যকরভাবে চালু করার ব্যাপারে পাকিস্তান, নেপাল, ভূটানের সাথে জাতিসংঘ অধিবেশনের ব্যস্ততার ফাঁকে আলোচনা করা, সংবিধান সংস্কারসহ নানাক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে তার সরকারের উদ্যোগ ও অগ্রগতি, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশী নাগরিকদের সঙ্গে বাঙালিদের সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও সহিংসতা, রোহিঙ্গা সংকট ইত্যাদি বিষয়েও কথা বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, "এইতো আসলাম মাত্র। এতো বছরের একটা সমস্যা, আপনি দুদিনে আমাদের দিয়ে সমাধান করে দিবেন, আমরা একটা সমাধান নিয়ে আসব এটা আশা করা তো ঠিক হবে না। একটা শান্তি চুক্তি হয়েছে, সে শান্তি চুক্তি বহু বছরের চেষ্টায় হয়েছে। সেই শান্তি চুক্তি বহাল করা যাচ্ছে না। মান্য করছে না। এখন কি সে শান্তি চুক্তি আবার নতুন করে করতে হবে? সেটা আমাদের সরকার পেরে উঠবে না। এটা পরবর্তীতে নির্বাচিত যে সরকার আসবে, তারা করবে।"
নতুন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে সে ব্যাপারে তার সরকারের সিদ্ধান্ত কী হবে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "তারা যদি আসতে চায়, আমরা তাদের আসতে দেব। আমরা তাদের গ্রহণ করব।"
ভয়েস অফ আমেরিকার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলি সম্পন্ন করে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা তার সরকারের মূল লক্ষ্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন