ঢাকার কারওয়ান বাজারে মাছ কিনে পলিথিনে ভরে ব্যাগে রাখছিলেন দেলওয়ারা আক্তার; ঠিক সেই সময়ে পলিথিন নিষিদ্ধের কথা বলতেই বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন- ‘পলিথিন ছাড়া মাছ নিব কীসে?’
তেজগাঁওয়ের এই বাসিন্দা বললেন, “ব্যাগে চাল-ডালসহ আরও অনেক কিছু আছে। সেগুলোও তো পলিথিনে রাখা হয়েছে। সেগুলো না হয় কাগজের ঠোঙ্গায় রাখা যাবে। কিন্তু মাছ তো রাখা যাবে না, ভেজা জিনিস। আর মাছ বা মাংস যখন ফ্রিজে রাখব, তখন তো পলিথিন লাগবেই।”
শনিবার সন্ধ্যায় বিক্রেতা মো. সেলিমের দোকান থেকে মাছ কেনেন দেলওয়ারা আক্তার। পলিথিন নিয়ে তার সঙ্গে আলাপের সময় বিক্রেতা সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারও পলিথিন নিষিদ্ধ করছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই।
“এহন এই সরকার আইসা নিষিদ্ধ করতাছে, কিন্তু কোনো লাভ হইব না। কারণ, মানুষ পলিথিন সহজে ব্যবহার করতে পারে।”
অন্তর্বর্তী সরকার অক্টোবরের প্রথম দিন থেকে ঢাকার সুপারশপে নিষিদ্ধ করছে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন ব্যাগ। এক মাস পর ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন নিষিদ্ধ হবে কাঁচাবাজারে।
সরকারের এমন ঘোষণায় এরইমধ্যে সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিনের ব্যবহার কমানোর উদ্যোগও শুরু হয়েছে। স্বপ্ন ও মিনা বাজারসহ বিভিন্ন সুপারশপ ক্রেতাদের ব্যাগ নিয়ে আসার কথা বলছে। ব্যাগ না নিয়ে আসা অন্যরা শপ থেকে ব্যাগ কিনতে পারছেন।
সুপারশপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে প্রাথমিক উদ্যোগ দেখা গেলেও খোলা বাজার বা কাঁচাবাজারগুলোতে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
পলিথিন নিষিদ্ধের বিষয়ে বাজারে আলোচনা থাকলেও এর বিকল্প কী হবে, সেই প্রশ্ন তুলছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারে আগ্রহ থাকলেও বছরের পর বছর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত পলিথিনের কোনো বিকল্পই যেন মাথায় আসছে না তাদের।
ক্রেতা দেলওয়ারাও যেমন বললেন, পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশবান্ধব জিনিসই ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য এমন কী বের করেছে সরকার?
”হঠাৎ করে পলিথিন নিষিদ্ধ করলেই তো হবে না।”
কারওয়ান বাজারের আরেক মাছ বিক্রেতা শফিক আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাইনষেরে আমরা পলিথিনে মাছ না দিলে, কীসে দিমু? আন্দাজি আগেই বন্ধ কইরা দিয়া লাভ আছে কুনো? আলু-পেঁয়াজের লগে মাছ রাখলে সব কিছু গন্ধ হইবো না?”
এ বাজারে খাসির মাংস বিক্রেতা মো. আবু সিদ্দিকের ভাষ্য, “ভাই, মাংস ফ্রিজে রাখলে কখনোই পলিথিনের বিকল্প নাই। এদিকে চিন্তাই পইড়া গেছি, প্রশাসন এসে যদি জরিমানা করা শুরু করে।”
তবে চালের দোকান আহসান এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা এইচ এম আসাদ বললেন, “নিষিদ্ধের কথা শুনছি। কিন্তু সরকার সামনে কী করে ঠিক বুঝতেছি না। যৌক্তিক বিকল্প বের না করে যদি এসে জরিমানা করা শুরু করে, সেটা তো আমরা মানব না।”
কারওয়ান বাজারে চার কেজি চাল কিনে দুটি পলিথিনে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন মধ্যবয়সী কেরামত মিয়া। পলিথিনে নিষিদ্ধের বিষয়টি তুলে ধরে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “পলিথিন তো আসলেই খারাপ, এইডা জানি। আগে মাইনষে যেমনে নিত বাজার, তাইলে এমনেই নিক। লগে বাজারের ব্যাগ থাকব।
“কাগজের বড় ঠোঙ্গায় ঢুকাইয়া বাজারের ব্যাগে রাখলেই হয়। আর ছোটবেলায় মাছ নেওনের লিগা খালই লইয়া আইতাম বাজারে। এহনও খালই লইয়া আহুম।”
রাজধানীর বৃহত্তম খুচরা ও পাইকারি এ বাজারে অনেককেই দেখা যায় কাপড়ের ব্যাগ বাসা থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। শুকনো জিনিস সব সেই ব্যাগে ভরছেন।
এমনই একজন আশিকুর রহমান। একটি বেসরকারি কোম্পানির এই কর্মী কারওয়ান বাজার থেকে তিন কেজি আলু ও এক কেজি পেঁয়াজ কিনে কোনো পলিথিন না নিয়ে সেগুলো একত্রে কাপড়ের ব্যাগে রাখলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পরিবেশ উপদেষ্টার পলিথিন নিষিদ্ধের ঘোষণার পর গত সপ্তাহ থেকে বাজারে কাপড়ের ব্যাগ আনা শুরু করেছি। অভ্যাস করতেছি।
“আসলে পরিবেশের যে অবস্থা সত্যিই ভয়ানক। একটু বৃষ্টি হলেই তো ড্রেন আটকে রাস্তায় নোংরা পানি উঠে। পরে ড্রেন পরিষ্কার করতে গেলে দেখা যায় অজস্র পলিথিন। আন্দোলন করে সরকার পরিবর্তন করে ফেললাম। আর পরিবেশের জন্য এই পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। সরকার একা কিছু করতে পারবে না। সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।”
যা বলছেন পরিবেশ উপদেষ্টা
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গত ২৪ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর টাউন হলে উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ‘ক্লিন-আপ’ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সেখানে বিকল্প সামগ্রী বিতরণও করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে তিন ধাপের পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রথম ধাপে ১ অক্টোবর থেকে ঢাকা কেন্দ্রিক সুপারশপগুলোয় এই ব্যাগ বন্ধ করা হচ্ছে। তবে এটি সরকারের একক সিদ্ধান্ত নয়।
দ্বিতীয় ধাপে ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারগুলোতে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হবে। তখন আইনের প্রয়োগও হবে।
“রিসাইকেল হল শেষ ধাপ, যখন আর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে রিসাইকেল হচ্ছে খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। কেমিক্যাল ম্যানেজমেন্ট করে রিসাইকেল হচ্ছে না। তাপ দিয়ে গলিয়ে আবার নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। এটিকে রিসাইকেল শিল্প বলা যায় না,” বলেন উপদেষ্টা।
এখনই সব ধরনের প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “শুধু আইইএ নিষিদ্ধ প্লাস্টিক পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের উপর আমাদের কার্যক্রম চলছে। পলিথিন ব্যবহার বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে কারণ সতর্ক করা এবং কঠোর হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। তবে শাস্তি দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ক্ষতিকর এই ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তবে ভোক্তা পর্যায়েও সচেতনতা দরকার।”
পলিথিনের বিকল্প ‘নতুন করে আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই’ মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, “পলিথিনের বিকল্প প্রথাগতভাবেই আছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোশিয়েশন ছাড়াও আরও ২০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে যারা বিকল্প নিয়ে কাজ করছে।
”এছাড়া সুপারশপ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ব্যাগের সংখ্যার তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং যোগানের ব্যবস্থাও হয়েছে। তাই বিকল্প নেই এই তর্ক শুরুর সুযোগ নেই। চাহিদা থাকলে সরবারাহও আসবে।”
এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিনের শপিং ব্যাগ বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না, ক্রেতাদেরকেও দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা এর সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখতে হবে।
কোনটি পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ? কেন নিষিদ্ধ?
নন-ওভেন পিপি ব্যাগ বা টিস্যু ব্যাগ নামে বাজারে প্রচলিত যে ব্যাগ পাওয়া যায়, সেগুলোই মূলত পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ। তবে টিস্যু ব্যাগ নামেই এটি ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি পরিচিত করানো হয়েছে।
বাজারে কয়েক ধরনের টিস্যু ব্যাগ রয়েছে, যার মধ্যে কিছু হয় পুরুত্বের দিক থেকে পাতলা এবং দেখতে অনেকটা চকচকে। সুপারশপ, মুদিদোকান, ওষুধের দোকানে এই ব্যাগগুলো খুব বেশি ব্যবহার করা হয়। সাদা, লাল, নীল, কমলাসহ বেশ কিছু রঙের এই ব্যাগ ওজনেও খুব হালকা।
পলিথিনের ব্যাগ এবং পলিপ্রোপিলিন দিয়ে বানানো টিস্যু বা কাপড়ের মত দেখতে শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ছোট-বড় দোকান থেকে শপিংমল পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে, বিক্রেতা পণ্য ভরে ধরিয়ে দিচ্ছিন ক্রেতার হাতে। শনিবার ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি।
পলিথিনের ব্যাগ এবং পলিপ্রোপিলিন দিয়ে বানানো টিস্যু বা কাপড়ের মত দেখতে শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ছোট-বড় দোকান থেকে শপিংমল পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে, বিক্রেতা পণ্য ভরে ধরিয়ে দিচ্ছিন ক্রেতার হাতে। শনিবার ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি।
সাদা একরঙা বড় আকারের ভিন্ন হাতল লাগানো পুরুত্বের দিক থেকে কিছুটা মোটা ব্যাগও খুব দেখা যায়। সুপারশপে পণ্য দেওয়ার জন্য এই ব্যাগ ব্যবহার হয়।
আবার শপিং মলে পুরু নন-ওভেন (বুনন ছাড়া) ব্যাগ দেওয়া হয়, যা দেখতে মোটা কাপড়ের ব্যাগের মতই কিন্তু সেগুলোও এক ধরনের টিস্যু ব্যাগ এবং পলিথিনের মত সেগুলোও পরিবেশের একই ধরনের ক্ষতি করে। অনেক ব্যবসায়ীই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ক্ষতিকর এই ব্যাগকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বলেও প্রচার করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন