বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছেলে গুলি খেয়েছে শুনে হৃদরোগে আক্রান্ত হন বাবা। ধারদেনা করে বাবার কিছুটা চিকিৎসা হলেও পয়সার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না ছেলের। তার উপর বাবার অসুস্থতার কারণে মাথায় গুলি নিয়ে ছেলেকে প্রতিনিয়ত আয়ের জন্য কাজ করতে হচ্ছে।
এই অবস্থায় স্বামী আর সন্তানকে নিয়ে বড় ধরনের দুঃশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের মনুয়ারা বেগম। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না কীভাবে স্বামী-সন্তানের চিকিৎসা করাবেন। আর কীভাবেই বা স্বামীর চিকিৎসার সময় কিস্তিতে ধার করা টাকা পরিশোধ করবেন।
গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকার কলাবাগের বাসিন্দা মনুয়ারা বেগম (৪০) হতাশা ও কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলছিলেন, “টাকা না থাকার কারণে স্বামী-সন্তানের চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। আন্দোলনের পর অনেকে যোগাযোগ করেন। তবে আন্দোলনের দেড় মাস পার হয়ে গেলেও কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নেননি।
“বর্তমানে না পারছি ছেলের চিকিৎিসা করাতে, না পারছি স্বামীর চিকিৎসা করাতে। কোনো রাস্তা নেই, এখন আমার মনে হয় নিজে মরে যাই।”
স্বামী-সন্তানের চিকিৎসার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন মুনয়ারা বেগম।
মনুয়ারা বেগমের স্বামী নিয়ামত খান কয়েছ (৪৮) ছোট্ট একটি কাঁচামালের দোকান চালান। এ দিয়েই চলে পাঁচ সদস্যের পরিবার। নিজের কোনো জায়গা-জমি না থাকায় অন্যের বাড়ি থাকেন তারা।
২১ বছর বয়সী কাওসার আহমদ বলছিলেন, তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। মিছিলে গিয়েছেন। ৪ অগাস্ট একটি মিছিলের সঙ্গে তিনি গোলাপগঞ্জ থানার সামনে আসেন। তখন পুলিশ গুলি করে।
“গুলি আমার মাথায় লাগে। তখন বন্ধুরা মিলে আমাকে সিলেটের ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে দেখি আব্বা অসুস্থ। পরের দিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানলাম, আব্বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এরপর থেকে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি।”
কাওসার বলেন, “আমার মাথায় ছয়টি গুলি রয়েছে। মাথা ভার লাগে, ব্যাথা হয়, রাতে ঘুমাতে পারি না। আমাদের কাঁচামালের দোকান আছে; আব্বা অসুস্থ থাকায় দোকানে গিয়ে বসি। আমি আহত হওয়ার পর অনেকে বলেছিলেন, চিকিৎসা করাবেন। কিন্তু এখনও কেউ খবর নেননি।”
এখন চিকিৎসার সাহায্যের জন্য আর কারো কাছে যেতে চান বলেও জানান কাওসার।
কাওসার গুলি খেয়েছে শুনে বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান বাবা নিয়ামত খান কয়েছ। মাথায় পানি ঢেলে অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলেও তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। একপাশ পুরোপুরি অবশ হয়ে যায়। পরদিন স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। তখন চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট নিয়ে যেতে বলেন।
মনুয়ারা বেগম বলছিলেন, “তখন কোনো উপায় না দেখে অন্য একজনকে দিয়ে ৫০ হাজার টাকা কিস্তি তোলে স্বামীকে নিয়ে সিলেটের রাগিব-রাবেয়া মেডিকেলে ভর্তি করাই। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর তাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরি।”
১৫ সেপ্টেম্বর ফের চিকিৎসকের কাছে নিয়ামত খান কয়েছকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও টাকার অভাবে পারেননি। কিস্তি ছাড়াও ধারদেনা করেছেন। সব মিলিয়ে নিয়ামতের চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৯০ হাজার টাকা।
হাতে টাকা নেই; কিন্তু বাবা-ছেলে দুজনেরই চিকিৎসা করানো দরকার- জানিয়ে মনুয়ারা বেগম বলেন, “ছেলেকে তার বন্ধুরা সিলেট শহরে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে বাড়িতে দিয়ে গেছে। ছেলে প্রথমে আমাদের বলে না তার গুলি লাগার কথা। পরে কাপড়ে রক্ত দেখে জানতে পারি, গুলি লাগছে। তারপর মাথার এক্সরে করিয়ে দেখতে পাই ছয়টি গুলি ভেতরে আছে। এগুলো বের করতে উন্নত চিকিৎসা দরকার।”
মনুয়ারা বলেন, “স্বামী আগে বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। বর্তমানে অসুস্থ। ছেলে দোকানে সময় দিয়ে যা আয় করছে তা দিয়ে সংসার এবং ওষুধপত্র কিনতে হচ্ছে। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।”
নিয়ামত খান কয়েছ বলেন, “ডাক্তার বলেছেন, আমি হার্ট অ্যাটাক করেছি; সঙ্গে আমার ব্রেইনে ইনফেকশন হয়েছে। প্রায় ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে; সব টাকা ধারদেনা করা। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। পরিবার চলছে ধারদেনা ও ছেলের সামান্য ইনকামে।”
তিনি চিকিৎসার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন