দেশ ঠিক পথে যাচ্ছে বলে মনে করেন ৭১ শতাংশ মানুষ। আর ৮১ শতাংশ মানুষ চান সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে যত দিন প্রয়োজন, তত দিন ক্ষমতায় থাকুক অন্তর্বর্তী সরকার। ‘পালস সার্ভে ২০২৪: জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক জনমত জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) জরিপটি পরিচালনা করে। আজ রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইনস্টিটিউটের জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ‘অভ্যুত্থানের চল্লিশ দিন: মানুষ কী ভাবছে’ শিরোনামে আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়।
জরিপে গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ২ হাজার ৩৬৩ জন মানুষের মতামত নেওয়া হয় টেলিফোনে। এতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, বর্তমান সময়ের সমস্যা, সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের মতামত নেওয়া হয়। গত ২২ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মির্জা এম হাসান জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন।
জরিপে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে দুটি প্রশ্ন ছিল। একটি হলো, এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোন বক্তব্যটির সঙ্গে একমত পোষণ করেন? এখানে দুটি অপশন ছিল। ১. যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছাড়া। ২. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে যত দিন প্রয়োজন ক্ষমতায় থাকা। ফলাফলে বলা হয়, শতকরা ৮১ ভাগ মানুষ চান যে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার সম্পন্ন করার জন্য যত দিন প্রয়োজন, তত দিন ক্ষমতায় থাকুক। আর শতকরা ১৩ ভাগ মানুষ মনে করেন অতিদ্রুত নির্বাচন দিয়ে সরকারের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
জরিপে সরকারের মেয়াদ নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন ছিল—অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন হওয়া দরকার? এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৩৮ শতাংশ বলেছে সরকারের মেয়াদ ৩ বছর বা তার বেশি হওয়া দরকার। ২ বছর মেয়াদ হওয়া দরকার বলে মত দেন ৯ শতাংশ। এক বছরের পক্ষে মত দেন ১১ শতাংশ। সরকারের মেয়াদ ৩ থেকে ৬ মাস হওয়া দরকার বলে মত দিয়েছেন ২২ শতাংশ মানুষ। ২ শতাংশ মত দিয়েছেন সরকারের মেয়াদ ৩ মাসের কম হওয়া উচিত। বাকিদের মধ্যে ১২ শতাংশ বলেছেন, জানেন না। আর ৬ শতাংশ কোনো জবাব দেননি।
নির্বাচন দেওয়ার আগে এই সরকারের কাছে যদি আপনার একটিমাত্র দাবি থাকে, সেটি কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলেছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কারের কথা বলেছেন। আইনের শাসনের কথা বলেছেন ১২ শতাংশ মানুষ।
অর্থনীতিই প্রধান সমস্যা
জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, রাজনীতির তুলনায় অর্থনীতি নিয়ে মানুষের আশাবাদ কিছুটা কম। অর্থনৈতিকভাবে দেশ ঠিক পথে যাচ্ছে বলে মত দিয়েছেন ৬০ শতাংশ মানুষ। রাজনীতি ও অর্থনীতি মিলিয়ে মোট ৫৩ শতাংশ মানুষ আশাবাদী। এই দুই দিক মিলিয়ে নিরাশাবাদী ১০ শতাংশ মানুষ। আর ১৩ শতাংশ মানুষ রাজনীতি নিয়ে আশাবাদী হলেও অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কিত।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কী—জরিপে এমন প্রশ্নে ৪০ শতাংশ মানুষ অর্থনীতির কথা বলেছেন। ১৫ শতাংশ বলেছেন বন্যার কথা। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ১৩ শতাংশ মানুষ। আর ৭ শতাংশ মানুষ প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে।
আগস্ট মাসে সাধারণ সময়ের তুলনায় অপরাধ বেড়েছে বলে মত দেন ২৫ শতাংশ মানুষ। ৭২ দশমিক ২ শতাংশ বলেছেন অপরাধ বাড়েনি। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হওয়াকে সমর্থন করেছেন ৮৩ শতাংশ মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মত দেন ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ। আর দলীয় শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেন ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ।
জরিপের ফলাফল তুলে ধরে মির্জা এম হাসান বলেন, এখন সমস্যা বহুমাত্রিক। এবারই প্রথম তাঁদের জরিপে মানুষ অর্থনীতির বাইরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা বলেছেন। মানুষ বহুমাত্রিক সমস্যা নিয়ে ভাবছেন। এটি ইতিবাচক। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কি ঠিক পথে যাচ্ছে নাকি ভুল পথে যাচ্ছে—এমন প্রশ্নে ৭১ শতাংশ বলেছেন ঠিক পথে যাচ্ছে। এর আগে এ বছরের শুরুতে তাঁদের জরিপে এই প্রশ্নে ৪১ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন দেশ ঠিক পথে যাচ্ছে। এখানে মানুষের মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারী, পুরুষ, গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য তাঁরা পাননি। তবে মির্জা এম হাসান উল্লেখ করেন, জরিপে পুরুষ এবং শহরের মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আশাবাদ তুলনামূলক বেশি দেখা গেছে। আর বয়সের বিবেচনায় তরুণ ও প্রবীণদের মধ্যে আশাবাদ বেশি। আয়ের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আশাবাদে ভিন্নতা তাঁরা পেয়েছেন। এতে সর্বোচ্চ আয়ের মানুষ সর্বনিম্ন আয়ের মানুষের চেয়ে রাজনীতি নিয়ে বেশি আশাবাদী।
পরিবর্তন দরকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির
আলোচনায় অংশ নিয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এক–এগারোর পরে যেসব সংস্কার করা হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে এই পরিস্থিতি হতো না। আইন সংবিধান সংস্কার হলেই শুধু হবে না, এসব বাস্তবায়ন করতে হবে। মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত যদি খারাপ হয়, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ কেন বলছেন যে অপরাধ বেড়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে অনেক মানুষ মাজার ভাঙার মতো অপরাধগুলোকে অপরাধ বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধিতা এবং ‘ইনক্লুসিভনেস’–এর যে কথা বলছেন, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে বোঝাপড়া স্পষ্ট নয়।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, মানুষ ক্ষমতা একজনের হাতে দেখতে চায় না। তারা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিঁয়াজো কমিটির সদস্য ভূঁইয়া মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগের যাঁরা আছেন, তাঁদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে আগে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের বিচার করতে হবে। তারপর তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে। তাদের ‘রিডিম্পশন’ (পাপমোচন) ছাড়া ‘রিকনসিলিয়েশন’ (পুনঃ একত্রীকরণ) হবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিঁয়াজো কমিটির সদস্য মামুন আব্দুল্লাহি বলেন, সংস্কার প্রশ্নে মানুষ ইতিবাচক। তবে যেটা আশঙ্কার তা হলো সংস্কার দাবি তোলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে; কিন্তু সংস্কার কমিশন করা হচ্ছে বয়স্কদের দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ শাহানের সঞ্চালনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রওনক জাহান বলেন, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের চাওয়ার বিষয়টি জরিপেও উঠে এসেছে। ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি বন্ধে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন