দাম বাড়ার প্রভাব বেচাকেনায়, পেশা বদলাচ্ছেন স্টেশনারি ব্যবসায়ীরা
কাগজ-কলম, জ্যামিতি বক্স, স্কেল, কালার পেপারসহ সবধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র স্টেশনারি ব্যবসায়ীরা। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় পেশা বদলাচ্ছেন অনেকে।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বহরপুর গ্রামের বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম কামাল। তিনি বাজার থেকে কাগজ কিনে খাতা তৈরি করে স্টেশনারি দোকানগুলোতে বিক্রি করতেন। প্রতি মাসে তার দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বেচাকেনা হতো। এখন বেচাকেনা নেই বললেই চলে। গতমাসে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকার।
মমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বাজার থেকে কাগজ কিনে এনে খাতা তৈরি করে স্টেশনারি দোকানগুলোতে সরবরাহ করি। আকারে ছোট-বড় ও পৃষ্ঠার ব্যবধানে ১১ ধরনের খাতা তৈরি হতো। আমার নিজের বাড়িতে ছোট পরিসরে কয়েকজন নারীকর্মী এসব খাতা তৈরির কাজ করতেন। এতে তাদের সংসারে বাড়তি রোজগার হতো। তবে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাতার দামও বেড়েছে।
তিনি বলেন, ‘দাম বাড়ায় এখন বেচাকেনা কমে গেছে। স্টেশনারি দোকানিরা খাতা নিতে চান না। প্রতিমাসে যেখানে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বেচাকেনা হতো, গতমাসে সেখানে হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। এই ২০ হাজার টাকা বেচাকেনায় এক হাজার টাকাও লাভ হয়নি। তাহলে এ ব্যবসা করে জীবন-জীবিকা চালানো কীভাবে সম্ভব? বাধ্য হয়ে অন্য পেশা খুঁজছি।’
উপজেলার সাঁড়া গোপালপুর গ্রামের ক্ষুদ্র খাতা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান রিংকু। ব্যবসা ছেড়ে বর্তমানে মুদি দোকান দিয়েছেন।
রিংকু জাগো নিউজকে বলেন, ‘১২০ টাকা রিম কাগজ কিনে নিজ বাড়িতে খাতা তৈরি করে স্টেশনারি দোকানগুলোতে বিক্রি করতাম। এখন সে কাগজ ২৬০ টাকা রিম। বেশি দামে কাগজ কিনে খাতা তৈরি করে লাভ হয় না। তাই বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছি।’
ঈশ্বরদী বাজারের স্টেশনারি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, ১০ টাকা মূল্যের খাতা এখন ১৫ টাকা, ৩০-৩৫ টাকার ব্যবহারিক খাতা ৫০-৫৫ টাকা, ৬০ টাকার খাতা ৮০ টাকা, ৩০০ পৃষ্ঠার রেজিস্টার খাতা ১২০ থেকে বেড়ে ১৫০-১৬০ টাকা, ৫০০ পৃষ্ঠার ১৮০ থেকে বেড়ে ২০০-২২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
৩০০ পৃষ্ঠার খাতার দাম ৫০ থেকে বেড়ে ৬০-৭৫ টাকা, ১২০ পৃষ্ঠার খাতা ৩০ থেকে বেড়ে ৪০ টাকা, কালার পেপার রিমের দাম ৩২০ থেকে বেড়ে ৪২০-৪৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৫০ টাকা ডজন কলমের দাম এখন বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। আগে যেসব জ্যামিতি বক্স ৫০ টাকায় বিক্রি হতো তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়।
শুধু তাই নয়; স্কেল, ক্যালকুলেটর, কালি, রাবার, মিনি ফাইল, জিপার ফাইল, মার্কারসহ সবধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে।
ঈশ্বরদী বাজারের স্টেশনারি ব্যবসায়ী ঝিলিক পেপারের স্বত্বাধিকারী সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাগজ, খাতা, কলমসহ সবধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ায় আমাদের ব্যবসার পুঁজি বেশি লাগছে। দাম বাড়ার পর প্রায় প্রতিদিনই খাতা-কলমের দাম নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হচ্ছে। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বেচাকেনা অনেক কমে গেছে।’
সালাম স্টেশনারির স্বত্বাধিকারী আব্দুস সালাম বলেন, ‘তিন মাসের ব্যবধানে কাগজের দাম এখন আকাশচুম্বি। কাগজ ও খাতাপত্র কিনতে এসে ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। অনেকেই রাগ করে বলছেন, সন্তানদের পড়াশোনা মনে হয় আর করানো হবে না।’
বইয়ের পাশাপাশি স্টেশনারি সামগ্রী বিক্রি করেন শহরের স্টেশন রোডের স্টুডেন্ট লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী জাহিদুর রহমান জাহিদ।
তিনি জানান, কাগজের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাতাসহ সবধরনের স্টেশনারি সামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ৩০ টাকা মূল্যর পেট্রিকেল খাতা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য যেসব বই বিক্রি হবে সেগুলোর দামও ৬০-৭০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান জাহিদ।
কথা হয় ঈশ্বরদী উপজেলা পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মনিরুল আহসান মনির সঙ্গে।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে হারে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ছে তাতে দিন এনে দিন খাওয়া শ্রেণির মানুষ হয়তো আগামীতে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেবে। আর মধ্যবিত্তদের জন্য পড়াশোনা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যাবে।’
‘শিক্ষা উপকরণের দাম যে হারে বেড়েছে তা কিছুটা হলেও এরই মধ্যে সবাই জেনেছে। আগামী জানুয়ারি মাসে বই কিনতে এসে অভিভাবকরা আরও বুঝতে পারবেন। কাগজের দাম বাড়ায় বই, খাতাসহ সবধরনের শিক্ষাসামগ্রীতে প্রভাব পড়েছে’, যোগ করেন মনিরুল আহসান।
ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের ছাত্র তুষার আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তিন ভাইবোন পড়াশোনা করি। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের তিনজনের পড়াশোনা চালানো এমনিতেই কষ্টকর। তার ওপর কাগজ, কলমসহ সবধরনের শিক্ষা উপকরণ বেড়ে যাওয়ায় এখন পরিবারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাবা-মা প্রায়ই বাড়িতে বলেন, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে তো বেশিদিন পড়াশোনা করানো যাবে না। তোমাদের নিজেদের পড়াশোনার খরচ নিজেদের কিছুটা চালাতে হবে।’
উপজেলার রূপপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. খালেকুজ্জামান। তার দুই সন্তান পড়াশোনা করছে। শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ায় তারও নাভিশ্বাস উঠেছে।
খালেকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে কাগজসহ সবধরনের শিক্ষা উপকরণের যেভাবে দাম বেড়ে চলেছে তাতে সন্তানদের পড়াশোনা করানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সত্যিই খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। শুধু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হলেও পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছি।’
সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আইনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধনী-দরিদ্র সবাই পড়াশোনা করে। শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কষ্টকর হয়ে গেছে। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা খাতা-কলমসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ চাহিদা অনুযায়ী না পেলে বিদ্যালয়ে আসতে চাইবে না। এটা তাদের শিক্ষাজীবনের ওপর বেশ প্রভাব ফেলবে।