কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদ জামায়াতে এবারও ইমামতি করলেন বিতর্কিত মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। বুধবার সকাল নয়টায় ৯টায় শোলাকিয়ার ১৮৬তম জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়।
গত ঈদুল ফিতরের নামাজে অংশ নিয়েছিলেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ মুসল্লি। তবে এবার লোক সমাগম হয়েছে অনেক কম। ফরিদ উদ্দিন মাসউদের পিছনে নামাজ হবে না মনে করেই অনেকে এখানে নামাজ পড়তে আসেননি বলে মনে করছেন স্থানীয় মুসল্লিরা।
গত ২৫ জুলাই শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের সামনে ‘শোলাকিয়া মুসল্লি’ ব্যানারে কয়েকশ মুসল্লি মানববন্ধনে অংশ নিয়ে শোলাকিয়া নামাজের ইমামতি করা থেকে ফরিদউদ্দিন মাসউদকে অব্যাহতির দাবি জানান।
মুসল্লিরা অভিযোগ করে বলেছিলেন, বিতর্কিত ফরিদ উদ্দিন মাসউদদের পেছনে নামাজ হবে না। কারণ হিসেবে তারা ব্যাখ্যা করেন, সম্প্রতি আলেমদের বিরুদ্ধে অবস্থান, গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে সমর্থন দেয়া এবং প্রকাশ্য সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়াসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তিনি অংশ নিয়েছেন।
মুসল্লিরা দাবি করেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার ইমাম হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শুরু থেকেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছেন। তাছাড়া লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটে যে শোলাকিয়া ময়দানে, সেখানে তার মতো একজন বিতর্কিত ইমামের পেছনে মুসল্লিরা নামাজ পড়বে কেন?
এর আগে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশের পাঁচশ’র বেশি জায়গায় জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বোমা হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন।
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক পোর্টাল এসএটিপি’র ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে জেএমবির সন্দেহভাজন শীর্ষ নেতা বলা হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জেএমবির বোমা হামলার পাঁচ দিন পর ২২ আগস্ট জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে ঢাকার হযরত শাহজালাল (জিয়া) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতারের পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই সময় মাওলানা মাসউদকে মোট ১৩ দিনের রিমান্ড নেয়া হয়েছিল।
মাসউদকে গ্রেপ্তারের পরে জেএমবিসহ জঙ্গী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তদন্তে নিয়োজিত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
গোয়েন্দারা আরো জানিয়েছিলেন, তারা মাওলানা মাসউদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদ বাংলাদেশ নামক এনজিওটি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন।
ইসলাহুল মুসলিমিনের অ্যাকাউন্টে ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সন্দেহজনক বিদেশি তহবিল আসার প্রমাণ পেয়েছিল বলেও জানিয়েছিল গোয়েন্দারা।
জানা গেছে, জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার আগে মাওলানা মাসউদ জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম নামে একটি ধর্মীয় দলের একাংশের প্রধান ছিলেন।
এর আগে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে ইফার ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে তিনি ইফার পরিচালকের পদ থেকে সরে যান।
এরপর মাওলানা মাসউদ ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদ এনজিওর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বিদেশি তহবিল সংগ্রহ করে দেশব্যাপী ৫০০ মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। পাশাপাশি নিজের রাজনৈতিক দল জমিয়তে ওলামাকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন।
জেএমবির বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পরে অভিযোগ ওঠে মাওলানা মাসউদ ইসলাহুল মুসলিমিন ও জমিয়তে ওলামার সঙ্গে জড়িত থাকলেও গোপনে জেএমবির জঙ্গী কার্যক্রমেও যুক্ত হয়ে পড়েন।
মাওলানা মাসউদ গ্রেফতার হওয়ার পরে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মূল অংশের প্রধান ও মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খান সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি যতদূর জানি তার সঙ্গে শায়খ আবদুর রহমানের যোগসাজশ রয়েছে।’
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক পোর্টাল এসএটিপি ডট অরগ এ দেয়া তথ্যে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তিনি জেএমবির সন্দেহভাজন শীর্ষ নেতা।
উল্লেখ্য, ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হযরত খান বাহাদুর কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর ১৮২৮ সালে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় সাত একর জমির ওপর এ ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেবারই অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ঈদ জামাত। সেই হিসেবে এবার এই মাঠে ১৮৬তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হলো।
প্রায় ৭ একর আয়তনের এ বিশাল ময়দানে ২৬৫টি কাতারে একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন ১ লাখ ৩২ হাজার ৫শ’ মুসল্লি।
স্থানীয় গবেষকদের ভাষ্যমতে, প্রথম অনুষ্ঠিত জামাতে সোয়া লাখ মুসুল্লি অংশগ্রহণ করেন বলে মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখি মাঠ’। সেখান থেকে উচ্চারণের বিবর্তনে তা পরিণত হয়েছে আজকের নাম শোলাকিয়ায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন