এক যে ছিল বাচ্চু মিয়া, এক যে ছিল বেসিক ব্যাংক এভাবে অনেকটা রূপকথার মতোই বলতে হয়। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকটিতে যা ঘটে গেছে এবং বাচ্চু মিয়া যা করে গেছেন তা রূপকথাকেও হার মানায়। অতীতে কখনো কোনো ব্যাংকের শীর্ষ পদে এমন বেপরোয়া কেউ এসেছেন কিনা জানা নেই। ভবিষ্যতেও এমন কাউকে দেখা যাবে বলে মনে হয় না- যার দ্বারা এতো বড় লুটপাট-কেলেঙ্কারি হতে পারে। রক্ষকের পদে বসে আব্দুল হাই বাচ্চু রাক্ষসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সরকারি এ ব্যাংকটির অস্তিত্বই এখন প্রায় হুমকির মুখে। তিনি যা করে গেছেন অনেক ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারিকেও হার মানিয়েছে।
হলমার্ক কেলেংকারি এবং বেসিক ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য এই যে, সেটি ঘটেছিল একজন দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীর অন্য সবাইকে ম্যানেজ করে গোপন জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পুরো ব্যাংক গিলে খাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে। অন্যদিকে বেসিক ব্যাংকে প্রধান যে ব্যক্তি অর্থাৎ ব্যাংকটি রক্ষার দায়িত্ব যার ছিলো সেই রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, সমালোচনা, এমনকি দুদকের পদক্ষেপ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশের পরও সরকার এই রাক্ষসকে সরাতে যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয়নি। যার ফলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লুটপাট-অপকর্মের সুযোগ পেয়েছেন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু। অবশেষে যখন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তখন দেখা গেলো, জনগণের আমানত উধাও হয়ে গেছে। আত্মসাত করা হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।
নামে মাত্র কয়েকজনকে শাস্তি দিলেও দুর্নীতির মূল হোতা সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু এখনো ধারা ছোঁয়ার বাইরে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পরে প্রথমবারের মতো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় খাতের বিশেষায়িত এই ব্যাংক বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। সর্বশেষ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া হলেও এ বিষয়ে তদন্ত করছে না দুদক।
যেভাবে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর উত্থান
শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর বাড়ি বাগেরহাটে, যদিও তিনি গোপালগঞ্জে জন্ম এবং শেখ পরিবারের সদস্য বলে দাবি করেন। এমনকি সম্পর্কে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দূঃসম্পর্কের চাচা হন বলেও পরিচয় দিয়ে থাকেন। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শীর্ষ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আ’লীগের রাজনৈতিক সমঝোতায় ভূমিকা রাখেন তিনি। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নজরে আসতে সক্ষম হন। বিশেষ করে দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হন শেখ হাসিনার। ওই সময়ে আ’লীগকে যারা সহায়তা করেছেন ক্ষমতায় গিয়ে তাদেরকে পুরস্কার দিতে ভুলেনি এ দলটি। ক্ষমতায় গিয়েই রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এবং দলীয় অবস্থানে দুর্বল থাকা সত্ত্বেও দীপু মনি, সাহারা খাতুন, একে খন্দকারের মত লোককে মন্ত্রীত্ব দেয়। সে মোতাবেক ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে দিয়ে দায় পরিশোধ করে আ’লীগ।
উল্লেখ্য, আব্দুল হাই ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগে ছিলেন। পরে এরশাদ আমলে জাপায় যোগ দেন। ৮৮ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনে এমপি হন।
তার যত অনিয়ম
দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম তিন বছর এই লাভজনক ব্যাংকটিকে চালিয়েছেন স্বাভাবিকভাবে। এরপর থেকে শুরু হয় বেপরোয়া দুর্নীতি। সরকারের গত মেয়াদের শেষ দুই বছর অর্থাৎ ২০১২, ২০১৩ এবং বর্তমান ২০১৪ সালের প্রথম চার মাসে ব্যাংকটিকে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্যাংকের মোট মূলধন যেখানে থাকার কথা ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। সেখানে এখন মূলধন আছে ৪৭৪ কোটি টাকা। ৬৫৮ কোটি টাকারই কোনো হদিস নেই।
ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সর্বশেষ যে ২০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছেন তার সবই ব্যাড লোন বা আদায়যোগ্য নয়। এই খারাপ ঋণ ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা কমিশন খেয়েছেন তিনি।
ভূতুড়ে টাকার কুমির শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু
ব্যাংকারের পাশাপাশি তিনি একজন শীর্ষ মাছ ব্যবসায়ী হিসেবেও আবির্ভূত হন। ব্যবসা শুরু করার মাত্র দু’ বছরের মাথায় সুমদ্রে মাছ ধরার ট্রলার কিনেছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু ১৫০ কোটি টাকায়। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ইডেন ফিশারিজ চিটাগাং।
সূত্র জানায়, আবদুল হাই বাচ্চু ২০১১ সালে সমুদ্রে মাছ ধরার ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমেই চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিমের কাছ থেকে ‘ক্রিস্টাল-১’ ও ‘ক্রিস্টাল-২’ নামে দুটি মাছ ধরার ট্রলার কেনেন। মোর্শেদ মুরাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি শীর্ষ কাগজকে বলেন, তার সাথে আমার ব্যবসায়ীক কোন সম্পর্ক নেই। এমনি তাকে চিনি।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি) আমিরুল হকের স্ত্রীর ‘কর্ণতরী-১’ ট্রলারটি কিনে ব্যবসার পরিধি বাড়ান। কাজী বেলায়েত হোসেন মিঠুর ‘শিমুল কাই-২৯’, এসকে গ্রুপের ‘সিলভার-১’ এবং সারওয়ার জামাল নিজামের কাছ থেকে ‘স্পিড-১’ ও ‘স্পিড-২’ ট্রলার কেনেন আব্দুল হাই।
এছাড়া পেনিনসুলা গ্রুপের চারটি বড় মাছ ধরার ট্রলার কেনেন। অল্প সময়ের মধ্যে এত টাকা কোথা থেকে পেলেন তা জানে না কেউ।
আব্দুল হাই যাদেরকে ম্যানেজ করতেন
আব্দুল হাই নিজেকে বাঁচাতে এ কমিশনের টাকার ভাগ এবং বেসিক ব্যাংক থেকে সুবিধা দিয়েছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্তব্যাক্তিদের। বাদ যাননি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও। নাম এসেছে কিছু দুদক কর্মকর্তার। তাদের সুপারিশে ঋণ দেওয়া হয়েছে তাদের আত্মীয় স্বজনদের। তিনি ম্যানেজ করতেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের, পুলিশ সদস্যদের, সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠজনদের, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মকর্তাদের। কাউকে নগদ টাকা, নয়ত উপহার, ঋণ এবং বিদেশ সফরের মাধ্যমে ম্যানেজ করতেন।
আব্দুল হাইয়ের বিদায়
৪ জুলাই অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু। প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোক বলে পরিচিত এ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন খাতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিশেষায়িত ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে সর্বপ্রথম অনুসন্ধানে নামে দুদক। দুদক টিম তখন বেসিক ব্যাংকের কিছু নির্দিষ্ট তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চায়।
কিন্তু ঋণ জালিয়াতিসহ আরো কিছু অভিয়োগের তালিকা বড় হওয়ায় সময় নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতিমধ্যে হল মার্ক কেলেঙ্কারি সামনে এলে এ তদন্তে ভাটা পড়ে। তবে থেমে থাকেনি বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম।
বর্তমানে ব্যাংকের অবস্থা
২০০৯ সালে যখন আব্দুল হাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন তখন ব্যাংকের বাৎসরিক মুনাফা ছিল ৬৪ কোটি টাকা। আর ৪ জুলাই তিনি যখন শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে পদত্যাগ করেন তখন রাষ্টায়ত্ত্ব এ ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ বেড়েছে।
২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ, বর্তমানে তা ৩৬ দশমিক ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরের প্রতিবছরই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ১৪১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সেখানে ২০১০ সালে ২২৪ কোটি, ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪৯ কোটি টাকায়। ক্রমান্বয়ে ২০১২ সালে ৭০৬ কোটি এবং ২০১৩ সালে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০১৪ এর জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪ হাজার ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সালে নয়টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ৪৫৬ কোটি টাকা, ২০১০ সালে আটটি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ৪৯৪ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ৮৮১ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের এক হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা এবং ২০১৩ সালে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের দুই হাজার ৩০৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। মূলধন থাকার কথা ১ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, আছে ৪৭৪ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৬৫৮ কোটি টাকার বেশি। এই ঘাটতি টাকার কোন বিবরণ নেই।
আর ২০১৩ সাল শেষে ব্যাংকটির নিট লোকসানের পরিমাণ ৫৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকৃত লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২৬২ কোটি টাকা।
টাকা আত্মসাতের অভিনব কৌশল
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়েছে যে, ঋণের নামে বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে। এ অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাসহ ব্যাংকাররা।
চক্রের সদস্যরা
গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরে কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। তবে সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাইকে বাঁচিয়ে কৌশলে তারই আস্থাভাজন কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়া হয়। ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৫ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে চাকরি হতে বরখাস্ত করা হয়। ২৬ মে এ ব্যাংকটির গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখার ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আব্দুল হাইয়ের চক্রের সদস্যরা হলেন ব্যাংকটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ মোনায়েম খান, শান্তিনগর শাখার জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মোহাম্মদ আলী ও ব্যাংকের গুলশান শাখার ক্রেডিট ইনচার্জ এসএম জাহিদ হাসান।
বরখাস্ত করা হয় গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক এসএম ওয়ালিউল্লাহকে। গত ১৫ এপ্রিল এ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক শিফার আহমেদসহ ছয় কর্মকর্তাকে একই অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করে ব্যাংকটির পরিচালনা পরিষদ।
পাঠক মন্তব্য
হায়রে অবাগা দেশ? যেকানে সততার মূল্য নেই, মেধার মূল্য নেই, আছে চোর-বাটপারেদর কদর।
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন