বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) সরকারি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার গুরুদায়িত্ব বিজি প্রেসের। তবে সরকারি এই ছাপাখানাতেই রয়েছে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রতিষ্ঠানটির আলামত ধ্বংস বিভাগের এক কর্মচারীর মাধ্যমে অভিনব পদ্ধতিতে বাইরে আসত গোপনীয় প্রশ্ন। তাকে আবার ওই প্রশ্ন সরবরাহ করত বাইন্ডিং বিভাগের এক কর্মচারী। এর পর একটি চক্র মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেই প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করত। গত বুধবার বিজি প্রেসের দুই কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে সিআইডি।
গ্রেপ্তাররা হলো– বিজি প্রেসের আলামত ধ্বংস বিভাগের মজনু মিয়া ও প্রশ্ন বাইন্ডার আকরাম হোসেন। তাদের মধ্যে মজনুকে রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে এবং আকরামকে রামপুরা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গত বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে তোলা হলে আকরাম ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় এবং মজনুকে তিন দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
সিআইডি সূত্র জানায়, বিজি প্রেসে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় নিরাপত্তার স্বার্থে সবাইকে বিভিন্ন তল্লাশি চৌকি পার হতে হয়। তবে দীর্ঘদিন কর্মরত ওই দুই কর্মচারী ঠিকই এর ফাঁকফোকর বের করে ফেলে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে আকরাম অফিসের নির্ধারিত সময়ের আগে গিয়ে প্রশ্ন শৌচাগারে লুকিয়ে রাখত। এর পর ময়লার ঝুড়িতে করে সেই প্রশ্ন বাইরে আনত মজনু। ওই প্রশ্ন মজনু পরে বিক্রি করত লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি মিজানুর রহমান বা এমডি মিজানের কাছে। প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া মিজান গত ১৩ জুলাই দল থেকে বহিষ্কারের পর থেকে আত্মগোপনে।
মামলাটির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ২০০০ সাল থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে আসছে মজনু। তবে ২০১৮ সালের পর আর এ চক্রে ছিল না বলে দাবি আকরামের। ওই বছর তাদের দু’জনকে ডিবি পুলিশ আটক করলেও জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়। তবে কী কারণে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়, এখনও জানা যায়নি। প্রাথমিক তদন্তে মজনুর ব্যাংক হিসাব নম্বরে দুই-আড়াই কোটি টাকা এবং আকরামের হিসাব নম্বরে কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।
সিআইডির মুখপাত্র বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) আজাদ রহমান বলেন, বিজি প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের বিশেষ হোতা মজনু ও আকরাম। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
ধরা পড়ে চক্রের সদস্য, বন্ধ হয় না প্রশ্ন ফাঁস
বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাড়াও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভিন্ন নথি ছাপা হয়। তবে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে বিতর্ক। আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া আকরামের কথায়ও উঠে এসেছে এ তথ্য। জিজ্ঞাসাবাদে সে পুলিশকে জানিয়েছে, বিজি প্রেসের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের আলাদা দুটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এর হোতা প্রেসের সাবেক কম্পোজিটর শহীদুল ইসলাম ফকির ও চাকরিচ্যুত এটিএম গোলাম মোস্তফা। সম্পর্কে তারা চাচা-ভাতিজা। সে আরও জানায়, ২০০৮ সালে চাচা-ভাতিজার চক্রে যোগ দেয়। এক সেট প্রশ্নের জন্য তাকে দেড় লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত দিত মজনু। পরে ওই প্রশ্ন এমডি মিজান প্রেসের আশপাশ থেকে সংগ্রহ করত। তবে ২০১৮ সালে সে এ কাজ ছেড়ে দেয় বলে দাবি করেছে।
এই চক্রে বিজি প্রেসের বাইন্ডার লাবণী বেগম, হামিদুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক খন্দকার মোহাম্মদ আলী, প্রুফরিডার আব্দুল জলিল, পিএসসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুর রউফ, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজার রহমান, আরিফ, আতিকুল ইসলাম ও শাফিয়ার রহমান ছিলেন বলে জানা গেছে। গত বছর রংপুর থেকে গোলাম মোস্তফা গ্রেপ্তার হন।
এ বিষয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এসএম শাহ্ হাবিবুর রহমান হাকিমকে কল করলে তিনি বিষয়টি জানার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। আর অধিদপ্তরের মুখ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা আফজাল হোসেন বলেন, ওই দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন