আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়া শুরু হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। গত ১৩ই আগস্ট থেকে সংস্থাটির অনুসন্ধান কার্যক্রমেও গতি পায়। প্রতিদিনই নতুন নতুন অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিতে থাকে দুদক। এরই মধ্যে মঙ্গলবার সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা আকস্মিক পদত্যাগ করেন। তাদের এই পদত্যাগে কমিশনের নিয়মিত কার্যক্রম অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত, মামলার সিদ্ধান্ত, চার্জশিটের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো থেমে গেছে। অন্যদিকে প্রতিদিন আসা শত শত অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে সেগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির আইন অনুযায়ী সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমিশনের। কমিশন শূন্য থাকলে এসব কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। যত দ্রুত কমিশন গঠন হবে তত দ্রুত স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারবে দুদক।
সূত্র জানায়, গতকাল বিকালে সাড়ে তিনটার পর শূন্য কমিশনে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সমন্বয় সভা করেন। এতে ঊর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলমান অনুসন্ধান ও তদন্তের কার্যক্রম নিয়মিত চালিয়ে যাবেন কর্মকর্তারা। এ সময় তারা আরও বলেন, নতুন কমিশন না আসা পর্যন্ত আইন ও বিধি অনুযায়ী দুদকের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। জমা পড়া অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই চলবে। আর নতুন কমিশন এলেই সেগুলো সভায় তোলা হবে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের অভিযোগ কেন্দ্রে অন্তত একশ’ অভিযোগ জমা পড়ে। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই দুদক চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়। এ ছাড়া দুদকের হটলাইনে (১০৬) তিন শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। তবে হটলাইনে আসা অনেক অভিযোগই সংস্থাটির তফসিলভুক্ত হয় না। অন্যদিকে বিভিন্ন সমন্বিত জেলা কার্যালয়েও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করেন। এই সংখ্যাটাও কম নয়।
দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন ও বিধি অনুযায়ী এ মুহূর্তে কোনো অভিযোগ আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। তবে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। অবশ্য একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে পরিমাণ অভিযোগ প্রতিদিন জমা পড়ছে তা দ্রুত অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত না নিলে কার্যক্রম ব্যাহত হবে। নতুন কমিশন নিয়োগ পাওয়ার পর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। একদিকে যেমন অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। অন্যদিকে চলমান শতাধিক নতুন অনুসন্ধান শেষ করে তা মামলা ও তদন্ত কার্যক্রম। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে নানা ধরনের প্রভাবও পড়তে পারে বলে শঙ্কা করছেন এই কর্মকর্তারা।
এক দুদক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, দুদক যে কৌশলে কাজ করে সে অনুযায়ী কর্মকর্তা নেই। বিশেষ করে একটি অনুসন্ধান ভালোভাবে শেষ করে দেয়ার মতো দক্ষ কর্মকর্তার সংখ্যা কম। আর এই মুহূর্তে যে পরিমাণ চাপ তাতে জমা হওয়া নতুন অভিযোগ অনুসন্ধানের আওতায় আসলে আরও বড় ধরনের চাপ পড়বে। আর এ জন্য কমিশন পুনর্গঠন খুবই জরুরি।
আছে পুরনো মামলার চাপও: দুদক সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির দায়ের করা চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিম্ন আদালতে সাড়ে তিন হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং হাইকোর্টের আদেশে প্রায় ৫ শ’টি মামলা বিচার কাজ স্থগিত আছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে ৭৩২টি রিট, ৯২৭টি ফৌজদারি বিবিধ মামলা, ১ হাজার ২২৩টি ক্রিমিনাল আপিল ও ৬৮১টি ফৌজদারি রিভিশন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, আগের চলমান অনুসন্ধান যেমন এ মুহূর্তে চাপ সৃষ্টি করেছে তেমনি অনেক আগের বিচারাধীন মামলাগুলোও শেষ হচ্ছে না সহসায়। ফলে এত কাজ একসঙ্গে সামলাতে গেলে কমিশনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কমিশনের বিদায়ে স্বস্তি: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশন বিদায় নেয়ায় অনেকটাই স্বস্তি পেয়েছেন দুদকের অনেক কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ, এই কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতি দমনের চেয়ে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ২০২১ সালে দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তবে হয়েছে তার বিপরীত। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, ঘুষ ও অর্থপাচারের ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে আসলেও কোনো অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করেছে তার কমিশন।
তিনি আরও বলেন, সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কিছু ছোট পদের জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও মামলা করেই দুর্নীতি দমনে সফলতার কথা বলে বেড়িয়েছেন কমিশনাররা। কিন্তু অন্যদিকে প্রভাবশালী এমপি, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও তা আমলেই নেননি তারা। তবে তারা যাওয়াতে এখন স্বস্তি নেমে এসেছে। কমিশনের অনেক কর্মকর্তাই খুশি। বিশেষ করে যাদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে তারাই খুশি। যোগ্য অনেক কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে রেখেছিল এই কমিশন। একেকজন তিনবার তালিকায় শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি; বরং তালিকার নিচের দিকে যারা ছিলেন তাদের প্রমোশন দেয়া হয়। এ নিয়ে অনেক কর্মকর্তাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন