আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশের অতিরিক্ত উপ মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) প্রলয় কুমার জোয়ারদার। তার অপকর্মের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পায়নি কেউ। প্রলয় কুমার জোয়ারদার নেত্রকোণার বারহাট্টা ঝিতন গ্রামের ধলাই নদী দখল করে করেছেন ফিশারি। জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৪-৫’শ জনকে বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া এলাকায় তৈরি করেছেন আধিপত্যের সাম্রাজ্য। তবে প্রলয় কুমার জোরদারের বাবার দাবি বিনা টাকায় চাকরি দিয়েছেন তার ছেলে। প্রলয় কুমার জোরদার উপজেলার বারহাট্রা সদর ইউনিয়নের ঝিতন গ্রামের উপেন্দ্র জোরদারের ছেলে।
জানা গেছে, প্রলয় কুমার জোয়ারদার বারহাট্টা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঝিতন গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তিনি প্রথমে এনএসআইয়ে চাকরি করেন। পরে চাকরি বিধি লঙ্ঘন করার কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে তথ্য গোপন করে ২৪তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে যোগদান করেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। তাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রোটোকল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রটোকল অফিসার হিসেবে যোগদান করার পর থেকে শুরু হয় তার ক্ষমতার আধিপত্য, চাকরি বাণিজ্য। সেই সুবাদে প্রলয় কুমার জোয়ারদার বিজিবি, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, এনএসআই, ডিসি অফিস, জজ কোর্ট এবং স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি বাণিজ্য শুরু করেন। কয়েক বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেন। এসব চাকরি বাণিজ্য বিষয়টি হ্যান্ডেল করতেন তার ছোট ভাই শ্যামল জোয়ারদার।
প্রধানমন্ত্রী প্রটোকল অফিসার হওয়ার পর তিনি তার চাচা শ্বশুর স্বপন ভট্টাচার্যকে সংসদ নির্বাচনে যশোর-৫ মনিরামপুর আসন থেকে আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত করেন। ২০১৮ সালে নির্বাচিত হলে স্বপন ভট্টাচার্যকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। মন্ত্রী হওয়ার পেছনেও সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি (প্রলয় কুমার) যশোর জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনারসহ বিভিন্ন দপ্তরে ও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এনে প্রলয় কুমারের বদলির আবেদন করেন। তারপরও প্রলয় কুমার জোয়ারদারকে তারা সরাতে পারেননি। এমনকি প্রলয় কুমার নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি হন। তবুও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে যোগ না দিয়ে যশোর জেলা পুলিশ সুপার থেকেই নির্বাচন শেষ করেন। এরপর পদোন্নতি পাওয়া পদে যোগ দেন।
এদিকে ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর প্রলয় কুমার জোয়ারদারের স্ত্রী ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে ৮-৯ হাজার লোকের ভুড়িভোজের আয়োজন করা হয়। এতে স্থানীয় জেলার সংসদ সদস্যসহ দেশের বিভিন্ন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সরকারি আমলা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আসেন।
শাস্তি হতে পারে নাজমুলদেরশাস্তি হতে পারে নাজমুলদের
এলাকায় পরিপাটি একটা বাড়ি ও সামান্য সম্পদ করলেও ঢাকার উত্তরায় সাততলা বাড়িসহ একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে তার। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বাড়ি এবং সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। এর মধ্যে ভারতের কলকাতা, চেন্নাই ও দিল্লিতে বাড়ি করেছেন। তবে তার এক নিকট আত্মীয় মাধ্যমে জানা গেছে, তিনি দিল্লিতে ডেভেলপার ব্যবসাও করেছেন। বাড়ি করেছেন সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে ও আমেরিকায়। বিশেষ করে যেখানেই স্ত্রীর চিকিৎসা করেছেন সেখানেই তিনি বাড়ি করেছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ছাত্র জনতাকে দমন করার জন্য অন্যতম পরিকল্পনাকারীও ছিলেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশ কর্মকর্তা অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকে তারও কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রলয় কুমার জোরদারের সাথে তার পরিবারের কারো কোন যোগাযোগ নেই বলে জানান তার বাবা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রলয় কুমার জোয়ারদারের এলাকার এক ব্যক্তি বলেন, আমি অন্য একজনের মাধ্যমে আমার ছেলেকে পুলিশের চাকরির তদবির করি। চাকরি নিশ্চিত হওয়ার পরও তাকে বাদ দেওয়া হয়। পরে জানতে পারলাম প্রলয় কুমার জোয়ারদারের নির্দেশে আমার ছেলেকে বাদ দেওয়া হয়।
আটপাড়া উপজেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরি পাওয়া একজন নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ২০১০ সালের আগে আমি ৭ লাখ টাকা দিয়ে প্রলয় কুমার জোয়ারদার এর মাধ্যমে চাকরি পেয়েছি।
প্রলয় কুমার জোরদার এর বাবা উপেন্দ্র জোয়ারদার বলেন, আমার ছেলে বারহাট্টাসহ জেলায় প্রায় ৪-৫ শত মানুষের চাকরি দিয়েছে বিনা টাকায়। এজন্য মানুষ তাকে অনেক ভালোবাসে। পুত্রবধূ মারা যাওয়ার পর শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে ৫-৭ হাজার লোক এসেছে। এটা সব মানুষের ভালোবাসার প্রতিফলন। তবে আন্দোলনের পর থেকে প্রলয়ের সাথে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই। এ নিয়ে আমরা খুব টেনশনে আছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন