অস্কার জয়ী মহাকাব্য ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ এর একটি স্মরণীয় দৃশ্যে রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস জেনারেল ম্যাক্সিমাসকে বলেন, তিনি ম্যাক্সিমাসকে তার জন্মভূমি স্পেনে একজন কৃষক হিসেবে কল্পনা করা কঠিন বলে মনে করেন। এটি কৃষিকাজের প্রতি ম্যাক্সিমাসের প্রকৃত আবেগের ইঙ্গিতবাহী।
একইভাবে গ্রামীণ মাদাগাস্কারে আবেগ তাড়িত প্রকল্পে ঝুঁকছেন এমন একজন কৃষক হিসেবে পিটার বোকার্টকে চিত্রিত করা কিছুটা কঠিন। বিশেষত শহুরে পরিবেশে তার সরব উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে। যখন তাকে তার কৃষকের টুপি পরা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তখন তিনি বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘বাড়ন্ত জিনিসগুলি আত্মাকে নিরাময় করে’।
বিশ্বের বিশিষ্ট মানবাধিকার রক্ষাকারীদের একজন হলেন পিটার, যিনি প্রায় দুই দশক ধরে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য নথিভুক্ত করেছেন।
পিটারের সঙ্গে আলাপচারিতার এক মুহূর্তে। ছবি: সাকিব সরকারে
চেচনিয়া ও আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা ও সিয়েরা লিওন, পিটার সবখানেই ছিলেন। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) সঙ্গে কাজ করেছেন। সম্প্রতি সংস্থাটির জরুরি পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
স্ট্যানফোর্ড ল স্কুল থেকে পড়াশোনা করা পিটার কাজের ক্ষেত্র হিসেবে মানবাধিকার বেছে নিয়েছিলেন সেইসব মানুষদের জন্য গভীর সমবেদনা থেকে, যাদের হয়ে কথা বলা দরকার এবং তাদের দুঃখ কষ্ট তুলে ধরার জন্য একটি কণ্ঠস্বর দরকার।
পিটার বর্তমানে ‘ফর্টিফায় রাইটস’-এ সিনিয়র ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। চলতি বছরের শুরুতে তিনি এই পদে কাজ করতে শুরু করেছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ব্যাপক পুলিশি সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত ও তথ্য নথিভুক্ত করতে তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেন।
পিটার বোকার্টের সঙ্গে বাংলা আউটলুকের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদের আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছিল। আধা ঘণ্টাব্যাপী আলাপচারিতায় পিটারের মানবাধিকারের কাজ এবং জুলাই বিদ্রোহের সহিংসতার তদন্ত নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলাপচারিতার কিছুটা বাংলা আউটলুক পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো। মূল সাক্ষাৎকার ইংরেজিতে নেওয়া।
ফয়সাল মাহমুদ : আমার প্রথম প্রশ্ন আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে। আইনজীবী হিসেবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পর প্রথম কখন আপনার মনে হলো মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা যায়? মানবাধিকার সংস্থার জন্য কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে আপনাকে কোন বিষয়টি অনুপ্রাণিত করেছিল?
পিটার বোকার্ট : ১৯৯৪ সালে আমি যখন স্ট্যানফোর্ড ল স্কুলে ছিলাম তখন দক্ষিণ আফ্রিকার লিগ্যাল রিসোর্সেস সেন্টারের সঙ্গে কাচ করেছি। ওই সময় দেশটি বর্ণবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ করছিল। সে সময় আমরা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিঅ্যাশন বিলের খসড়া প্রণয়ন এবং মৃত্যুদণ্ড বাতিলের পক্ষে কাজ করছিলাম।
স্বাধীনতাকামী চেচেনদের দৃঢ় সংকল্পে গভীরভাবে প্রভাবিত হন পিটার বোকার্ট। ছবি: সাকিব সরকার
আর এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি অনুধাবন করি আইন কী করে সমাজকে পুনর্মিলনের দিকে নিয়ে যেতে এবং অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ফয়সাল মাহমুদ : সুতরাং সেটাই ছিল আপনার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট?
পিটার বোকার্ট : হ্যাঁ, আপনি এটাকে আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট বলতে পারেন। পরবর্তীতে আমি কসোভো এবং বলকানে সংঘাত নিয়ে কাজ করতে গিয়েছিলাম এবং উগান্ডায় লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মির যুদ্ধও নথিভুক্ত করেছিলাম। যেহেতু আমি সবেমাত্র আইন স্কুল থেকে স্নাতক শেষ করেছিলাম তাই এটি বিশেষত আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। উত্তর উগান্ডায় ১৪ বছর বয়সী ছেলেদের লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি অপহরণ করে হত্যা করছিল। আমি সেখানে ওই বয়সী ছেলেদেরই সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। একটি ছেলের কথা মনে পড়ছে,যার বয়স মাত্র ১৪ বছর ছিল এং যে ৫০ জনকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছিল। এই ধরনের বর্বরতা এবং জঘন্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করা খুবই অস্বস্তিকর ছিল।
ফয়সাল মাহমুদ : বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা ব্যাপক ও বিস্তৃত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কাজ করছেন এমন কোন দেশের ঘটনা ব্যক্তিগতভাবে আপনার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে এবং কেন বিস্তারিত বলবেন কি?
পিটার বোকার্ট: যে সংঘাতগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে তার মধ্যে প্রথম হলো, চেচেন এবং রাশিয়ান সরকারের মধ্যে চেচনিয়ার যুদ্ধ। চরম বর্বরতার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও চেচেন জনগণের স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় সংকল্প দেখে আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
দুই পক্ষের লড়াই এতটাই তীব্র ছিল যে হাসপাতালগুলি প্রায়শই রক্তে ভরে যেত। তবুও চেচেনরা তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। রাশিয়া তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও আমার দেখা সবচেয়ে অতিথিপরায়ণদের মধ্যে আমি চেচেন জনগণকে রাখবো।
দ্বিতীয় সংঘাত যা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তা ছিল ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের গৃহযুদ্ধ। এই সংঘাতকে প্রায়শই ভুলভাবে খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের সঙ্গে ঐতিহ্যগত অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসীদের।
একটি ঘটনা এমন ছিল, প্রায় ১১ বছর বয়সী ছোট এক ছেলে ও তার মা বিদ্রোহীদের বাধার মুখে পড়েছিল। মা তার ছেলের জীবন ভিক্ষা চাইছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা ছেলেটিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ একজন মুসলিম হিসাবে তাকে ভবিষ্যতের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছিল বিদ্রোহীরা। এই মুহূর্তটি ওই সংঘাতের ব্যাপকতা এবং মর্মান্তিক পরিণতির দিকটি তুলে ধরে।
ফয়সাল মাহমুদ : ইরাক এবং আফগানিস্তানে আপনার যে অভিজ্ঞতা, আপনি সেখানে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলি দেখেছেন অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সেগুলোর কীভাবে তুলনা করবেন? ইরাক আফগানিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলি কি অন্যান্য এলাকার মতোই ছিল, বা আপনি কি এই অঞ্চলগুলির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো অনন্য দিক দেখেছিলেন?
পিটার বোকার্ট: বিপ্লবের সময় লিবিয়ায় থাকাকালীন আমি কিছু সালাফি যোদ্ধার মুখোমুখি হয়েছিলাম যারা জিজ্ঞাসা করেছিল আমেরিকা কখন তাদের সাহায্য করবে। আমি ইরাক এবং আফগানিস্তানের ফলাফলের দিকে ইঙ্গিত করে প্রতি উত্তরে উল্লেখ করেছিলাম যে, মুসলিম সংঘাতে আমেরিকান হস্তক্ষেপ ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে।
সামরিক শক্তি ব্যবহারের পরিবর্তে জনগণকে তাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমাদের গণতন্ত্রকে সমর্থন করা উচিত। বাস্তবতা হলো সাদ্দাম হোসেন এবং তালেবান শাসনের চেয়ে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের পর ইরাক এবং আফগানিস্তানে অনেক বেশি লোক মারা গেছে।
মূল শিক্ষা হলো সামরিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সামরিক হস্তক্ষেপ না করে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারের মাধ্যমে এই দেশগুলির মধ্যে গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থনে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
ফয়সাল মাহমুদ : আপনি কি কখনো গাজায় কাজ করেছেন?
পিটার বোকার্ট : হ্যাঁ, আমি গাজায় অনেক সময় কাটিয়েছি এবং এখনও সেখানে মানবাধিকার কর্মী এবং বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। পরিস্থিতি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ দেয়াল দিয়ে গাজা সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে। ফলে মানবিক সহায়তা প্রবেশ বা তদন্তকারী ও সাংবাদিকদের পক্ষে পরিস্থিতি নথিভুক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বিশ্বকে গাজার বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করা থেকে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেখানে মানবতার বিরুদ্ধে নীরব অপরাধ করা হচ্ছে। গাজার ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করতে যেসব সাহসী সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং প্রচুর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। কারণ তারা সেখানে প্রতিদিনের নৃশংসতা প্রকাশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
ফয়সাল মাহমুদ : বাংলাদেশে কতবার কাজ করেছেন? আমি জানি আপনি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু রোহিঙ্গা প্রেক্ষাপটের বাইরে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে এটি কি আপনার প্রথম সফর?
পিটার বোকার্ট : আমি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হওয়া গণহত্যা নথিভুক্ত করতে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সফর করেছি। এরপর থেকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গা ইস্যুকে উপেক্ষা না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে আছে এবং সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। আগস্টে আরাকান আর্মির গণহত্যায় তা প্রমাণিত হয়েছে। সে সময় ১০০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশ দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত খাবার, বাসস্থান ও শিক্ষা এবং চলাফেরার স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করতে আরও বেশি আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। সন্তানদের স্কুলে যেতে না পারা এবং চাকরিতে বিধিনিষেধের মতো বিষয়ে রোহিঙ্গারা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। তারা কাজ করে পরিবারকে সহায়তা দিয়ে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে চায়। আর এর জন্য তাদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা প্রয়োজন।
রোহিঙ্গা এবং বাঙালিদের মধ্যে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ যে বাংলাদেশ তাদের অব্যাহতভাবে সমর্থন দিচ্ছে। মিয়ানমারে যে যুদ্ধক্ষেত্র সেখানে তাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলা উচিত নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এগিয়ে আসতে হবে, কারণ দশ লাখ লোককে আতিথেয়তা দেওয়া একটি দরিদ্র দেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরে যাবে এটা তাদের সবচেয়ে বড় আশা। তার আগ পর্যন্ত তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য বর্ধিত পুনর্বাসনের সুযোগ এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশকে সমর্থন করা দরকার।
ফয়সাল মাহমুদ : যেমনটি আগে বলেছি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ বাদ দিয়ে, আপনি কি আগে বাংলাদেশে অন্য কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা বলেছেন, নাকি এই প্রথমবার আপনি এই বিষয়গুলোর ওপর মনোযোগ দিয়েছেন?
পিটার বোকার্ট : হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে আমার কাজের সময়, র্যাবের হত্যাকাণ্ড, মৃত্যুদণ্ড এবং গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে আমরা ব্যাপকভাবে তদন্ত করেছি। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এটাই আমার প্রথম মিশন।
ফয়সাল মাহমুদ : এখানে যা যা পর্যবেক্ষণ করেছেন তার কী সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে পারেন? কি ধরনের লঙ্ঘন ঘটেছে? এই মুহূর্তে কি সেগুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন, নাকি এখনই বিস্তারিত প্রকাশ করতে চান না?
পিটার বোকার্ট : জুলাই এবং আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সহিংসতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক ছিল, কারণ এতে শুধু নিরাপত্তা বাহিনীই বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়নি বরং আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগও সহিংসতায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। এই গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি নাগরিকরা পুলিশের পাশে সশস্ত্র হয়ে দাঁড়ানো এবং বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি ছুড়তে দেখা খুবই বেদনাদায়ক।
এটি রাষ্ট্র-অনুমোদিত সহিংসতার ইঙ্গিত দেয়, যা দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তোলে। কারণ আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগকে সমর্থনকারী অনেক ব্যক্তি সহিংসতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
বর্তমানে মব জাস্টিস প্রতিরোধের এই সময়ে সংঘাতের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন তাদের জন্য ন্যায়বিচার পেতে আমরা উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়েছি। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, যারা এই সহিংসতার জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে মানুষজন যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। বরং তার পরিবর্তে জবাবদিহিতা এবং মীমাংসা—উভয়ের জন্য একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য নেতারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও দমন-পীড়নের হাতিয়ার-নিরাপত্তা বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্র-রয়ে গেছে। আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে নতুন কোনো রাজনৈতিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে স্থায়ী করার জন্য এই নিপীড়নমূলক সরঞ্জামগুলি যেন ব্যবহার করতে না পারে।
পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই ক্ষমতাসীনদের সমর্থন করে, কারণ অনেক ব্যক্তি তদবির, ব্যবসায়িক চুক্তি এবং অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। এই ধরনটি কেবল বাংলাদেশেই নয় মিশর, সিরিয়া এবং মিয়ানমারের মতো দেশেও দেখা যায়। যেখানে অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির লোকজন এই সিস্টেম ধরে রেখে লাভবান হয়।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সুবিধাগুলি কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এই সিস্টেম ব্যাপক বিস্তৃত দরিদ্রতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। আর এই সিস্টেমের কারণে শিক্ষিত ছাত্র যারা চাকরি পেতে সংগ্রাম করে তারাসহ সাধারণ নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভোগান্তিতে পড়ে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্যকে মোকাবিলা করা অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য অপরিহার্য যা বিক্ষোভ এবং অস্থিতিশীলতাকে উসকে দেয়।
সমস্যাটি শুধু বর্তমান নেতাদের নয়, রাজনৈতিক দমন ও অর্থনৈতিক তদবিরবাজদের বৃহত্তর ব্যবস্থার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য কেবল নেতাদের বদলালে হবে না, সিস্টেমটাকেই সংস্কার করতে হবে।
ফয়সাল মাহমুদ : একজন অভিজ্ঞ মানবাধিকার গবেষক এবং আইনজীবী হিসেবে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য আপনার কোনো নির্দিষ্ট পরামর্শ আছে? তাদের কিসের উপর ফোকাস করা উচিত এবং কোন ধরনের গবেষণা বা কাজে তাদের নিযুক্ত হওয়া উচিত?
পিটার বোকার্ট : মানবাধিকার আইন শেখানোর বিধিনিষেধ এবং মানবাধিকার সংস্থার বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ ২০১৩ সালের পর থেকে মানবাধিকার কর্মীদের প্রায় পুরো প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে সংস্থাগুলির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া এবং তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা। নতুন একটি মানবাধিকার কর্মী প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য তাদের ক্ষমতায়ন প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
আমার প্রধান উপদেশ হলো তাদের এটা বুঝতে হবে যে মানবাধিকারের ডকুমেন্টেশনকে অবশ্যই অরাজনৈতিক থাকতে হবে। ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী দল, কোন দল এই লঙ্ঘনের জন্য দায়ী তা বিবেচ্য নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষভাবে নথিভুক্ত করা আবশ্যক।
আমাদের সমর্থন করা কোনো দলের মানবাধিকার লঙ্ঘন জবাবদিহিতার আওতায় না আসা লঙ্ঘনের চক্রকে স্থায়ী করে তুলে। এই সরকার এবং ভবিষ্যতের যে কোনো সরকার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিসহ সবার মানবাধিকারকে সম্মান করবে তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফয়সাল মাহমুদ : আমার শেষ প্রশ্ন, বলা যায় একটু বেশি ব্যক্তিগত। আপনার ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তারিত কি শেয়ার করবেন? আমি বুঝতে পারছি আপনি মাদাগাস্কারে গেছেন এবং সেখানে একটি কৃষি প্রকল্পে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এমনকি কিছু উদ্বাস্তুদের কর্মসংস্থানও করেছেন। কোন বিষয়টি আপনাকে মাদাগাস্কারে যেতে প্ররোচিত করেছিল এবং কৃষিকাজ ও এই ধরনের কাজ করতে আকৃষ্ট করেছিল?
পিটার বোকার্ট : রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রত্যক্ষ করার পর আমি গভীর নিরাশা অনুভব করেছি। আমরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত ও গণহত্যা হতে দেখেছি। আমরা এই সহিংসতা ও ধ্বংস রোধ করতে পারিনি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে আমার মনোযোগ পরিবর্তন করতে এবং ২০১৭ সালে মাদাগাস্কারে একটি খামার তৈরিতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল।
ফ্রান্সেও আমার একটি খামার আছে। বার্গান্ডিতে অবস্থিত। সেখানে আমরা সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং অন্যান্য অঞ্চলের শরণার্থীদের কর্মসংস্থান এবং সহায়তা প্রদান করেছি। মাদাগাস্কারে আমাদের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে দুই শতাধিক স্থানীয় শিশুর স্কুলের ফি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে তাদের শিক্ষায় অর্থায়ন।
আমি কর্মের মাধ্যমে আমাদের মূল্যবোধ বাঁচানোতে বিশ্বাস করি। অনেক মুসলমান দান এবং ভাগ করে নেওয়ার গুরুত্ব বোঝেন, যা প্রার্থনা এবং জাকাতের মতো বিষয়গুলোতে প্রতিফলিত হয়। আমার জন্য এই মূল্যবোধগুলি মানুষ হওয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং একে অপরকে সহায়তার মধ্যে।
ফয়সাল মাহমুদ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন