প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন স্বপদে থাকতে পারেন কি পারেন না-এ বিতর্ক এখন তুঙ্গে। বিতর্কটি যতটা না মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে, তার চেয়ে বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রেসিডেন্ট মো: সাহাবুদ্দিনের সেকেন্ডহোম, পার্টনারশিপ বিজনেস এবং সংযুক্ত আরব-আমিরাতে রেসিডেন্সির তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনো সয়লাব।
পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ করা মহামান্য প্রেসিডেন্ট মো: সাহাবুদ্দিনকে কেন সরিয়ে দেয়া হচ্ছে নাÑ এ প্রশ্নও করছেন অনেকে। তাকে নিয়ে ওঠা সাম্প্রতিক বিতর্কে অনেকে এমন কথাও বলছেন, মো: সাহাবুদ্দিনের উচিত নিজ থেকে সরে যাওয়া। কিন্তু এ প্রশ্নে পরবর্তী সরকার অভূত এক গোলকধাঁধায় পড়ুক সেই পথ যেন শেখ হাসিনা আগেভাগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। কারণ আপাতদৃষ্টিতে বিদ্যমান সংবিধানে এমন কোনো ছিদ্রপথ নেই, যা দিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিটি সাংবিধানিক এ আসন থেকে নামতে পারেন। কিংবা তাকে বিতাড়িত করা যেতে পারে। বিদ্যমান অবস্থা থেকে বেরুনোর পথ সংবিধান বিশ্লেষকদেরও অজানা। যদিও অধিকাংশ মানুষই কেবল প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের বিদায়ের মাঝেই এর সমাধান দেখছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি অত্যন্ত জটিল এবং সঙ্কটসংকুল বটে। সৃষ্টি করতে পারে এক ভয়াবহ সাংবিধানিক শূন্যতা।
নাগরিক সমাজের ভাবনার বিষয় এই যে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, সরকারের মন্ত্রী এমনকি সাড়ে ৩শ’ এমপির পুরো সংসদ একযোগে পালিয়ে যাওয়ার নজির এটিই প্রথম। এ কারণে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হয়েছে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবোত্তর সরকার নিজেদের ‘বিপ্লবী সরকার’ ঘোষণা করেনি। কিন্তু কিছু কিছু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদকে ‘বিলুপ্ত’ ঘোষণা করেছে। পরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গ্রেফতার করা হয়েছে হত্যা মামলার আসামি ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুকে। বিগত সরকারের ‘শেষ চিহ্ন’ হিসেবে রয়ে গেছেন কেবল প্রেসিডেন্ট মো: সাহাবু্িদ্দন। নাগরিক সমাজ মনে করছেন, এ পদ তার ছেড়ে দেয়া উচিত। কিংবা তাকে অপসারণ করা প্রয়োজন।
প্রশ্নটা হচ্ছেÑ কেমন করে পদত্যাগ করবেন তিনি? তাকে অপসারণের পদ্ধতিটাই বা কি? এর উত্তর বিদ্যমান সংবিধানে নেই। ফলে সংবিধান নিয়েই তৈরি হয়েছে গোলকধাঁধা। আজকের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা ১৭ বারের সংশোধনীতে একবারও ভাবা হয়নি। এমনটি স্বীকার করছেন সংবিধান বিশ্লেষকরাই।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট দেলওয়ার হোসেন চৌধুরী বলেছেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট যদি নিজ থেকে পদত্যাগ না করেন, আইনত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও বর্তমান আইন বলছে, পরবর্তী সংসদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত ধরে নিতে হবে বর্তমান সংসদ বহাল রয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন, তাহলে তাকে ইমপিচ বা অভিশংসন করার বিধান রয়েছে। ইমপিচমেন্ট তখনই হয় যখন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের মতো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে সে ক্ষেত্রে এ বিষয়ে করণীয় জানতে এক্সিকিউটিভ সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স চাইতে পারেন। তৃতীয় কথা হচ্ছে, যেহেতু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। সেহেতু তার দায়িত্ব পালন করবেন ডেপুটি স্পিকার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার গ্রেফতার হলেও তিনি এখন পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত হননি। তার পদ বহাল রয়েছে। স্পিকারের স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও ওই শূন্যস্থান পূরণে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার হবেন স্পিকার। একইভাবে প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার হবেন প্রেসিডেন্ট। আইনি ব্যবস্থাপনায় এমনটি রয়েছে। সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে এটি স্পষ্ট করা হয়েছে।
তার মতে, প্রেসিডেন্টকে অপসারণের পদ্ধতি দু’টি। একটি হচ্ছে, তিনি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন তাহলে সংসদ রি-কল করে তাকে ইমপিচ করা। দ্বিতীয়তটি হচ্ছে, অ্যাডভাইজারি ওপেনিয়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টে প্রেরণ। সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম গৃহীত হবে। এটি পরিষ্কার।
‘প্রেসিডেন্টের নৈতিক স্খলন’ হয়েছে কি না এটি কে নির্ধারণ করবে? নৈতিক স্খলন হয়েছেÑ এমনটি তো যে কেউ মনে করলেই হবে না। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো উঠতেই পারে। সেটি তো প্রমাণ ও তদন্ত সাপেক্ষ। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তদন্ত করার এখতিয়ার তো সংবিধানে কাউকে দেয়া হয়নি। বরং সংবিধানের ৫১(১), ৫১(২) অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্টকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সাংবিধানিকভাবেই তিনি কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তদুপুরি সম্পতি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সঠিকতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন এবং সংশয়।’
এ বিষয়ে সিনিয়র এই আইনজ্ঞ বলেন, সংশয় থাকলেও যদি ডমেস্টিক অডিয়েন্সের কাছে কিংবা সরকারের কাছে যদি মনে হয় যে, প্রেসিডেন্টের নৈতিক স্খলনজনতি ক্রেডিবল তথ্য-উপাত্ত রয়েছে, তাহলেও সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স চাইতে পারে। উইথ রিপ্লেসমেন্ট অ্যাডভাইজারি ওপেনিয়ন চাইবেন সরকার। তবে এটি তাৎক্ষণিক এবং আপাত সমাধান। দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট ও শূন্যতা কিন্তু রয়েই যায়। কারণ এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ। এতে সুপ্রিম কোর্টকে উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই উপদেশ চাওয়ার আগে এ বিষয়ে উপদেশ প্রয়োজন কি না সেটি আগে প্রেসিডেন্টের কাছে প্রতীয়মান হতে হবে। খোদ প্রেসিডেন্টের বিষয়েই যদি প্রশ্ন ওঠে তাহলে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের উপদেশ প্রেসিডেন্ট চাইবেন কিভাবেÑ এটি সংবিধান কিংবা সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারের কোথাও উল্লেখ নেই।
অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার সংবিধানকে ইচ্ছেমতো কাটা-ছেঁড়া করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, কেউ চাইলেও বিদ্যমান সংবিধান সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারবে না। বর্তমান সরকার এই সংবিধানের আওতায় শপথ নিয়েও পড়েছে অভূত এক গ্যাঁড়াকলে। একদিকে তারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। অন্যদিকে সংবিধানের মধ্যেও থাকতে পারছে না। কয়েকটি দৃষ্টান্ত টানলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
প্রথমত, বিদ্যমান সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করা যাবে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল ও নজিরবিহীন এবং একসঙ্গে ৩শ’+৩শ’ করে মোট ৬শ’ এমপি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ‘নির্বাচিত’ থাকেন একসঙ্গে। এই বিধানের প্র্যাকটিস বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার করে গেছে। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, রদ, ষড়যন্ত্র ও সর্বোচ্চ শাস্তির কথা এমনভাবে সন্নিবেশ করা হয়েছে যে, বিগত সরকার বা তাদের কোনো দোসর যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে বর্তমান সরকারের সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে। তৃতীয়ত, ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে স্পিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু স্পিকার যদি অসমর্থ বা অনুপস্থিত থাকেন তাহলে কে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন এটি সংবিধান অনুধাবন করেনি। চতুর্থত, সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদে অনেক বিধান আছে, যা সরাসরি মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদের সরাসরি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। পঞ্চমত, সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদে সংবিধানের সিংহভাগ সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সাংবিধানিক গোলকধাঁধার মধ্যে সরকারের করণীয় অন্তত তিনটি পথের কথা উল্লেখ করেন এই আইনজ্ঞ।
প্রথমত, ক্ষতবিক্ষত এই সংবিধান বাতিল করে নতুন একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া। ৩শ’ নির্বাচনী আসনে মেম্বার অব কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি (এমসিএ) গঠন করা। যার একমাত্র কাজ হবে সংবিধান প্রণয়ন ও পাস। একই সঙ্গে সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য একযোগে গণভোট করা। দ্বিতীয়ত, ৫০-৬০ জনের সমন্বয়ে একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি বা কমিশন গঠন করা। যাদের একমাত্র কাজ হবে সংবিধানের খসড়া করা। সৃষ্ট নতুন সংবিধান সুষ্ঠু, অবাধ ও কার্যকর অংশগ্রহণমূলক গণভোটের মাধ্যমে পাস হবে। একই সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য গণভোটের আয়োজন করবে।
তৃতীয়ত, ১/১১-পরবর্তী সরকারের মতো এই সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর নির্ভর করবে। অর্থাৎ ১/১১ সরকারের মতো যতদিন থাকবে, থেকে যাবার পর পরবর্তী সরকার এসে তাদের মেয়াদ, চলমান কার্যাবলি ও সংবিধান পরিবর্তনের বৈধতা দেবে। প্রথম বিকল্প এবং দ্বিতীয় বিকল্প অবলম্বন করাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন ব্যারিস্টার নাজির আহমদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন