চক্রান্তকারীরা শ্রমিক নামধারী দুর্বৃত্তদের দিয়ে পোশাক শিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
বিজেএমইএ’র নেতাদের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার পরও তৈরি পোশাকশিল্পের অস্থিরতা দূর হচ্ছে না। শ্রমিকদের প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও নতুন নতুন দাবি সামনে আনা হচ্ছে। টানা ১৪তম দিনে গতকালও আশুলিয়ায় ৮৬টি কারখানা বন্ধ এবং ১৩৩টিতে কতৃপক্ষ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এছাড়া নিরাপত্তাজনিত কারণে গাজীপুরেও বেশ কয়েকটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে আশুলিয়া গাজীপুরে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক করাখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের পোশাকখাত। সংশ্লিষ্টমহল এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন শ্রমিক আন্দোলনের আড়ালে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে শিল্পখাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। অনেক কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগদান করতে চাইলেও তাদেরকে ভয় দেথানো হচ্ছে। শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার পরও তারা নতুন নতুন দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও ইন্দন রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া বলেন, গার্মেন্টসখাতে অস্থিরতার সৃষ্টির জন্য পতিত স্বৈরাচারের দোসরাই দায়ী। তাদের চক্রান্তে শ্রমিক নামে বহিরাগতরা এসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আমরা এ বিষয়ে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। পাশের দেশের বড় বড় নেতাদের বক্তব্য শুনলেই বুঝতে পারবেন কিভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এখন গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাই প্রতিটি নাগরিককে ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, গত ৫ আগস্টের পর বহু শিল্প মালিক দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। এ কারণে সেসব প্রতিষ্ঠানে বেতন পরিশোধ হচ্ছে না। যে কারণে অসন্তোষ থামছে না। শ্রমিক কখনো তার কর্মস্থলে আগুন দিতে পারে না, বাইরের অপশক্তিতে এসব হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে ঝুট ব্যবসার দ্বন্দ্বে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে শিল্প নগরীতে অসন্তোষ কাটছে না।
গার্মেন্টস খাতের চলমান অস্থিরতা নিরসনে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) নেতাদের ভূমিকা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। অনেকে বলছেন, বিজেএমইএ’র অনেক নেতাই স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর হিসাবে অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে। তারা এখন নানাভাবে গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতাকে বজায় রেখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে কি না সে বিষয়টিও সুক্ষভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। তা না হলে সরষের ভিতরে যে ভূত তারা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
গতকাল বৃহস্পতিবারও শ্রমিক অসন্তোষ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে ৮৬টি কারখানা অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। আর সাধারন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে আরও ১৩৩টি কারখানায়। চলতি মাসের শুরু থেকে পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি তুলে আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক তান্ডব চালানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানা, পরিবহণ ভাঙচুরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কতিপয় শ্রমিক নামধারী উচ্ছৃঙ্খল দূর্বৃত্তদের মারমুখী আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রমিকদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে মাস শেষে বেতন, ওভারটাইম মজুরি, উৎসব ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে নিজ পরিবারকে আর্থিক জোগান দেওয়ার বিষয়টি। কারখানা চালু থাকলে তাদের সংসার চলবে। বন্ধ হয়ে গেলে তাদের বেকার হতে হবে।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম জানান, পোশাক শিল্পে অসন্তোষের পিছনে এই শিল্পের ভিতরের কেউ খেলছে, তাদের চিহিৃত করতে হবে। তৃতীয় পক্ষের কোন ইন্দন থাকতে পারে বলে ধারনা করছেন শিল্প পুলিশের এই কর্মকর্তা। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ধ্বংশের পিছনে ভারতের ইন্ধনের আভাষ দিয়ে বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এনিয়ে কাজ করছে।
এসপি সারোয়ার আলম বলেন, আজও (বৃহস্পতিবার) ১৩৩টি কারখানায় সাধারন ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা মোতাবেক আরও ৮৬টি কারখানা অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, পোশাক শিল্প ধ্বংসের পাঁয়তারায় যারা লিপ্ত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের পাশাপাশি যৌথবাহিনী কাজ করছে। আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাসুদুর রহমান বলেন, গামের্ন্টস শিল্পে অস্তিরতার পিছনে বহিরাগতদেরও হাত রয়েছে। তারা টাকার বিনিময়ে শ্রমিক সেজে পোশাক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এছাড়াও ঝুট ব্যবসার হাতবদল নিয়েও আন্দোলনরত শ্রমিকদের উস্কে দেওয়ার অভিযোগ আছে।
শ্রমিক নেতারা মনে করেন, আন্দোলনকারী শ্রমিকরা যেসকল দাবি দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করছে তার কোন যুক্তি খুজে পাওয়া যায়নি। তবে শ্রমিকদের উস্কে দেয়ার পিছনে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের অনুসারীদের হাত রয়েছে ধারনা তাদের। পোশাক শ্রমিক মোরশেদা বেগম বলেন, বহু বছর ধরে আশুলিয়া থেকে পোশাক কারখানায় কাজ করি। কে শ্রমিক আর কে বহিরাগত তা চিনতে অসুবিধা হয় না। অল্প বয়সের ছেলেরা শ্রমিক সেজে কারখানায় হামলা ও সাধারন শ্রমিকদের উস্কে দিয়েছে। ওই শ্রমিক নামধারী দুবৃত্তদের স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের পথসভায় দেখেছিলেন তিনি। তবে বিভিন্ন কারখানার সাধারণ শ্রমিকদের কথা হলো, যারা মাঝেমধ্যেই গার্মেন্টস সেক্টরে এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়, তাদের অনেকেই গার্মেন্টস শ্রমিক নয়। এরা বেশিরভাগই বহিরাগত। শ্রমিক নামধারী দূুর্বৃত্ত।
স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আল কামরান বলেছেন, হঠাৎ করে রাজনীতির পালাবদল, ঝুট ব্যবসা দখল, শ্রমিক অসন্তোষের কারন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের পর আওয়ামীলীগ নেতাদের ঝুট ব্যবসা বিএনপি নেতাকর্মীরা নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠে। তখন স্থানীয় আওয়ামীলীগের অনুসারীরা ঝুট ব্যবসা না পেয়ে এক শ্রেনির অভাবী শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে বিশৃঙ্খলা করছে।
শিল্প মালিকরা মনে করেন, পোশাক কারখানায় স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি না হলে দেশের এই খাতে কমবে বিদেশি বিনিয়োগ, সংকটের সুযোগ নিবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো। তাই দ্রæত পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় করার দাবি করেন তারা।
গত বুধবার আশুলিয়ার নরসিংহপুরে চলমান নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা থেকে গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচাতে শ্রমিক জনতার সমাবেশে যোগ দিয়ে বিজিএমইএ এর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, কিছু উস্কানীদাতা লোকজন শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে গার্মেন্টস কারখানা গুলোতে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে, এতে মালিকদের চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। গামের্ন্টস শিল্পে যারা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীর উস্কানি দিচ্ছে তাদের খুঁজে বেরকরার অনুরোধ জানান সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে।
ঢাকা-১৯ (সাভার-আশুলিয়ার) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির সহ পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ডা. দেওয়ান সালাহউদ্দিন বাবু বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গার্মেন্টস খাতকে ধ্বংসের এক অপচেষ্টা চলছে। বিভিন্ন স্থানে পলাতক থেকে একটি চক্র এই শিল্পটিকে অস্থির করার চেষ্টা করছে। আমরা শ্রমিকদের বুঝানোর চেষ্টা করছি যাতে কোন চক্রের উস্কানিতে না পরে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের পিছনে শ্রমিক নামধারী কিছু দুবৃত্তরা কাজ করছে। এছাড়া আওয়ামীলীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ও মুরাদ জং এর অনুসারীদেরও হাত রয়েছে।
গাজীপুর থেকে মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, গাজীপুরে নিরাপত্তাজনিত কারণে কয়েকটি কারখানায় ছুটি থাকলেও গতকাল বেশির ভাগ কারখানা খোলা ছিল। উৎপাদন ছিল অব্যাহত। বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শ্রীপুর, গাজীপুর সদর ও টঙ্গী কোনাবাড়ী, কাশিমপুর এলাকায় ‘বহিরাগত’ শ্রমিকদের ‘অযৌক্তিক’ দাবিতে হামলা ও ভাঙচুর এড়াতে কয়েকটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সব কারখানায় ‘শান্তিপুর্ণ অবস্থা’ বিরাজ করছে। কারখানাগুলোতে উৎপাদন চলছে। শিল্পকারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে।
সকালে শ্রীপুরের বর্মী এলাকায় হোয়াইট হর্স ফার্মাসিটিক্যাল কারখানায় বেতন, মাতৃকালীন ছুটিসহ এবং চিকিৎসা জনিত ছুটির দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করলেও শ্রমিকরা কারখানার গেইটে বিক্ষোভ করেন। এসময় তারা ‘কথায় কথায় চাকরি নাই, চলবে না চলবে না;- এই সেøাগান দিয়ে বেক্সিমকো কারখানার মেইন গেটের সামনে বিক্ষোভ করতে থাকে। গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম মোরশেদ ইনকিলাবকে জানান, সকালে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মেইন গেটের সামনে কিছু শ্রমিক অবস্থান নেয়, তবে তারা বিক্ষোভ না করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। অপরদিকে গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর কোনাবাড়ি এলাকার বেশিরভাগ কারখানা স্বাভাবিকভাবেই চলছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন