বিজ্ঞানী নিউটন এক মজার ভুল করেছিলেন ।
তাঁর পোষা কুকুর বাচ্চা দিয়েছে। ঘর বানালেন কুকুরের। ঘরের দরজা বানালেন দু'টো। একটা ইয়া বড়, মা কুকুরের জন্য আর আরেকটা একটু ছোট, বাচ্চাদের জন্য। পরদিন দেখেন বড় দরজা দিয়ে ছোট্ট বাচ্চা বের হচ্ছে আর ছোটটা দিয়ে মা।
ভুল করেছিলেন বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসও। রাজা তাঁকে নির্দেশ দিলেন নতুন বানানো মুকুটের সোনা আসল নাকি নকল, সেটা গবেষণা করে বের করতে। চিন্তায় পড়লেন আর্কিমিডিস। কোনো সমস্যাকেই তিনি সমস্যা ভাবেননি। গোসল করতে গিয়ে বাথটাব থেকেই বের করে ফেললেন মুকুটের সমাধান। খুশিতে ন্যাংটো হয়েই রাজপ্রাসাদের দিকে দিলেন দৌড়। রাজপথ দিয়ে ন্যাংটো হয়ে দৌড়ে চিৎকার করে করে বলতে লাগলেন- ইউরেকা! ইউরেকা!! যার অর্থ- পেয়েছি! পেয়েছি!! রাজ মুকুটের সোনার চিন্তায় ফিজিক্সের বিশাল আবিস্কার করেছিলেন আর্কিমিডিস। তবে জনসমক্ষে তাঁর ন্যাংটো হয়ে দৌড়ানো ঠিক হয়নি।
বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর ওপর জীবনভর শাস্তিটা নেমে আসে যখন তিনি বলেছিলেন- 'সূর্য স্থির, পৃথিবী তার চারদিকে ঘোরে।' এটা মেনে নিতে পারেননি তখনকার চার্চের ধর্মগুরুরা। শাস্তি পান বিজ্ঞানী জীবনভর। গ্যালিলিও তাত্ত্বিকভাবে সম্পূর্ণ ঠিক না বললেও তার সময়ের জন্য তিনি সঠিক ছিলেন। আসলে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে ঠিকই, কিন্তু সূর্য স্থির না, সেটাও চলমান। এটা পড়েছি পবিত্র কোরআনে।
অ্যামেরিকার নাসাও একই কথা বলেছে। আর গ্যালিলিওকে শাস্তি দিয়ে চার্চ যা করেছিলো, তা ছিলো পুরোপুরি বাকশালী কায়দার ফ্যাসিজম।
ভুল সব বিজ্ঞানীদের হয়, হয়েছে। বিজ্ঞানী স্যার ইউনূসেরও হতে পারে। সম্প্রতি জাতিসংঘে সফল সফরে আমাদের বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দু'টো কথা সবার নজর কেড়েছে। তিনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সামনে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি মাহফুজকে পরিচয় করিয়ে দেন বিপ্লবের 'মাস্টারমাইন্ড' হিসেবে। আর এরসাথে যোগ করেন- 'বিপ্লবটা ছিলো নিখুঁত ও বিস্তৃতভাবে সুপরিকল্পিত।' সাথে সাথে বাংলাদেশে সদ্য পতিত স্বৈরাচারের ওত পেতে থাকা দোসররা কথাগুলো লুফে নেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলে তোলপাড়।
তাহলে ইউনূস স্যার কি কিছু ভুল বলেছিলেন? না, স্যার ভুল বলেননি মোটেও। কিন্তু সামান্য ভুল করেছেন। কেনো? বলছি।
পশ্চিম বা ইউরোপ বিগত দুই দশক ভুগেছে ইসলামোফোবিয়ায়। এখন তারা সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসার পথে আছে। পাশ্চাত্যে এখনো 'মাস্টারমাইন্ড' কথাটা আল কায়েদা'র বিন লাদেনের নামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশেও।
প্রিয় ইউনূস স্যার, আপনাকে এই শব্দটাই বলতে হলো? আপনি কি বলতে পারতেন না 'মেইন ডিজাইনার' বা 'ইনিভিজিবল আর্কিটেক্ট' জাতীয় কিছু ? আমি ইংরেজিতে তেমন ভালো না। আপনিই ভালো বুঝবেন। দ্বিতীয় কথায় আসি। ‘হঠাৎ করেই কোনোকিছু হয়নি, এটা ছিলো বিস্তৃত নিখুঁত ও সুপরিকল্পিত’- কথাটায় পশ্চিমারা চমকে উঠেনি তো ? তাদের চোখে তো নাইন ইলেভেনও ‘হঠাৎ করেই কোনোকিছু না, সেটা ছিলো বিস্তৃত নিখুঁত ও সুপরিকল্পিত’। তার উপর স্যার আপনি যে নারী সমন্বয়ককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সে পরে গেছে হিজাব ও বোরখা। পশ্চিমারা আবার অন্যকিছু ভাববে না তো স্যার ? একটু খেয়াল রাখবেন। আপনিই কিন্তু এখন এদের নেতা স্যার । এমনিতেই তো বিগত সরকার নিজ স্বার্থে জঙ্গি-টঙ্গি সব বলে বাইরে দেশের ভাবমূর্তির বারোটা বাজিয়ে রেখেছে।
স্যার, আপনাকে বলছি । বাংলাদেশে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন চলেছে ১৫ বছর ধরে। ২০১২- ২০১৩ সালের হাসিনাবিরোধী আন্দোলন যারা দেখেনি, তারা আন্দোলন কী জানেই না। সেটা আপনি জানেন। পুরো বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিলো অচল। যদি ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ না করতো, সেই বছরই নির্বাচনে বিদায় নিতে হতো ফ্যাসিস্ট সরকারকে । নিতে হতোই। কিন্তু দেশে হলো ফলস নির্বাচনের ফলস সরকার।
এরপর শুরু হলো সেই ভয়াবহ গুম-খুনের উৎসব। হাজারে হাজারে খুন-গুম। লাখে লাখে মামলা, গ্রেপ্তার। শুরু হলো মেগা প্রজেক্টের নামে লক্ষ কোটি টাকা লুটতরাজ। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে বিএনপি- জামায়াত- জঙ্গি ট্যাগ লাগানো হতো। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে স্কুল শিশুদেরও জামায়াত শিবির বলে হেলমেট বাহিনী দিয়ে শায়েস্তা করা হলো। লুটতরাজের টাকায় পদ্মা সেতু বানিয়ে সেখান থেকে বেগম খালেদা জিয়া'কে টুস করে পানিতে ফেলে দেয়া আর আপনাকে পদ্মার পানিতে চুবুনি দেয়ার মতো অসভ্য কথা শুনতে হলো জাতির।
তারপর ? তারপর ছাত্র-জনতা-গৃহিণী-শিশু সবাই এক ভীতিকর রাজ্যে বাস করতে লাগলো। সেখান থেকে নিজেকে ও দেশকে উদ্ধারে সবাই যার যার মতো বুদ্ধি আঁটতে লাগলো। ছাত্রছাত্রীরা চমৎকার এক বুদ্ধি এঁটে অরাজনৈতিকভাবে জনতার বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গেলো আর সবাই সম্মিলিতভাবে হটিয়ে দিলো স্বৈরাচার।
কিন্তু স্যার, আপনি এই বিপ্লবকে বারবার 'ছাত্রদের বিপ্লব' বলে সাধারণ জনতার সাথে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে অনেকে অভিযোগ করছেন। এতে ছাত্র-ছাত্রীরাও নাকি বিব্রত হচ্ছে। এদেশে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন সবগুলোর অগ্রভাগে ছিলো ছাত্র-ছাত্রীরাই। কই তখন তো ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদাভাবে হাইলাইট করা হয়নি? তারা সেটা চায়ওনি। আপনাকে এসব বুদ্ধি কে দেয় স্যার? আমি তো জানি আপনি নিজেই একজন মাস্টারমাইন্ড। ক্ষুদ্র ঋণের জনক।
প্রিয় ইউনূস স্যার, আপনাকে সম্মান করি একজন অসম্ভব প্রতিভাধর বিজ্ঞানী হিসেবে। আপনি আমাদের গর্ব। আপনি বিশ্বেরও গর্ব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আপনি এখন ১৮ কোটি মানুষের অভিভাবকও। আপনাকে এখন পাবলিকলি যা ইচ্ছা তা বললে বা করলে চলবে না। আপনি বিজ্ঞানী হলেও চাইলেই এখন নিউটনের মতো একই ঘরে ২টা কুকুরের জন্য আলাদা আলাদা দরজা বানাতে পারবেন না। চাইলেই পারবেন না আর্কিমিডিসের মতো বাথটাব থেকে উঠেই সো-জা বিজয় সরণী দিয়ে দৌড় দিতে।
আপনার ওপর গণতন্ত্রকামী মানুষ চেয়ে আছে স্যার। আপনি দেশকে উপযুক্ত সংস্কার করে গণতন্ত্রের মহাসাগরে দেশকে ভাসিয়ে তুলুন । তুলে দিন নির্বাচিত দক্ষ নাবিকের হাতে। আপনি তা পারবেন। এবং আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি- বাংলাদেশের যে কয়জন এই কাজটা পারবে, তাদের সেই ক্লাসে আপনার রোল নম্বর- এক । জনতা আপনার পাশে আছে। আপনি সবাইকে সাথে নিয়ে কাজটা করে দেখিয়ে দিন।
মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
শায়ের খান
লেখক : নাট্যকার - ফিল্মমেকার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন