ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
বাংলাদেশের আইনাঙ্গন বা বিচারাঙ্গনের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির ইন্তেকালে শ্রদ্ধা জানিয়ে কোর্ট না বসার রেওয়াজ উচ্চ আদালতে চর্চা করা হয়। যেমন, ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের প্রবীণতম আইনজীবী বিচারপতি টিএইচ খানের মৃত্যুতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঠিক অনুরুপভাবে ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসানের মৃত্যুতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকাজ বন্ধ থাকে। অপরদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঠিক একইভাবে সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এডভোকেট মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে বিচারকাজ পরিচালিত হবে না বলে আপিল বিভাগের ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চে তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ঘোষণা করেন।
উপরে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো। এভাবে আইনাঙ্গন বা বিচারাঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের (যেমন: ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, এডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন আহমদ প্রমুখ) ইন্তেকালে তাঁদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কোর্ট না বসার রেওয়াজ চলে আসছে। এই রেওয়াজ কোথা থেকে এসেছে জানি না। তবে উচ্চ আদালতে এই প্রথা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। সম্মান দেখানোর কারণ বোধগম্য। যাদের মৃত্যুতে এ ধরনের সম্মান দেখানো হয় তাঁরা সবাই আমাদের আইন ও বিচারাঙ্গনের স্টার (তারকা) ও সূর্যসন্তান। আইনের জগতে তাদের কন্ট্রিবিউশন অপরিসীম। উনাদের সবাই আইনাঙ্গন ও বিচারাঙ্গন তো বটেই, জাতীয়ভাবেও অত্যন্ত সুপরিচিত। কারো কারো পরিচিতি ও সুনামের ব্যাপ্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সুতরাং তাঁরা তাঁদের মৃত্যুতে সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য ও হকদার।
তবে হঠাৎ তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এভাবে কোর্ট না বসলে বিচারপ্রার্থীরা যে কত অনিশ্চয়তা ও ভোগান্তির শিকার হন তা সহজেই অনুমেয়। উচ্চ আদালতেই মামলার জট ত্রিশ লাখের উপরে। এই অবস্থায় মাসের পর মাস, এমন কী বছরের পর বছর (কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্ধযুগ পার হয়ে যায়) অপেক্ষার পর উচ্চ আদালতে মামলার তারিখ পড়ে। এমনকি আইনজীবীর ফিসও দেয়া হয় মামলার শুনানির তারিখের আগে। আইনজীবী যথারীতি কোর্টে উপস্থিতও হোন। এমতাবস্তায় হঠাৎ করে মামলার তারিখের দিন কোর্ট না বসলে বিচারপ্রার্থীরা কতো যে ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন তা কেবল ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থীরাই বুঝেন।
ধরুন দেশের সর্বশেষ প্রান্ত পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার অজপাড়া গাঁয়ের দিনে আনে দিনে খায় এমন একজন দিনমজুরের মামলার শুনানি হাইকোর্টে হওয়ার কথা অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চল সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের রিমোট ভিলেজের একজন দরিদ্র ব্যক্তির আপিল শুনানি হওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টে অথবা ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি সিলেটের তামাবিল থেকে সুপ্রিম কোর্টে এসেছেন বিচারের আশায় অসহায় একজন বিচারপ্রার্থী। তাদের মামলার শুনানির জন্য তাদের অনেকটা শেষ সম্বল বিক্রি করে ভাড়া ও মামলার খরচ যোগান দিয়ে উচ্চ আদালতে শুনানির জন্য রাজধানী ঢাকায় এসে হোটেলে রাত্রিযাপন করে সকালে সুপ্রিম কোর্টে এসে শুনেন কোর্ট আজ বসবে না অথবা সর্বোচ্চ আদালতে এসে জানলেন তার শুনানি আজ হবে না। এমন অবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিচারপ্রার্থীদের মনের অবস্থা যে কী হতে পারে তা কি আমরা ভাবতে পারি? তাদের অন্তরের হাহাকার কি আমরা হৃদয়াঙ্গম করতে পারি? আমার বিশ্বাস বিচারপ্রার্থীদের এই ভোগান্তির অবস্থায় মরহুম বা প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আত্মাও শান্তি পাবে না।
বিগত আড়াই দশক ধরে বৃটেনের আদালতে আইন প্র্যাকটিস করছি, কিন্তু এমন রেওয়াজ বা প্রথা কোনো দিন দেখিনি। এখানে কি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ইন্তেকালের পর সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখানো হয় না? অবশ্যই হয়। তবে এভাবে কোর্ট না বসে বা না বসার সিদ্ধান্ত নিয়ে নয়। Lord Denning বৃটেন ও Common Law Jurisdictions-এর গত শতাব্দির সবচেয়ে প্রভাবশালী বিচারপতি ছিলেন। আর Lord Bingham চলতি শতাব্দির এ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী বিচারপতি। উনারাসহ বৃটেনের অনেক প্রখ্যাত বিচারপতি, বিশিষ্ট আইনজীবী ও প্রতিথযশা আইনবিদরা প্রয়াত হয়েছেন। অনেক সাবেক এটর্নি জেনারেল ও বৃটিশ বার কাউন্সিলের চেয়ার এবং Law Society’র প্রেসিডেন্ট পরলোক গমন করেছেন। তাঁদের মৃত্যুতে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোর্ট না বসে সম্মান জানানোর প্রথা বা রেওয়াজ কখনও দেখিনি।
বৃটেনে প্রখ্যাত আইনজীবী, আইনবিদ ও বিচারপতিদের মৃত্যুর পর সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হয় বিভিন্নভাবে। আইনের ডিগ্রির বইগুলোতে তাঁদের জীবনী ও আইন বিষয়ে তাঁদের কন্ট্রিবিউশন সন্নিবেশ করা হয়। ফলে আইনের ডিগ্রির ছাত্র/ছাত্রীরা প্রথম বর্ষের English Legal System পড়ার সময় ঐসব বিদগ্ধ ব্যক্তিদের জীবনী ও অবদানের কথা পড়ে নেন। প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে বাৎসরিক ও বিভিন্ন উপলক্ষে লেকচারের আয়োজন করা হয়। যেমন ২০২২ সালের ২২ নভেম্বরে লিংকন্স ইনে “ALFRED THOMPSON DENNING: A 20TH CENTURY ENGLISH LEGAL ICON RE-EXAMINED” শীর্ষক লেকচারের আয়োজন করা হয়। তাঁদের নামে বিভিন্ন সেন্টার বা সোসাইটি গঠন করা হয়। যেমন Lord Bingham -এর নামে Bingham Centre for the Rule of Law গঠন করা হয়েছে। Honourable Society of Lincoln’s Inn, Grays Inn, Inner Temple ও Middle Temple এবং Law Society সহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে তাদের জীবন, কর্ম ও কন্ট্রিবিউশনের উপর সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। যেমন: 2009 DENNING LECTURE, INNER TEMPLE, 23 NOVEMBER 2009. এছাড়া নামিদামি ব্যক্তিরা দেশের লীডিং নিউজ পেপারে ও প্রফেশনাল ম্যাগাজিনে প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর সনির্বন্ধ কলাম ও আর্টিকেল লিখে থাকেন। যেমন: Maev Kennedy নামক নামকরা কলামিস্ট বৃটেনের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক The Guardian -এ ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে “Tribute: Lord Bingham: the greatest judge of our time” শীর্ষক দীর্ঘ কলাম লিখেন। Joshua Rosenberg (Hon. KC) নামক প্রতিথযশা লেখক ও আইন বিশ্লেষক ২০০৯ সালের ২রা জুলাইয়ে বৃটেনের প্রভাবশালী আইনি জার্নাল Law Society Gazette - এ “A tribute: Lord Bingham’s passion for justice and history” শীর্ষক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন।
অবশ্যই আমাদের আইনাঙ্গন বা বিচারাঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান জানানো উচিৎ। আমি আমাদের তারকাখচিত ব্যক্তিত্বদের সর্বোচ্চ সম্মান জানানোর পক্ষে। তবে বিচারপ্রার্থীদের দুর্গতি হয় এমনভাবে নয় বরং অন্যভাবে বা বহুভাবে। আমাদের আইনের জগতের সূর্যসন্তানদের যেসব উপায় ও পন্থায় যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো যেতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সুপ্রিম কোর্টের পতাকা অর্ধনিমিত রাখা, ২/১ দিনের শোক দিবস পালন, তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর দিন কোর্ট আওয়ারের পর স্বরণসভার আয়োজন, স্ব স্ব ধর্ম মতে উপাসনার আয়োজন, তাঁদের জীবনী পাঠ্যপুস্তক বিশেষ করে আইনের ডিগ্রিতে পঠিত আবশ্যকীয় বইগুলোতে সন্নিবেশিত করা, বাৎসরিকভাবে তাঁদের নামে সিরিজ লেকচারের আয়োজন, তাঁদের নামে সেন্টার বা সোসাইটি প্রতিষ্ঠা, মৃত্যুর পর তাঁদের কন্ট্রিবিউশনের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা প্রদান, গরীব ও মেধাবী তরুণ আইনের ছাত্রের জন্য তাঁদের নামে বৃত্তি চালু, জাতীয় পত্রিকা ও জার্নালে তাঁদের কন্ট্রিবিউশনের উপর নিবন্ধ, আইন ও বিচারাঙ্গনের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদক ইত্যাদি। এই উপায় ও পন্থাগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্নভাবে তাঁদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো যেতে পারে।
আইনাঙ্গন বা বিচারাঙ্গনের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির ইন্তেকালে শ্রদ্ধা জানিয়ে কোর্ট না বসা নিছকই একটি রেওয়াজ বা প্রথা। এটি সংবিধানের অংশ নয়, নয় CrPC (Criminal Procedure Code) বা CPC (Civil Procedure Code)’র অংশ। তাই জনস্বার্থে বিশেষ করে রিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে এই রেওয়াজ বা প্রথা সংশোধন, সংযোজন বা আধুনিকায়ন হতে পারে। এ ব্যাপারে সবিনয়ে সর্বোচ্চ আদালত, বিশেষ করে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন