ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের নামে চাঁদাবাজি, আসন-বাণিজ্য, ছাত্রীদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানোসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর পত্রিকার মাধ্যমে আমার নজরে এসেছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করে আসছিল, এখন সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘাতে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে নৈরাজ্য ও ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ।
এটা শুধু ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের নেতাদের বিষয় নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিস্থিতি চলছে।
আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর অসুস্থতা ও অনিয়ম চলছে। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমাদের এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, শুনতে হচ্ছে। দুঃখজনক এ পরিস্থিতি আমাদের বিচলিত করছে, শঙ্কিত করছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের সন্তানদের, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কারা তাদের স্বার্থে এভাবে বিপথে পরিচালিত করছে? অল্প কিছু শিক্ষার্থী তাদের ক্ষমতার স্বার্থে এ ধরনের অনুচিত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তারাই তো ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করবে, সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। ভেবে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না যে যারা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই এ রকম অনিরাপদ করে তুলেছে, তাদের হাতে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ কতটা নিরাপদ থাকবে?
আরও শঙ্কার বিষয় হলো, আমাদের দেখতে হচ্ছে যে দলই যখন ক্ষমতায় থাকে, সে দলই ছাত্ররাজনীতিকে তাদের ক্ষমতার স্বার্থে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও শক্তিশালী এই জনগোষ্ঠীর সামনে সুস্থ রাজনীতির চর্চা কিংবা নেতৃত্ব বিকাশের পথের দিশা রাখা হয় না। বাধাহীনভাবে অন্যায়, অবৈধ সুযোগ পেতে পেতে ছাত্রনেতারা কীভাবে ভিন্ন পথে অনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করা যাবে, সেই চিন্তায় মত্ত থাকে।
এ পরিস্থিতির জন্য ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেতৃত্ব একা দায়ী নয়। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগকে পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, সেই ছাত্রলীগকে পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব—সবারই এখানে দায়বদ্ধতা আছে। কেউই তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেনি। বরং সবাই এই জবাবদিহিহীন অনাচারকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কেউই আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে শঙ্কা বোধ করছে না।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন, চাঁদাবাজি, সিট–বাণিজ্য, মাস্তানিসহ নানা ধরনের অন্যায় ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে তারা পার পেয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না, করলে তাদেরই পাল্টা নিগৃহীত হতে হয়।
ছাত্র নেতৃত্বের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন ঘটছে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশ্রয়ে। এর আগে বিএনপি যখন সরকারে ছিল, তখন তারা তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এখনো সেই আমলের ছাত্রদল নেতাদের অত্যাচারের কাহিনি মনে হলে ভীতসন্ত্রস্ত হতে হয়। এসব কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা শুধু নিজের সাহস বা শক্তিতে করে না। তাদের পেছনে অবধারিতভাবে সমর্থন জোগায় তাদের মাথার ওপর অবস্থান নিয়ে যারা তাদেরকে ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করে, তারা।
আমাদের অভিজ্ঞতায় জেনেছি, তাদের মধ্যে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের নেতা থেকে প্রতিটি স্তরের সুবিধাভোগীরা। অসুস্থ পেশিশক্তি আর অর্থের দাপটের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চায় তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সামাজিক শক্তিগুলোকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে। ফলে ছাত্রনেতারা তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কারও কাছে জবাবদিহি করার কথা ভাবে না। তাই আমাদের একটি ঐতিহ্যবাহী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীদের এ হেন বেপরোয়া আচরণ সহ্য করে নিতে হয়। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের নেতারা নানা ধরনের অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পত্রিকা ও টেলিভিশনে উঠে এসেছে। কিন্তু সেসব অভিযোগ তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবারে কয়েকজনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও নৈরাজ্য দেখতে পাচ্ছি।
কোনো তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে? কোনো ঘটনা ঘটার পর সেটা সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। সেটাই নিয়ম। পত্রিকান্তরে যে খবর এসেছে, সে অনুযায়ী কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, কোনো বিচারিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় না নিয়েই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কয়েকজনকে বহিষ্কার করল। এর মাধ্যমে সত্যিকার অপরাধী চিহ্নিত হলো কি না, বিচার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হলো কি না, তা বোঝা গেল না। এ সিদ্ধান্ত যেভাবে নেওয়া হয়েছে, সেটাও সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতাদের যথেচ্ছাচারের স্বাক্ষর রাখে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট কোনো ভাষ্য আমরা পায়নি। শিক্ষক হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে তাদের তো দায়িত্ব আছে। তারা কেন দিনের পর দিন এ রকম অনিয়ম, নৈরাজ্য চলতে দিল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেসব অভিযোগ করেছে, তার প্রতিকার তারা কেন করেনি? কিসের ভয়ে, কোন চাপে তারা এ ধরনের অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করছে। কর্তৃপক্ষ হিসেবে ইডেন কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ।
আবারও বলছি, এ পরিস্থিতির জন্য ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেতৃত্ব একা দায়ী নয়। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগকে পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, সেই ছাত্রলীগকে পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব—সবারই এখানে দায়বদ্ধতা আছে। কেউই তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেনি। বরং সবাই এই জবাবদিহিহীন অনাচারকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কেউই আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে শঙ্কা বোধ করছে না।
১৩ বছর আগে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা ছাত্রলীগকে সঠিক পথে পরিচালনার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউই তাতে কর্ণপাত করেনি। সেটা করলে আজকে আমাদের এই লজ্জাজনক ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো না।
আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে কেউই সেই আদর্শের চর্চা করছে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করা আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগের মধ্যেই যদি এ ধরনের অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডের চর্চা হয়, তাহলে মানুষ কোন আদর্শের দিকে আকর্ষিত হবে?
সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি একটা ন্যক্কারজনক জায়গায় চলে গেছে। ইডেন কলেজে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, নারীবিদ্বেষী শক্তিগুলোকে নারীশিক্ষা, নারীর অগ্রযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেওয়া হলো।
এর আগেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়ায় নারীবিদ্বেষী শক্তি মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে নিজেদের দাবি করে কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে তারা?
মুক্তিযুদ্ধের ও বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে এই ন্যক্কারজনক আচরণ করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তারা আমাদের পবিত্রতম ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার নিয়ে জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা করছে। তাদেরই কারণে সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা এখন একটি আদর্শহীন বিদিশার মধ্যে পড়েছি। আমাদের সন্তানদের, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই এ থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা জরুরি।
সুলতানা কামাল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; মানবাধিকারকর্মী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন