মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটো ধরনের আরব প্রতিরক্ষা জোট গঠনের বিষয় হঠাৎ করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। জর্দানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ গত শুক্রবার বলেছেন, তিনি পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর মতো মধ্যপ্রাচ্যে একটি সামরিক জোটকে সমর্থন করেন। সিএনবিসির সাথে কথা বলার সময়, বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন, এ জাতীয় জোটের সনদ খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার। আমি প্রথম ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হবো যারা মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটোকে সমর্থন করবে, তবে বাকি বিশ্বের সাথে সংযোগ এবং আমরা কিভাবে এর সাথে ফিট করি তা খুব স্পষ্ট হতে হবে।
আবদুল্লাহ এই জোটের কথা এমন এক সময় বলেছেন যে সময়টিতে মার্কিন আইন প্রণেতারা সিনেট ও কংগ্রেসে ইরানের মোকাবেলার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিমান প্রতিরক্ষাকে একীভূত করার পরিকল্পনার আহ্বান সম্বলিত একটি বিল উত্থাপন করেছেন। আর ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলেছেন, আরব দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিদ্যমান রয়েছে, যার কারণে ইতোমধ্যেই এই অঞ্চলে ইরানের একাধিক হামলা ব্যর্থ হয়েছে।
জর্দানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রতিরক্ষা জোট সমর্থনের ধারণাটি নতুন করে উঠে আসার এ সময়ে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স জর্দান, মিসর, তুরস্ক সফরে বের হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শিগগিরই সৌদি আরব, পশ্চিম তীর ও ইসরাইলে যাত্রাবিরতি করে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রথম সফর করবেন। আর মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রতিরক্ষা ফ্রন্ট গঠন বাইডেনের অ্যাজেন্ডায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
আরব ন্যাটোর বিষয়টি প্রথম উঠে আসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার বিশেষ দূত কাম জামাতা জারেদ কুশনার যখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আবরাহাম চুক্তির বিস্তারের ব্যাপারে দৌড়ঝাঁপ করে যাচ্ছিলেন, তখন। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তখন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আর কুশনারের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে খ্যাত মুহাম্মদ বিন জায়েদ ও মুহাম্মদ বিন সালমান মধ্যপ্রাচ্যের দাপুটে নেতা। দুজনের প্রথমজন এরই মধ্যে তার দেশের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়ে গেছেন।
অপরজনের বাদশাহ হওয়ার পথে একের পর এক বাধা অপসারিত হচ্ছে। অন্য দিকে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়া ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সামনে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিমান প্রতিরক্ষা জোট গঠন হয়েছে যার অন্যতম সদস্য হলো ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর ‘আইটুইউটু’ নামের আরেকটি জোটে এ তিন সদস্যের সাথে রয়েছে ভারত। এই সব জোটের পর ‘আরব ন্যাটো’ গঠনের স্থগিত বিষয় হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে ওঠার পেছনে যে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
কেমন হতে পারে এই জোট
বাদশাহ আবদুল্লাহ ন্যাটোর মতো যে প্রতিরক্ষা জোটের সমর্থনকারী প্রথম ব্যক্তি হবেন বলে উল্লেখ করেছেন সেটি কেবল আরব দেশগুলোর কোনো সামরিক জোট হবে নাকি মুসলিম সামরিক বাহিনী গঠনের যে উদ্যোগ একবার সৌদি আরবের নেতৃত্বে নেয়া হয়েছিল তেমন কোনো জোট হবে এ বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। আবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান শক্তিমান মুসলিম দেশগুলোর একটি ব্লক করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার সাথে এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা সেটিও স্পষ্ট নয়।
তবে বাস্তবতা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নতুন যুদ্ধ ফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় এমন দেশগুলোর আলাদা আলাদা অগ্রাধিকার রয়েছে। ঐক্য তৈরির পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব তাদের বিভক্ত করেছে। কাতার ও সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ উপসাগরীয় অঞ্চলে এখনো কম বেশি অব্যাহত রয়েছে। কাতার কৌশলগত ও কূটনৈতিক কারণে ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নত করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন কাতার অবরোধে জড়িত দু’টি দেশ। তারা কাতারের সাথে উষ্ণ সম্পর্কের জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি যা ইঙ্গিত করে যে, পাঁচটি আরব দেশ ও কাতারের মধ্যে বিরোধ এই অঞ্চলে ইরানের কথিত প্রভাবের চেয়েও গভীর।
ইরান যদিও সৌদি আরবের চিরশত্রু এবং সৌদির সামরিক পদক্ষেপগুলোর বেশির ভাগই নেয়া হয় এই অঞ্চলে তেহরানের প্রভাব মোকাবেলায়; তবে মিসর, জর্দান এবং বেশির ভাগ অন্য দেশের ক্ষেত্রে এটি ঘটে না। ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিত্তিতে তথাকথিত আরব ন্যাটো জোট গঠন করা হলে এই অঞ্চলে সৌদি লক্ষ্য পূরণ হবে কিন্তু বাকি সদস্যদের জন্য এটি অন্য কিছু করবে না এই কারণে যে, তাদের বেশির ভাগ বৈদেশিক নীতি ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় না। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের বছর ২০১৩ সাল থেকে মিসর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব অপসারণকে তার অগ্রাধিকারে পরিণত করেছে। আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি ইরান নয় বরং মুসলিম ব্রাদারহুডকে বড় হুমকি মনে করেন।
মিসর সমাচার
মিসর এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার দেশ। কিন্তু আজ মিসর এমন একটি দেশে পরিণত হয়েছে যার হাত স্থায়ীভাবে ভিক্ষার বাটি নিয়ে প্রসারিত। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স কায়রোতে যাওয়ার আগে দুই দেশের মধ্যে তিক্ত বাক্য বিনিময় হয়েছিল।
মিসরীয় সাংবাদিক ইমাদ আল-দিন আদিব লিখেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিদ্যুৎ, খাদ্যশস্য ও মৌলিক খাদ্যপণ্যের ব্যয় বৃদ্ধি মিসরীয় বাজেটে ২৫ বিলিয়ন ডলার বাড়তি যোগ করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গম আমদানিকারক হিসেবে বছরে ১২ মিলিয়ন টন আমদানি করে মিসর। আর গমের দাম ৮০ শতাংশ বেড়েছে। যদি আগামী বছরের প্রথম দিকে অতিরিক্ত ২৫ বিলিয়ন ডলার না পায় তবে মিসর ২০১১ সালের আরব বসন্তের চেয়েও খারাপ নাগরিক অস্থিরতার মুখোমুখি হতে পারে।
মোহাম্মদ মুরসির সরকারের অধীনে মিসরের প্রাক্তন বিনিয়োগমন্ত্রী, ইয়াহিয়া হামেদ যখন তিন বছর আগে ফরেন পলিসির এক নিবন্ধে সতর্ক করেছিলেন যে, মিসরের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে; তখন মিসরীয় সরকার এর ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। এখন সরকারের সবাই একই কথা বলছে। সিসির নিজের ভাষায়, মিসর উপসাগরীয় অর্থের ৫০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করেছে আর এখন দেশটি একটি ‘গণদুর্ভিক্ষের সম্মুখীন’।
সৌদিরা কেন আক্ষরিক অর্থে মিসরীয় সেনাবাহিনীর পকেটে অর্থ ঢালবে বা সিসির নিজস্ব ভ্যানিটি প্রকল্প সুয়েজ খাল প্রশস্ত করা বা একটি নতুন রাজধানী স্থাপনে টাকা দেবে এবং কেন সত্যিই সৌদি আরব উদ্ধার করতে হবে মিসরকে সেই প্রশ্ন রিয়াদে উঠছে। বিশেষত যখন সিসি এক দিকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সতর্ক করছেন, অন্য দিকে তিনি ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইইউ দেশগুলো থেকে অস্ত্র কেনার জন্য ১২.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন। মিসর এই সময়ে ২৪টি রাফালে জঙ্গি বিমান, একটি নৌ ফ্রিগেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে ফরাসি অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক হয়ে ওঠে। গত বছর মিসর আরো ৩০টি জেটের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। খাদ্যের দাম বৃদ্ধি মিসরকে অস্ত্র কিনতে বাধা দেয়নি। মিসর তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের ২৪টি টাইফুন যোদ্ধাদের জন্য ইতালিকে এখন ৫০০ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম দিতে চলেছে।
কতটা সম্ভব এই জোট গঠন?
বর্তমানে বিশ্বে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিবর্তন এবং প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎ জোটের সাথে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সামরিক সিদ্ধান্ত নেয়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রভাব, মস্কোর বিরুদ্ধে একীভূত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং ইরানের সাথে একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা অবশ্যই এই অঞ্চলে আসন্ন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের পরিধি এবং গুরুতর অবস্থাকে ঘনীভূত করবে।
প্রশ্ন হলো, সামরিক জোট গঠন কি এর সমাধান হবে এবং যদি হয়, তাহলে কি এমন একটি শক্তিশালী জোট গঠন করা সম্ভব হবে? মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা জোটের ধারণা নতুন নয়। এটা ১৯৫০ সাল থেকে মাঝে মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছে। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি বাগদাদ চুক্তি হয়েছিল তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি একমাত্র আরব সদস্য ইরাককে নিয়ে। এর পর থেকে প্রায় দুই দশক ধরে এটি সক্রিয় ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন নানা ঘটনার কল্পনা করা হয়। যদি ইরান এই অঞ্চলে আরো সামরিক আক্রমণের জন্য একটি স্প্রিংবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কিছু ইরাকি বা সিরিয়ার অঞ্চল আক্রমণ এবং দখল করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে কী হবে? যদি তুরস্ক উত্তর ইরাকের কিছু এলাকা দখল করে নেয় অথবা ইয়েমেনে শান্তিপূর্ণ সমাধান যদি না হয় তাহলে কী হবে? যদি ইরানি শাসনের সাথে যুক্ত একটি ইরাকি সরকার আবার কুয়েত আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয় তবে কী দাঁড়াবে? যদি হাসান নাসরুল্লাহ লেবানন-ইসরাইল সীমান্তে একটি ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা স্থাপন করেন তার প্রতিক্রিয়া কী হবে? আর রাশিয়া যদি উত্তর আফ্রিকায় হাত বাড়িয়ে দেয় তখন কী হবে?
এসব নানা জল্পনার মধ্যে বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য সময় এসেছে শুধু নিজেদের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা অর্জন করার এবং তাদের পথে আসা যেকোনো হুমকিকে প্রতিরোধ করার জন্য যৌথ সক্ষমতা গড়ে তোলার। আর যৌথ প্রতিরক্ষা বলয় গড়ার জন্য এই যুক্তি সামনে এসেছে।
যতদূর জানা যায়, আগের কোনো জোটের মতো হবে না এই সামরিক জোট। আর এটি ন্যাটোর কোনো সহযোগী সামরিক জোটও হবে না, যেটি কেবলই আমেরিকা ও তার মিত্রদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করবে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষকের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, নতুন এই সামরিক জোট কেবল আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সীমিত থাকবে না। এটি আরবের বাইরে পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এর সদস্য হতে পারে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো আর সেই সাথে মিসর, তুরস্ক ও পাকিস্তান। সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে বাংলাদেশও সদস্য ছিল। জাকার্তা, কুয়ালালামপুর বা ঢাকা চাইলে নতুন এই জোটেরও সদস্য হতে পারে। তবে এই সামরিক জোটের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই ইসরাইলের। ইরান ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এর সদস্য হবে না।
যতদূর জানা জানা যায়, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক নিরাপত্তা বিধানের একটি ব্লক হিসেবে এটি কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্র ইসরাইল অথবা রাশিয়া-চীন বা ইরানের সাথে সঙ্ঘাতে জড়ানোর উদ্দেশ্য এর থাকবে না। তবে এর সদস্য দেশগুলোর কোনো একটি আক্রান্ত হলে যৌথভাবে সবাই সাড়া দেবে ন্যাটোর মতো। ন্যাটো সামরিক জোটের পাঁচ ধারার মতো কোনো অবয়বে বিধান থাকবে এতে যার আওতায় কোনো একটি সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর মতো অন্য সব দেশ তাতে ভূমিকা রাখবে। এই বিধানের কারণে সামরিক জোটের সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে।
এ ধরনের কোনো সামরিক ব্লক গঠন অবশ্য সহজ কোনো কাজ নয়। এ অঞ্চলে এক দিকে রয়েছে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের বিশেষ প্রভাব। আর অন্য দিকে রাশিয়ার সরাসরি সামরিক উপস্থিতিও রয়েছে এ অঞ্চলে। চীনের রয়েছে ব্যাপক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক। ফলে এক ধরনের বোঝাপড়া ছাড়া কোনো সামরিক জোট গঠন এই অঞ্চলে করা কঠিন। তবে যেসব দেশকে নিয়ে এই জোট গঠনের কথা বলা হচ্ছে সেসবের কোনো দেশই রুশ-চীন বলয়ের নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুই দেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তারা সৃষ্টি করেছে।
এ অবস্থায় সামরিক জোট গঠন এখন একেবারে অসম্ভব কোনো বিষয় সম্ভবত হবে না। আর যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব সমীকরণের কারণে এই জোটে বাধা হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর ইরান চাইলেই এ জোটটিকে বাধা দেয়ার অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হয় না।
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির নিকটবর্তী পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্রের ডেভিড ডেস রোচেসের মতে, একটি আরব ন্যাটো বা এমনকি একটি উপসাগরীয় ন্যাটোর ধারণারও তিনটি সমস্যা রয়েছে, যা এ ধরনের জোট গঠনকে কঠিন করে তুলবে। এই অঞ্চলে মিসরের জনসংখ্যা বরাবরই এত বড় যে, এটি যেকোনো জোট গঠনে প্রাধান্য পাবে। সৌদি আরব জিসিসির অভ্যন্তরে মোটামুটি একই ভূমিকা পালন করে। লোকেরা যখন উপসাগরের দিকে তাকায় এবং ন্যাটো ব্যবস্থার আহ্বান জানায়, তখন এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও গ্রিস সমন্বিত ন্যাটো হলে যে রকম হয় তেমন কিছু হতে পারে। দেশগুলোর আকার এতই আলাদা যে, সত্যিকারের জোট করা কঠিন। দ্বিতীয় সমস্যাটি হবে ইসরাইলের ভূমিকা। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা সবসময় এ ধরনের ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলবে। ডেস রোচেসের মতে, তৃতীয় সমস্যাটি হলো এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব।
লক্ষ্য নিয়ে বিভ্রান্তি
এক সময় আরব জোটগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসরাইলি দখলদারিত্ব থেকে আরব ভূমি মুক্ত করা। এখন জোট গঠনের লক্ষ্যবস্তু পাল্টে গেছে। এখন ইরানকে প্রতিরোধ বা ধ্বংস করতে প্রতিরক্ষা জোট গঠনের কথাও বলা হচ্ছে যে জোটে ইসরাইলের পাশাপাশি থাকবে আরব দেশগুলোও। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি কেবলই আরব রাজাদের ইহুদি তোষণের মাধ্যমে ক্ষমতা নিরাপদ রাখার কারণে হচ্ছে, মনে করার কারণ নেই। একই সাথে, সৌদি আরবের রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা ও রাজপরিবারের ক্ষমতার ঝুঁকি সৃষ্টির মতো প্রক্সি হামলাও এ জন্য কম দায়ী নয়।
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য কার ভূমিকা কতটুকু দায়ী তার চেয়ে বড় বিষয় হতে পারে এ ধরনের সঙ্ঘাতের পর মধ্যপ্রাচ্যের চেহারাটি কেমন হবে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে দু’টি পরিকল্পনার বিষয় এক সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ইনোন পরিকল্পনা ও বৃহত্তর ইসরাইল গঠন। দ্বিতীয়টি ছিল নতুন মধ্যপ্রাচ্য সৃষ্টির মানচিত্র। একটির পেছনে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের পরিকল্পনা থাকলেও দ্বিতীয়টির মূল পরিকল্পক হিসেবে দেখা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।
দু’টি পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেললেও চলতি শতকের প্রথম দিকের নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনাটি সরবে বা নীরবে বেশি আলোচিত হয়। এ পরিকল্পনা প্রকাশের পর আরব বসন্ত থেকে শুরু করে এমন কিছু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকে যাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান জাতি রাষ্ট্রগুলোর অখণ্ডতা হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, ইয়েমেন কার্যত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন একাধিক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই বিভক্তির ক্ষত এখনো বয়ে চলেছে। অন্য দিকে অন্য দেশগুলোও অভ্যন্তরীণ ও ছায়া সঙ্ঘাতের নানা ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়া অথবা অস্থিরতা সৃষ্টির হুমকির মধ্যে পড়েছে।
এ ধরনের সঙ্ঘাতমুখর অবস্থার অবসানের জন্য বিরোধের বিষয়গুলো এক পাশে সরিয়ে ঐক্যের সূত্র নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার একটি উদ্যোগ চলমান ছিল। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এখন মধ্যপ্রাচ্যও যেন পাল্টে যাচ্ছে। ইরাক গত এক বছরে রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে পাঁচ দফা আলোচনার আয়োজন করে। ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল-কাদিমি সম্প্রতি ইরানি প্রেসিডেন্ট ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সরকারি সৌদি প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে, প্রিন্স মোহাম্মদের সাথে কাদিমির বৈঠকের সময় দু’জন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও যৌথ সহযোগিতার সুযোগ নিয়ে কথা বলেছেন। রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যকার এই আলোচনা সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য একটি রোড ম্যাপ উপস্থাপন করেছে। এতে মনে হয়, নিরাপত্তা জোটের লক্ষ্য কেবলই ইরান নয়।
ইরানের বিরুদ্ধে জোট করার প্রচেষ্টা ইসরাইল ও সৌদি আরব দুই দেশেরই রয়েছে। তবে ইরান যদি তার পারমাণবিক উৎপাদনে পাইকারি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তা হবে তার নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে নয়। ইরানের কোনো প্রতিবেশী এ ক্ষেত্রে প্রলুব্ধ হবে কি না তা দেখার বিষয়। যদি তারা তা করে তবে তাদের সর্বোচ্চ আত্মবিশ্বাসী হতে হবে যে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ছাতা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে না। ইরানই একমাত্র উপসাগরীয় রাষ্ট্র, যারা পরাশক্তির হার্ডওয়্যার ছাড়াই নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ার পরিণতি লাভ সম্ভব হচ্ছে না ইরানের এক ধরনের প্রান্তিক অবস্থানের কারণে। নানা স্বার্থগত ইস্যুতে ইরান-তুরস্ক মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হচ্ছে। তুরস্কও অভ্যন্তরের পরিস্থিতির প্রতি নানাভাবে মনোযোগী হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এখন যা কিছু করছেন তা আগামী বছরের নির্বাচনের প্রস্তুতিকে সামনে রেখে। হাইপারইনফ্লেশনে বিপর্যস্ত জনগণের কাছে এরদোগানকে দু’টি জিনিস প্রমাণ করতে হবে যে, তুরস্ক আর প্রধান আরব শক্তির সাথে যুদ্ধে নেই এবং তিনি অর্থ আনতে পারেন।
এ ধরনের এক অবস্থায় সুন্নি আরব দেশগুলো আর ইসরাইল মিলে ইরান বিরোধী কোনো নতুন সামরিক জোট দাঁড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র পাল্টে যেতে পারে। ট্রাম্পের সময় আরব ন্যাটো নামে তেমন একটি জোটই সৃষ্টি করার উদ্যোগ ছিল। সেই বাস্তবতা কিন্তু এখন নেই। ইরান বিরোধিতা এবং পরমাণু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার প্রশ্নে ট্রাম্প আর বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গিও এক নয়। পরমাণু চুক্তি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ইরানের সাথে পাশ্চাত্যের সমঝোতা জোরালোভাবে না এগোলেও তা বন্ধ নেই। নতুন করে দুই পক্ষ পরোক্ষ বৈঠকে বসেছে। এতে ইরানের পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়ার আকাক্সক্ষা অবরোধ প্রত্যাহারের শর্তে বাদ দেয়ার সমঝোতার কথা জানা যাচ্ছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে ইরানের পরমাণু সমঝোতা হলেই যে, দেশটি আমেরিকান বলয়ে ঢুকে যাবে এমনটি নয়। তবে ইরানি প্রভাব মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে এতে অনেক বাড়বে। সেই প্রভাব থেকে নিরাপত্তার জন্য শীর্ষ সুন্নি আরব অনারব দেশগুলো একটি সামরিক জোট গঠনের প্রয়োজন অনুভব করছে বলে মনে হয়।
পরমাণু ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে সমঝোতার পর মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূমিকাকে রাশিয়া-চীন কতটা কিভাবে সমর্থন করে তা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ভূমিকাও এক ধরনের সীমাবদ্ধতায় আটকে আছে। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে যতটা তিনি চিবিয়ে খেতে পারেন তার চেয়ে বেশি কামড়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়। তাকে সিরিয়া থেকে ইউনিট প্রত্যাহার করতে হয়েছে এবং লিবিয়া থেকে ওয়াগনার ভাড়াটে সেনাদের পুনরায় মোতায়েন করতে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার ফোকাস এতে নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইরানের সাথে আমেরিকান সমঝোতার পর পেছন থেকে চীন রাশিয়া সরে দাঁড়ালে এই শক্তিমান মুসলিম দেশটি তার অবস্থান হারাতে পারে। আর ইরানের মধ্যপ্রাচ্যে গ্রাউন্ড হারানোর অর্থ হবে একই সাথে ফিলিস্তিন ইস্যুতে জোরালো সমর্থনও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আরব ন্যাটোর কোনো মিত্র দেশ অথবা ইসরাইলের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী তুরস্কের মতো কোনো রাষ্ট্র ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের মতো সমর্থন জোগাতে পারবে না। ফলে ‘আরব ন্যাটো’ জোটের সামনে ইরান শক্তিমত্তা হারানোর অর্থ শুধু দেশটি দুর্বল হবে এমন না, একই সাথে ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনও দুর্বল হয়ে পড়বে।
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন