গোলাম মোর্তোজা
এমন অভিযোগ ৫০ বছরের বাংলাদেশে আগে কখনো উঠেনি। অভিযোগ আর্থিক অনিয়ম বা অসততার।
বলছি নির্বাচন কমিশনের কথা। বাংলাদেশে এ যাবৎকালে যতগুলো নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কমবেশি অভিযোগ আছে সবগুলো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন না করার ও সরকারের প্রতি আজ্ঞাবহতার। সেসব অভিযোগেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন আরও বড়ভাবে অভিযুক্ত।
কিন্তু, অতীতের কোনো সময়ের নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম বা অসততার অভিযোগ উঠেছে বলে জানা যায় না। যা উঠেছে বর্তমান এ কে নুরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কমিশনারদের বিচারিক বা জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া সাধারণ নয়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-অসততার অভিযোগের তদন্তের জন্যে প্রয়োজন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। যা গঠন করতে পারেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। দেশের ৪২ জন নাগরিক এই দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে। এই চিঠির প্রায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একজন নির্বাচন কমিশনার বেশ তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, ৪২ নাগরিকদের বিবৃতি উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে। তিনি তার মতো করে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই পারেন। তবে সেই প্রতিক্রিয়া যদি এমন হতো যে তাদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির ঘটনাগুলো ঘটেনি, সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দিয়ে তিনি যদি তা বলতেন। তা তিনি বলেননি।
বলে রাখা দরকার যে, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রমাণের আগে পর্যন্ত বলার সুযোগ নেই যে তারা দোষী। এবার নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে ৪২ নাগরিকের আনা অভিযোগগুলোর দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক।
ক. বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দ ছিল ৬১ কোটি ২৫ লাখ ও ৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে নিজেরা এই অর্থ নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব ‘কোর্স উপদেষ্টা’ হিসেবে একাই নিয়েছেন ৪৭ লাখ টাকা। সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারসহ ১৩ জন কর্মকর্তা নিয়ে একটি ‘বিশেষ বক্তা’ প্যানেল গঠন করা হয়।
রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘ইসির নথিতে উল্লেখ আছে সিইসিসহ এই কর্মকর্তারা ১৮ দিনে ৫২০টি স্থানে বক্তৃতা করেছেন। প্রতিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চার জন বিশেষ বক্তার উপস্থিত থাকার কথা। ফলে প্রত্যেক ‘বিশেষ বক্তা’কে দিনে কমপক্ষে ১৪টি স্থানে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। বাস্তবে যা কোনভাবেই সম্ভব হওয়ার কথা নয়।
খ. সংসদ নির্বাচনে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে বরাদ্দ ছিল ৪৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এই অর্থ থেকে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা ভাগ করে নিয়েছেন নয় জন ‘বিশেষ বক্তা’। উপজেলা নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে অনুপস্থিত থেকে ‘বিশেষ বক্তা’রা প্রশিক্ষণবাবদ উপজেলা প্রতি পাঁচ হাজার করে মোট ৫৩ লাখ ১০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা নিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অর্থ নেওয়ার বিষয়টি সংবিধানের ১৪৭(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়া আরও কিছু অভিযোগ সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই অভিযোগগুলো সত্য না অসত্য, তা প্রমাণের একমাত্র উপায় সঠিক প্রক্রিয়ায় গ্রহণযোগ্য তদন্ত। অভিযোগকারীরা বলছেন তদন্তে প্রমাণিত হবে। একজন নির্বাচন কমিশনার বলছেন, অভিযোগগুলো সঠিক নয়। তদন্তে প্রমাণের সম্ভাবনা যেমন আছে, আবার প্রমাণ নাও হতে পারে। প্রমাণ না হলে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। ভাবমূর্তি সংকটে পড়বেন ৪২ নাগরিক। দেশের নাগরিক হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হোক, সেটাই চাই। সেটা তো মুখের কথা বা রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে করা যাবে না। সঠিক তদন্তই একমাত্র পথ।
সরকার আর নির্বাচন কমিশন এক নয়। সরকার নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করে না।
তাহলে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিরুদ্ধে কেন অবস্থান নিচ্ছেন সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা? তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলছেন, ৪২ নাগরিকের চিঠি ড্রাফট হয়েছে বিএনপি অফিসে।’
এই চিঠির অভিযোগগুলোর যদি সুষ্ঠু তদন্ত হয়, তবে কোথায় ড্রাফট হয়েছে- তদন্তে তাও জানা সম্ভব।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলছেন, ৪২ নাগরিক নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করতে চাইছে।
যদি ধরে নেই তার অভিযোগ সঠিক, সেটাও তো তদন্ত করে প্রমাণ করা যায়। তাহলে তদন্তের বিরোধিতা কেন করছেন?
অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্ট, আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য সুনির্দিষ্ট নয়। প্রতিটি অভিযোগ ধরে ধরে যদি তারা বলতে পারতেন, এটা এই কারণে সঠিক নয় বা এই ঘটনাটি ঘটেনি। নির্বাচন কমিশনের নথির উদ্ধৃতি দিয়েই গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। নির্বাচন-বিষয়ক অভিযোগের অনেককিছু নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আছে। ৪২ নাগরিকের বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তারা তুলতেই পারেন, অভিযোগও করতে পারেন। প্রশ্ন হলো, এখানে বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা খোঁজা গুরুত্বপূর্ণ, না নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে আসা অসদাচরণের অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ?
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব প্রসঙ্গে আসি। সাধারণভাবে দৃশ্যমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনারগণ, নির্বাচন কমিশনের সচিবের কাজ দেশে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। এর জন্যে তারা প্রশাসনিকভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাপ্রাপ্ত। জনঅর্থে তারা বাসস্থান, গাড়ি, বেতন-ভাতা, যাতায়াত সুবিধা, আপ্যায়ন সুবিধা, নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। তাদের পদ মর্যাদা বিচারপতিদের সমান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের বেতন ১ লাখ ৫ হাজার ও ৯৫ হাজার টাকা। নতুন নীতিমালায় তারা আজীবন পেনশন পাবেন মাসিক বেতনের সমপরিমান অর্থ। বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের সবাই একবার সকল সুযোগ সুবিধাসহ চাকরিজীবনপূর্ণ করে এসেছেন। সেই চাকরি জীবনে সরকারি কর্মকর্তারা বহুবিধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। প্রশিক্ষণ বা ক্লাস নেওয়ার জন্যে তারা কিছু সম্মানী পেয়ে থাকেন।
সেই কাজ আর নির্বাচন কমিশনের কাজ এক নয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনারদের কাজই নির্বাচন আয়োজন করা। প্রশিক্ষণ, বক্তৃতা সবকিছুই নির্বাচন আয়োজনেরই অংশ। এই কাজের জন্যে তারা যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কোনো বিবেচনাতেই তা কম নয় এবং অত্যন্ত সম্মানজনকও বটে।
ফলে তাদের দুই কোটি টাকা ভাতা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ গুরুতর হয়ে উঠেছে যখন দৃশ্যমান যে, দিনে ১৪ জায়গায় প্রশিক্ষণে বক্তৃতা করার অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখিয়ে তারা অর্থ নিয়েছেন। আবারও বলছি, এই অসম্ভবকে তারা কোনো বিশেষ উপায়ে বা প্রক্রিয়ায় যদি সম্ভব করে থাকেন, তা প্রমাণের জন্যেও তদন্ত প্রয়োজন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৪ কোটি টাকার অনিয়ম-অসঙ্গতির লিখিত অভিযোগ তুলেছেন একজন নির্বাচন কমিশনার।
নিয়ম অনুযায়ী সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা দুটি করে গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। অর্থাৎ তাদেরকে দুটি করে গাড়ি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, তিনজন নির্বাচন কমিশনার বিধি লঙ্ঘণ করে তিনটি করে গাড়ি ব্যবহার করছেন।
ইভিএম কেনা নিয়ে বহুবিধ আর্থিক ও অনৈতিক অভিযোগ এসেছে। ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ‘পেপার ট্রেইলবিহীন’ ইভিএম কেনা হয়েছে। বরাদ্দের আগে টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
এছাড়াও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, খুলনা, গাজীপুর, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট, শতভাগ ভোট, প্রবাসে অবস্থান করে ভোট ইত্যাদি।
আর্থিক অসদাচারণ, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও নির্বাচনে অনিয়মসহ যত অভিযোগ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সব অভিযোগই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, এ কথা সত্যি। কিন্তু, বাংলাদেশের মতো দেশে গণতন্ত্রের প্রধানতম উপাদান নির্বাচন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কেমন নির্বাচন হয়, তা তো দৃশ্যমান। কিন্তু, তারচেয়েও গুরুতর অভিযোগ অর্থনৈতিক অসততার। এসব অসততার অভিযোগ যখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তখনই তদন্ত প্রত্যাশিত ছিল। তা না করে, সম্পূর্ণভাবে তদন্তের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এমন একটি অবস্থার পরিপ্রক্ষিতে রাষ্ট্রের কিছু সংখ্যক নাগরিক মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের অভিভাবক মহামান্য রাষ্ট্রপতি। বল এখন অভিভাবকের কোর্টে। দেখার বিষয় অভিজ্ঞ-বর্ষীয়ান, জনগণের ভোটে বারবার নির্বাচিত অভিভাবক আবদুল হামিদ কী করেন। কেউই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়, নির্বাচন কমিশনও নয়। জনগণের পক্ষে তা নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রপতি। তিনি উদ্যোগ নিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেন।
তিনি যা করবেন, ইতিহাসে তা সেভাবেই স্থান পাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন