পীর হাবিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপহাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠককালেই তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। স্বাধীনতার রূপরেখাসহ ব্যানার্জির হাতে ভারতের সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে লেখা চিঠি তুলে দেন। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি আমাকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে সে রাতে বলেছিলেন ‘আমরা তোমাদের কাছে হাত পাতছি না। সমমর্যাদার ভিত্তিতে সহযোগিতা চাইছি আমাদের স্বাধীনতায়। চীনের সঙ্গে পরাজয়ের কারণে এখন তোমাদের কেউ পুছবে না, আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীন হলে তোমাদের ইজ্জত বাড়বে।’
বঙ্গবন্ধুর আত্মমর্যাদাসুলভ চিঠির জবাবে নেহেরু একমত হয়েছিলেন সমমর্যাদার বিষয়ে। পরের ইতিহাস সবার জানা। নেহেরুর পর ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পাশে কতটা আন্তরিকভাবে সাহসের সঙ্গে ছিলেন সেটি বিশ্ববাসী জানে। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায় ইন্দিরা এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে, আওয়ামী লীগের সরকার গঠন থেকে, মুজিববাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করতে অস্ত্র ট্রেনিং, অর্থ সাহায্যই দেননি বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বজনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, গণহত্যা ধর্ষণ, ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে বিচারের নামে হত্যা করার ঘৃণ্য চেষ্টার বিরুদ্ধে পৃথিবীজুড়ে ঝড় তুলেছিলেন। সেদিন নিক্সন প্রশাসনের বিরোধিতা তাঁকে রুখতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অনেক দেশকে আমাদের পাশে এনেছিলেন। তিনি তাঁর মন্ত্রীদেরই জনমত গঠনে বিদেশ সফরে পাঠাননি, নিজেই বেরিয়েছেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গেও অপমান সয়ে বৈঠক করেন। সোভিয়েতসহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনী গঠন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা ও তাঁর ভারতের জনগণ আমাদের হৃদয়ই জয় করেননি, দুই দেশ একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বন্ধুত্বে বিশ্বাসের উচ্চতায় জায়গা করে নেয়। বঙ্গবন্ধুর এক কথায় ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নিয়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য বন্ধুর হাত বাড়িয়েছেন। আর বঙ্গবন্ধুও কলকাতায় গিয়ে ২০ লাখ মানুষের সমাবেশে ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলেননি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করে, এ দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ভারতবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষটাও বাতাসে তুমুল বেগে ছড়ানো হয়। খুনি মোশতাক সরকারকে ৩০ মিনিটের মধ্যে একাত্তরের পরাজিত খলনায়ক জুলফিকার আলী ভুট্টো সমর্থন দেন ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ বলে! একাত্তরে আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে চরম অবস্থান নিয়েছিল চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ। ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরে সৌদি আরব কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আর ইন্দিরা বারবার সতর্ক করলেও বঙ্গবন্ধু আমলে নেননি। খুনিদের সন্তানের মতো বিশ্বাস করেছিলেন। সেদিন বিমর্ষ ইন্দিরা শেখ হাসিনাকেই আশ্রয় দেননি, প্রতিরোধযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীসহ তাঁর বাহিনী ও বিপদগ্রস্ত নেতা-কর্মীদেরও আশ্রয় দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক টানাপোড়েনে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে উষ্ণ থাকে, নিরাপদ থাকে। নয় খারাপ। এখানে আইএসআইর তৎপরতা বাড়ে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার নেপথ্যে ভারতের সমর্থন ছিল, এমন কথা প্রচলিত। কিন্তু সেই শাসনামল ভারতের জন্য ছিল নিরাপদহীন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য ভয়ঙ্কর। রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদকে লাগামহীন প্রশ্রয়, আইএসআইর প্রসারিত হাতের অশুভ খেলায়, গ্রেনেড, বোমায় ক্ষতবিক্ষত দেশ। ১০ ট্রাক অস্ত্র, একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে উড়িয়ে দেওয়ার নৃশংস আক্রমণসহ কত ঘটনা। পাকিস্তানের সঙ্গে যতই কূটনৈতিক সম্পর্ক থাক, ’৭১ থেকে তাদের সব অপরাধের দগদগে ঘা কখনো শুকাবার নয়। আমাদের সব বন্ধুত্বের ভিত্তিই মুক্তিযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হওয়ায় ভারতই পরম বন্ধু। জাতীয় শোক দিবসে বিএনপি নেত্রীকে জন্মদিনের উপহার পাঠায় চীনা দূতাবাস! আজব!
সেদিন বিএনপি-জামায়াতের জিঘাংসার রাজনীতির মুখে মুজিবকন্যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ১৪ দল থেকে মহাজোট গঠন যেমন ছিল অনিবার্য তেমনি আজকেও রাজনীতিতে, সরকারে, এটাকে নতুনরূপে সুসংহত করার সময় এসেছে। পৃথিবীজুড়ে আজ পরিবর্তন। আঞ্চলিক রাজনীতিতেও নানা অস্থিরতা। করোনার মহাপ্রলয়ে অশান্ত বিপদগ্রস্ত পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও ক্যারিশমাটিক নরেন্দ্র মোদি কূটনৈতিক সম্পর্ক বা দুই দেশের বন্ধুত্বের ধারা বহাল রেখেছেন। শেখ হাসিনাও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। অমীমাংসিত সীমান্ত চুক্তির সমাধান যেমন হয়েছে তেমনি শেখ হাসিনাও জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা হারানো ধর্মনিরপেক্ষতাসহ অনেক আদর্শ ফিরে পাইনি। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মাধুর্যও এখন ধূসর। তবু দুই দেশের বন্ধুত্বের বিকল্প নেই। ভারত যেমন আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু তেমনি এ দেশের রাজনীতিতেও আজ জনগণের শক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির একক নেতা শেখ হাসিনা। কোনো উসকানি-অপপ্রচারে আজ দেশের কোনো মহলকেই বিভ্রান্ত না হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যে জনগণকে সংগঠিত করে করোনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জয়ী হতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করে আগামী দিনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। বারবার বলছি অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায়, শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালে দেশ দোজখে পরিণত হবে। এ দেশে একদলীয় শাসন, সেনাশাসন, এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের সুশীল শাসনও ব্যর্থ হয়েছে। ভঙ্গুর হলেও রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক শাসনই উত্তম ও গ্রহণযোগ্য। এখানে আওয়ামী লীগকেও যেমন অতীতের অভিজ্ঞতায় আদর্শিক নেতা-কর্মীদের নিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করা সময়ের দাবি, তেমনি মহাজোটের। একই সঙ্গে আত্মসমালোচনা আত্মশুদ্ধির।
’৭৫-এর পর দীর্ঘ পথ আওয়ামী লীগ থেকে ছাত্রলীগ-বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নেতা-কর্মীরা অমিত সাহস নিয়ে একাই একসঙ্গে হেঁটেছিলেন। খুনিদের উন্মত্ত উল্লাস, নিষ্ঠুর সামরিক শাসন ও মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ-দেশীয় দোসরদের রাজনীতি ও সমাজে পুনর্বাসিতকালই নয়, তাদের বিকৃত উল্লাস ও আত্মতৃপ্তির কাল। কি ভয়ঙ্কর এক অন্ধকার অভিশপ্ত সময়। তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটিও নিষিদ্ধ। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসও নেই আলোচনায়। কারণ সেই বীরত্বের ইতিহাস এলেই তার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উঠে আসেন। সে সময় জাতীয় শোক দিবস কেবল আওয়ামী লীগ পরিবারই পালন করেছে। তখন গরিবের দল আওয়ামী লীগের টাকাপয়সা নেই, অনুদানেরও তেমন লোকজন নেই। নিজেরা চাঁদা তুলে খিচুরির কাঙালি ভোজ, জিলাপির মিলাদ মাহফিল, কোরআন খতম, আলোচনা সভা, প্রকাশনা আর সাদা-কালো জনকের ছবিতে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ স্লোগান শোভিত পোস্টারের বড় আবেদন ছিল। আবেগ ছিল, বুকভরা বেদনা ছিল। শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথ ছিল। মাইকে বেজে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শক্তিতে সাহসে শিহরিত করত। অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ছিল ভীষণ প্রেরণার। সশস্ত্র সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরুদ্ধে ’৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ও তাঁর কাদেরিয়া বাহিনী ছিল আমাদের অদৃশ্য শক্তি। ষাটের দশক থেকে ’৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক দুর্যোগকালে মোস্তফা মহসীন মন্টুরা ছিলেন অমিত সাহস। হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গদের অবদানও কম নয়। গণমাধ্যমও অনুকূলে ছিল না। সাপ্তাহিক খবর, মুক্তিবাণী ছিল প্রচারমাধ্যম। পরে বাংলার বাণী এলো আইনি লড়াইয়ের অনুমতি নিয়ে।
আমরা সেদিন টগবগে রক্তে স্লোগান দিতাম ‘মুজিব হত্যার পরিণাম বাংলা হবে ভিয়েতনাম’, ‘এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’- কি আবেগ ও দরদ ছিল স্লোগানে। কি ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশে শোক দিবস পালিত হতো। সে সময় খুনি, বিশ্বাসঘাতক মীরজাফররা জাতীয় শোক দিবসে নাজাত দিবস পালন করত। আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ- এক কথায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শক্তিকে, একদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি সামরিক সরকারের নির্যাতন, তাদের পেটোয়া বাহিনীর ত্রাস, আরেকদিকে খুনিদের শক্তি, অন্যদিকে অতিবিপ্লবী চীনাপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর নিষিদ্ধ রাজনীতি থেকে পাওয়া অস্ত্রবাজি ও সশস্ত্র উগ্রপন্থি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করেই বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শের শক্তিতেই বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়েছে। তখন বাকশালে বিলীন হওয়া মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট-ন্যাপ ও তাদের ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় শোক দিবস পালন করেনি। অতিবিপ্লবীরা তখন মুজিব ও আওয়ামী লীগবিদ্বেষী প্রচারণায় এগিয়ে থেকেছে।
চীনাপন্থি অতিবিপ্লবীরা সামরিক শাসকদের পদধূলি নিয়ে দলে দলে যোগ দিয়েছেন ক্ষমতার স্বাদ নিতে। আর কমিউনিস্ট-ন্যাপ তো কখনো নিজের শক্তিতে কোনো নির্বাচনে বিজয় ঘরে তুলতে পারেনি। মস্কোপন্থিরা ঐক্যের নৌকায় চড়ে এমপি হন। কেবল জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি সংসদে আসে নিজের শক্তিতে। এক বা একাধিক আসনেই হোক। ’৭০ সালে ন্যাপ থেকে প্রাদেশিক পরিষদে আসেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যাক ’৭৫ থেকে ’৮১ সাল আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতিতে ছিল আদর্শিক শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ানোর কাল। কঠিন সময়। আর ’৮১ থেকে ’৯৬ সাল ২১ বছর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলকে আন্দোলন-সংগ্রামে জনপ্রিয় করে রাজপথে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরার কাল। এত প্রতিকূল পরিবেশেও ছাত্রলীগের সাহসী তরুণরাই কুখ্যাত মীরজাফর মোশতাকের রাজনীতি রুখেছিল। কারামুক্ত হয়ে বায়তুল মোকাররমে ডেমোক্রেটিক লীগের জনসভার মধ্য দিয়ে খুনি মোশতাক রাজনীতিতে নামতে গেলে ছাত্রলীগের সাহসীরাই সাপ ছেড়ে, হামলা করে সভা প- করেছিল। সিলেটেও প্রতিরোধ করেছিল ছাত্রলীগ। মোশতাক পরে মীরজাফরের চেয়ে জঘন্য ঘেন্না গ্লানি নিয়ে ষড়যন্ত্রের কুঠিরবাড়ি আগামসি লেনের বাসভবনে নিঃসঙ্গভাবে করুণ মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছে। সে সময় খুনিরা অস্ত্রবাজ ফ্রীডম পার্টি করেছিল। দলের মুখপাত্র দৈনিক মিল্লাত প্রকাশ করেছিল। খুনিদের সামরিক শাসকরাই নয়, গণতান্ত্রিক খালেদা জিয়ার শাসনামলও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, সংসদে এনেছে। কিন্তু খুনিরা যেমন ফাঁসিতে ঝুলেছে তেমনি তাদের ফ্রীডম পার্টিরও দাফন হয়েছে। মীরজাফরের ডিএল তার জীবিতকালেই মৃত্যুবরণ করেছে।
দুই বছর ধরে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আরেক ইতিহাস জন্ম দিয়েছেন। বলছেন, কমরেড মণি সিং নাকি বাকশালে যোগদানে বঙ্গবন্ধুকে আপত্তি জানিয়েছিলেন। এমনকি পার্টি বিলুপ্ত করেননি। আইনগত কারণে যোগদান করলেও গোপনে ছোট আকারে সাংগঠনিক কাঠামো রেখেই তাঁরা যোগ দেন। এমন তত্ত্ব কখনো মণি সিং, ফরহাদ, মানিক দেননি। আজ সেলিম কেন বলছেন? একজন নির্লোভ আদর্শিক রাজনীতিবিদ হিসেবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আজন্ম বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পাঠ নেওয়া সহজ সরল সোজাসাপ্টা চিন্তায় তাঁদের গোপন ও কৌশলের হিসাবটা মেলাতে পারি না। সিপিবি-ন্যাপ তো স্বাধীনতার পরই বিরোধী দলের ভূমিকায় না গিয়ে আওয়ামী লীগের বি-টিম হয়ে লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। বাকশাল গঠনে তারাই তো ছিল অগ্রগামী। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউলের রক্ত ঝরিয়ে প্রথম তারাই লাশের রাজনীতি করে। উগ্রতা করে পরে বঙ্গবন্ধুর কাছে ঝড়ের মুখে ক্ষমাও চায়। সিপিবিও বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে জিয়ার খাল কাটা বিপ্লবে যায়। এত দিন শুনেছি রেজুলেশন আছে পার্টি বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগদান ভুল ছিল, এখন শুনি আরেক কাহিনি।
বঙ্গবন্ধুও বাকশালের সব দায়িত্বে আওয়ামী লীগের নেতাদেরই রাখেন। কোনো সংগঠনই ওদের হাতে দেননি। গুরুত্বহীন পদ, সদস্য নিয়ে ন্যাপ-সিপিবি কার্যত আওয়ামী লীগেই বিলীন হয়। ন্যাপের সৈয়দ আলতাফ হোসেনকে বঙ্গবন্ধু প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। তিনিও রক্তের ওপর দিয়ে খুনির মন্ত্রিসভায় গেছেন। এজন্যই একই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে সিপিবি সাড়ে তিন দশক শাসন করেছে সেখানে এ দেশে একক নির্বাচনে একটি আসনেও জিততে পারে না, জামানত হারায়। যতবার জিতেছে ’৫৪-এর ৮টিই হোক, ’৯১-এর ৫টিই হোক- নৌকায় চড়ে।
আওয়ামী লীগেরও দুর্ভাগ্য যে দলের দুঃসময় থেকে আদর্শের প্রশ্নে নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের দায়িত্বশীল পদে বসাতে পারে না, অনেক বীরকে ধরে রাখতে পারে না। পারলে তাড়িয়ে দেয়। অথচ লেনিন, মান্নান খান যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টিতেই অচল তাঁদের এনে প্রেসিডিয়াম সদস্য করে। ’৭৫-পরবর্তী দুঃসময়ে গণবাহিনীর ত্রাস শাজাহান খানই প্রেসিডিয়ামে থাকবেন। অথচ দলে কত অভিজ্ঞ প্রবীণ, লড়াকু মধ্যম ও নির্যাতিত তরুণ অনাদরে অবেহলায়। কাল বিরোধী দলে গেলে, নিপীড়ন নামলে লড়াই-সংগ্রামটা করবে কারা? শোকার্ত আজকের সবাই থাকবেন তো? চট্টগ্রামে কিছুদিনের জন্য খোরশেদ আলম সুজনকে সিটির প্রশাসক করায় দেশ-বিদেশে ত্যাগীরা কি খুশি। ’৭৫-পরবর্তীতে সুজন উঠে আসেন। আদর্শিক রাজপথের কর্মী। তার মানে দুর্দিনের সবার মূল্যায়ন চান দলের কর্মীরা।
সেদিন একজন কমেন্ট করেছেন কাদের সিদ্দিকী ও নঈম নিজামের ছবির নিচে, ‘দিগন্ত টিভির উপস্থাপক’। বাঘা সিদ্দিকী বলেছেন, ‘একাত্তরে হানাদার বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে যুদ্ধ করলে অসুবিধা কী? আমি তো জামায়াতের আদর্শ প্রচার করিনি, আমারটা করেছি। তবু কেউ ব্যথিত হলে ক্ষমাপ্রার্থী।’ আর যিনি কমেন্ট করেছেন তিনি একশবার জন্মালেও কাদের সিদ্দিকীর একটা সাহস দেখাতে পারবেন না। বাঘা যখন প্রতিরোধযুদ্ধ করে অনিশ্চিত নির্বাসনে, মাংস খান না তখন সেই বাচাল জাসদ করেছে। মুজিব ও আওয়ামী লীগবিদ্বেষী থেকে এখন ১০ বছর বয়সী আওয়ামী লীগার। ছাত্রজীবনে আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন করা অনেকেই নব্য আওয়ামী লীগ। টকশো বেচে খাওয়া ওদের একজনের তো বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। উপস্থাপক হলেই সাংবাদিক না, এটাও সবাই জানে না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকে ভয়ে, কেউ হতবিহ্বল, কেউ ষড়যন্ত্রে খুনির মন্ত্রিসভায় গেছেন। বড় চার নেতা তো আপস করেননি বলে কারাগারে জীবনই দিলেন! তোফায়েলের মতো নেতাকে খুনিরা পিটিয়ে আধমরা করেছে। জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক সেবা করেছেন হাজতে। কেন্দ্র থেকে জেলার সব আওয়ামী লীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ নেতা জেল খেটেছেন কত বছর কারও মনে আছে? দুঃসময়ে অন্য দল করে এখন সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগ, তাও বড় কথা- লাজ-শরমও নেই। গোটা দেশ আওয়ামী লীগের জন্য কারাগার ছিল।
যাক, জাতীয় শোক দিবস এখন প্রায় সব দল করছে। এটা মুজিবকন্যার অর্জন। তাদের বিলম্বে হলেও উপলব্ধি। বহু আগে বলেছিলাম যার তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখতে চাই না। আইন দরকার। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত দরকার। বাংলাদেশ প্রতিদিনে রফিকুল ইসলাম রনি চমৎকার রিপোর্ট করেছে- ‘শোক ঢাকা পড়েছে পোস্টারে’! আবেগ ও শ্রদ্ধাহীনরা বঙ্গবন্ধুসহ শহীদদের ছবি ছোট করে নিজেদের ছবি বড় করে ব্যানার, বিলবোর্ড কত কী করেছে আত্মপ্রচারে। হুঁশটাও নেই। তেমনি দল ও নেতা-কর্মী যেমন ধনী হয়েছেন, দেশজুড়ে সবাই আওয়ামী লীগ হয়েছেন! কেবল বেদনাভরা শোকের ভাবগাম্ভীর্যের আবেগ-অনুভূতি হারিয়েছে। তাই ডিবিসি টিভির নিউজ, এফডিসিতে শোক দিবসের মঞ্চে নায়ক-নায়িকারা আমোদে হেসেছেন, ছবি সেলফিবাজি করেছেন, ভিক্টরি চিহ্ন দেখিয়েছেন! কি অসভ্য! একালের নেতা-মন্ত্রীরা আবার এসব আবেগ-অনুভূতি বিচার বোধহীন সিনেমার নায়ক-নায়িকা ছাড়া রাজনীতিও করতে পারেন না!
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন