ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয় দেশের আর্থিক খাতসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিগত সরকারের ব্যর্থতা ও কী কী ভুল ছিল সে ব্যাপারে সময় সংবাদ মুখোমুখি হয় দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইসুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারের মূল অংশ তুলে ধরা হলো।
বিনিয়োগকারীরা যদি এখানে বিনিয়োগ করতে চান, এই মাঠে খেলতে চান, তারা দেখে এই নিয়ম কানুন সবার জন্য সমান হবে, এমনকি যদি সেটা ফাউলও হয়; তাহলে কিন্তু খেলাটা হয়। অর্থাৎ মাঠটা সমান হতে হবে। রেফারিংও নিরপেক্ষ হতে হবে। ছবি: সময় সংবাদ
বিনিয়োগকারীরা যদি এখানে বিনিয়োগ করতে চান, এই মাঠে খেলতে চান, তারা দেখে এই নিয়ম কানুন সবার জন্য সমান হবে, এমনকি যদি সেটা ফাউলও হয়; তাহলে কিন্তু খেলাটা হয়। অর্থাৎ মাঠটা সমান হতে হবে। রেফারিংও নিরপেক্ষ হতে হবে।
সময় সংবাদ: আপনার দৃষ্টিতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুলগুলো কী ছিল?
ড. জাহিদ হোসেন: আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় দাগের ভুলটা হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ করে প্রশাসন, অর্থনৈতিক যেসব প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যান্যা রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এগুলোর দলীয়করণ এবং এখানে যে ধরনের লোকজন নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেখানে শুধু আনুগত্যের ভিত্তিতে মেধাকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে, কিছুক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়োগ দেয়া হয়। কোন জায়গায় পোস্টিং দেয়া হবে, পদোন্নতির বিষয়গুলো, অন্যান্য যে সুবিধাগুলো আর্থিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও শুধু আর্থিক সুবিধাই নয়, যেমন বিদেশে ডেলিগেশন যাবে, সেখানে কে যাবে, এমনকি যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও সব কিছুই ছিল এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। একেবারে বিনা প্রশ্নে তার সিদ্ধান্তগুলো, তার নির্দেশনাগুলো আপনি মানছেন কি না। তার কথা অনুযায়ী আপনি কাজ করছেন কি না। অথচ এই জায়গায় আমাদের একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ছিল, একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মূল বিষয়টি হলো আপনার ক্ষমতা কোথাও কেন্দ্রীভূত হতে পারবে না। এই ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। একইভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। পাশাপাশি প্রশাসন সরকারের নির্বাহী বিভাগের অধীনেই কাজ করবে, কিন্তু প্রশাসনকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এখানে একটা ফিডব্যাক লুপ থাকতে হবে। যেখানে আপনি যে সিদ্ধান্তগুলো দিচ্ছেন তার ফলাফল কি হচ্ছে সেটা জানার পথটা খোলা থাকতে হবে। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে যেটা দাঁড়িয়ে ছিল, তা যেন অনেকটা হীরক রাজার দেশের মতো, অথবা বলা যেতে পারে হীরক রানির দেশ। সেখানে তো রাজা যা বলছে সেটাই আইন।
সময় সংবাদ: আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাদের নিয়োগ যথার্থ হয়েছিল কি না?
ড. জাহিদ হোসেন: এ ধরনের ক্ষেত্রে শাসকরা মূল অধীনস্থদের আনুগত্যের লিটমাস টেস্ট নেন, যে আপনি আমার অনুগত কি না। যদি আমি বলি সূর্য পূর্ব দিকে উদয় হয়ে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়, এর সঙ্গে সবাই একমত হবেন। কারণ এটা ধ্রুব সত্য, সবাই জানেন। এখানে আনুগত্যের কোনো সিগন্যাল পাওয়া যায় না। কিন্তু যদি আমি বলি সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে এবং পূর্ব দিকে অস্ত যায়, এবং এটার সঙ্গে যদি আপনি সহমত পোষণ করেন, তাহলে বলা যেতে পারে, আপনি আমার আনুগত্যের পরীক্ষায় পাস করেছেন। তো গত ১৫ বছরে ওই ধরনের একটি পরিবেশ বিরাজ করেছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী যাই বলছেন, অনেক ধর্মীয় বাণীর মতো, তিনি যা বলছেন সেটাই শেষ কথা। সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এবং সেটাই বাস্তবায়ন করতে হবে। এমনকি সেটা বাস্তবায়ন হলে তার ফলাফল যদি নেতিবাচক হয়, তবে সেটাও তাকে বলা যাবে না। সেখানে সত্য কথা বলার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি, কারণ সত্য কথা বললেই তাকে আপনি প্রতিপক্ষের লোক হিসেবে অভিহিত করছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যার সঙ্গে তুলনা করা যায় ’নাইন ইলেভেন’ এর পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সেই উক্তি, ‘আপনি যদি আমার সঙ্গে না থাকেন, তবে আপনি আমার বিরুদ্ধে’, এর সঙ্গে। এখানে কিন্তু সেই মাত্রাও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ আপনি যদি আমার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার বিপরীতে কোনো ’নেগেটিভ ফিডব্যাক’ নিয়ে আসেন, তার মানে হচ্ছে আপনি আমার বিরুদ্ধে।
সময় সংবাদ: এই স্বেচ্ছাচারিতার প্রভাব কতটা পড়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে?
ড. জাহিদ হোসেন: চাটুকারিতা ও তোষামোদি উৎসাহিত করার কারণে বাস্তবতা থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দূরত্বটা একেবারেই বেড়ে গিয়েছিল। জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মাঠপর্যায়ে কী ঘটছে, যারা দেশ শাসন করছেন, তারা যদি না জানেন, তাহলে তারা তো একটা বাবলের মধ্যেই থাকবে। সেই বাবলে কেউ ঢুকতে পারবে তার কোনো পথ খোলা রাখা ছিল না। এবং সেটার চেষ্টা করাটাই ছিল অত্যন্ত বিপদজনক। ফলে সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে তার সিদ্ধান্তের ফলাফলের ব্যাপারে কোনো বার্তা দেয়া হবে সেটা অসম্ভব ছিল, যদি তারা বলতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নেয়া এসব প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে, কিংবা এই প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এই বিষয়গুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা সম্ভব ছিল না। কারণ তার মনোভাব এ রকম ছিল ‘আমার লোক করছে, আমি বলেছি, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, এত বড় সাহস’ পরিস্থিতি ছিল অনেকটা এ রকম। এ রকম ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা এ রকম পরিবেশে কাজ করতে পারে না, তারা নিরবেই সেখান থেকে সরে যায়। আর যারা এই তোষামোদিকে আশ্রয় করে নিজের লাভ খুঁজে নেয়, দেখা যায় তারাই শেখ হাসিনার আশপাশে চলে আসে। এই রকম পরিস্থিতিতে তোষামোদকারিদের পথটা সুগম হয়ে যায়।
সময় সংবাদ: আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এর প্রভাব কেমন হয়েছিল?
ড. জাহিদ হোসেন: আজ থেকে ২৫ বছর আগেও বাংলাদেশের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ছিল, যেগুলোকে বলা যেতে পারতো ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্সি’ হিসেবে। মোটামুটিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট কিংবা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা যেত যারা মোটামুটিভাবে তাদের সুনাম ধরে রেখেছিল। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টও ছিল মানুষের আস্থার জায়গায়। তখন ধারণা করা হতো সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা প্রভাবিত হয়ে কোনো বিষয়ে মতামত দিতেন না, সেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়াও ছিল অনেকটাই যথাযথ। কিন্তু এখন দেখেন সেভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর এখন তেমন আস্থা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবসহ অন্যান্য পদে যে সব কর্মকর্তা নিয়োগ পেতেন, তাদের জাদরেল, মেধাবি হিসেবেই বিবেচনা করা হতো, তাদের সেই ব্যক্তিত্ব ছিল। কিন্তু সেখান থেকে এমন পতন হলো, এ ধরনের পদ সব চাটুকার দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হয়। এর ফল হলো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেল। এক ব্যক্তিই সব ডিকটেট করতো, কোর্ট কী রায় দেবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার কী হবে, এগুলোর নির্দেশনাও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেই আসতো। ওনার কিন্তু এসব ব্যাপারে মাথা ঘামানোর কথা নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই বিকল হয়ে পড়েছিল। এমনকি সুদের হার কত হবে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকেও নির্দেশনা নিয়ে আসতে হতো। অথচ তিনি সুপ্রিম, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা তার রয়েছে। অর্থাৎ তিনি (শেখ হাসিনা) কোনো ধরনের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স রাখেননি।
সময় সংবাদ: বিগত সরকার অর্থনীতিকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছে, সে পরিস্থিতি উত্তরণ কতটা কঠিন?
ড. জাহিদ হোসেন:
একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা এবং সেটাকে ম্যানেজ করা তা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে ম্যানেজ করা আরও বেশি কঠিন। এর কারণ হলো অনিয়মের ফলে নিয়ম কানুন ভেঙে পড়েছে, ভালো মানুষগুলো বের হয়ে গেছে। এখন এই পরিস্থিতিতে বর্তমানে কে দক্ষ, কে দক্ষ নয়, কে সৎ, কে অসৎ ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাই রূপ পাল্টে ফেলছে। সেই জায়গা থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, অনেক বেশি কঠিন।
সময় সংবাদ: বিগত সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে ‘কুইক রেন্টাল’ এবং বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির বিষয়টি ছিল বহুল আলোচিত, অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব কি ছিল?
ড. জাহিদ হোসেন: বিগত সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, কিংবা তার আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। মূলত তার আগের বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তাদের মনোযোগ ছিল বিদ্যুৎ সঞ্চালনে। যার সূত্র ধরেই কিন্তু ‘খাম্বা’র বিষয়টি চলে আসে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল আমাদের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎই উৎপাদন হচ্ছে না। সেজন্য পরবর্তী সরকারের সামনে প্রথমেই গুরুত্ব পায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি। যার সূত্র ধরে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কুইক রেন্টালের মডেলটি এলো। এটা কিন্তু আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েই হাতে নেয়া হয়। পরবর্তীতে হাসিনা সরকার এসে এটিকে আরও দ্রুত এগিয়ে নেয় এবং এর মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কুইক রেন্টালের উদ্যোগ নেয়া হলেও তারা কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই প্রকিউরমেন্টগুলো করছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই দ্রুত বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করল। আর এর মধ্য দিয়েই দুর্নীতির অবারিত দ্বার উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কুইক রেন্টালকে গ্রহণ করা হয়েছিল সাময়িক সমাধান হিসেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সেটাকেই আইনি সুরক্ষা দিয়ে স্থায়ী সমাধান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এর পথ ধরেই সামিট, ওরিয়ন গ্রুপের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এতে জড়িয়ে পড়ল। এবং এসব ক্ষেত্রে যে ধরনের হরিলুটের চুক্তি হলো তা নজিরবিহীন। হয়তো এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ল, কিন্তু এর সাথে সাথে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে গেল। এর ফলে অর্থনীতিতে যে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ শুরু হলো তা আর বন্ধ করা গেল না।
সময় সংবাদ: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। আবার এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়টিও উঠে আসে। অর্থনীতির ওপর বিগত সরকারের অবকাঠামো নীতি কী প্রভাব ফেলে?
ড. জাহিদ হোসেন: আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে সে সময় একটা প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছিল অবকাঠামো খাত সম্প্রসারণের। বড় বড় অবকাঠামোর আসলেই প্রয়োজন ছিল। নীতিগতভাবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের এই অবকাঠামো সম্প্রসারণের পলিসি খারাপ ছিল না, কিন্তু এই পলিসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা পরিণত হলো লুটপাটের ক্ষেত্রে। অবকাঠামোর নামে কাজ যে কিছু হয়নি তা বলা যাবে না। বেশ কিছু রাস্তা হয়েছে। পদ্মা সেতু হয়েছে। বেশ কিছু হাইওয়ে হয়েছে, মেট্রোরেল হয়েছে, এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ‘মেগা করাপশন’ও হয়েছে। দুর্নীতি ও অবকাঠামো নির্মাণ হাত ধরাধরি করে চলেছে।
সময় সংবাদ: আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে বিগত সরকারের অবস্থান কেমন ছিল?
ড. জাহিদ হোসেন:
আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে, মাইক্রো ইকোনোমিক পলিসি, ফিসক্যাল পলিসি, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রাইসিং পলিসি এই যে বিভিন্ন ধরনের ইকোনোমিক পলিসিগুলো রয়েছে। সেগুলোর ক্ষেত্রে বিগত সরকারের আমলে কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। প্রয়োজন ছিল এক ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আরেক ধরনের। একটার সঙ্গে আরেকটার যেন কোনো সঙ্গতি ছিল না। অর্থাৎ পলিসির কোনো স্টাবিলিটি ছিল না। আজকে একটা বললাম, কালকে তা উল্টে দিলাম। এর কুপ্রভাব পড়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
আর্থিক নীতি একেবারে নিখুঁত নাও হতে পারে। তবে বিনিয়োগকারীরা যদি এখানে বিনিয়োগ করতে চান, এই মাঠে খেলতে চান, তারা দেখে এই নিয়ম কানুন সবার জন্য সমান হবে, এমনকি যদি সেটা ফাউলও হয়; তাহলে কিন্তু খেলাটা হয়। অর্থাৎ মাঠটা সমান হতে হবে। রেফারিংও নিরপেক্ষ হতে হবে। তো বিগত সরকারের আমলে এটার বড্ড অভাব ছিল। অর্থাৎ সুশাসনের অভাব ছিল। যদি পলিসির প্রেডিক্টিবিলিটি না থাকে তাহলে তার প্রভাব পড়ে অর্থনীতির ওপর। এমন নয় যে পলিসি একেবারে পরিবর্তন করা যাবে না; করা যাবে। কিন্তু সেটা খেয়াল খুশিমতো বদলানো যাবে না। বদলালেও তার উপযুক্ত কারণ ও ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এ রকম পরিবেশে কিন্তু বিনিয়োগকারীরা ভরসা পান যে এ রকম ক্ষেত্রে আমার বিনিয়োগটা রক্ষা পাবে। কারণ সরকারি নীতির অস্থিরতার কারণে কোনো বিনিয়োগকারীই লোকসান করতে চাইবে না। মূলত অর্থনীতির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোনো নীতি না থাকার কারণে এবং খেয়াল খুশিমতো তা পরিচালনার কারণে রোগটা ছড়িয়ে পড়ে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট সব খাতে পরবর্তীতে যা হয়ে পড়ে অনিরাময়যোগ্য।
সময় সংবাদ: বিগত সরকারের আর্থিক খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কতটা দায় রয়েছে এই পরিস্থিতির পেছনে?
ড. জাহিদ হোসেন: বিগত সরকারের আমলে কর্মকর্তাদের অনেকেরই যোগ্যতা থাকলেও মূলত সাহসের অভাব পরিলক্ষিত হয় তাদের মধ্যে। যেমন অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আব্দুল মুহিত যে অযোগ্য ছিলেন তা বলা যাবে না, এর আগেও (এরশাদ সরকারের আমলে) তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় সামলেছেন। কিন্তু তার সাহসের অভাব ছিল। মানে উনি ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন মন্ত্রিত্ব ওনার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমনকি মন্ত্রিত্বের শেষ দিকেও তিনি বলেছিলেন, উনি (শেখ হাসিনা) যদি চান, আমি আরও একবছর থাকতে রাজি আছি। অর্থাৎ আমি যে কথাটি বলতে চেয়েছি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিনি অপ্রিয় কথাগুলো বলতে চাননি, অপ্রিয় সত্যগুলো তুলে ধরতে চাননি, যে কথায় তিনি রুষ্ট হন সে বিষয়গুলো তার সামনে আনতে চাননি। অথচ দেশের আর্থিক খাতের প্রধান হিসেবে এগুলো তার কর্তব্য ছিল। কারণ সরকারের প্রথম দিকেই কিন্তু শেখ হাসিনা এতটা স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়েননি, বা তিনি ক্লোজ একটি সার্কেলে আটকা পড়েননি। সে সময় অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি চাইলে শেখ হাসিনার সামনে বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারতেন, যেমন বেসিক ব্যাংকের বাচ্চুর দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়টি। কিন্তু তিনি তা করেননি।
পাশাপাশি এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিটিআরসি, বিইআরসিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার বদলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আনুগত্য ও তোষামোদিকে। সব মিলিয়ে এগুলোই ছিল মোটা দাগে আর্থিক অব্যবস্থাপনার উদাহরণ বিগত সরকারের।
সময়টিভি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন