ড. ছিদ্দিকুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসেবে ২০১১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি একই ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউনিসেফসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৯ সালে দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি এবং ১৯৮২ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট ডক্টরেট অর্জনকারী ছিদ্দিকুর রহমান কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক
সমকাল: একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের অঘটন। সর্বশেষ পিএসসিতেও তা দেখলাম। এ বিষয়ে আপনার প্রাথমিক মন্তব্য কী?
ছিদ্দিকুর রহমান: প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা যেভাবে ঘটছে, তা আমাদের সামষ্টিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের লক্ষণ। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) কিংবা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নৈতিকতা শেষ হলে সমাজ তার আদর্শ হারাবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি গর্হিত কাজ। এর সুযোগ দেওয়া মানে সমাজ ও রাষ্ট্র অযোগ্যদের দখলে চলে যাওয়া। সে জন্য এর সঙ্গে জড়িতদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না।
সমকাল: যাদের নাম সংবাদমাধ্যমে আসছে, তারাই কি শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত বা এর জন্য দায়ী?
ছিদ্দিকুর রহমান: আমি মনে করি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে দুটি পক্ষ দায়ী। এক পক্ষ প্রত্যক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত, যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে। আরেক দল জড়িত পরোক্ষভাবে।
সমকাল: পরোক্ষভাবে জড়িত?
ছিদ্দিকুর রহমান: হ্যাঁ, যারা গোপনীয়তা রক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারছেন না; যারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসে আছেন, যেমন– পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, সেখানকার সদস্য, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তারা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন না। তারা হয়তো নিজেরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন না, কিন্তু এটি রোধ এবং প্রশ্নের গোপনীয়তা রক্ষা করা তাদেরই দায়িত্ব। শুধু পিএসসিতে নয়; শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কথাও বলছি। তাদের সরিয়ে দিয়ে সেসব পদে যোগ্য লোক বসানো উচিত।
সমকাল: যারা অর্থ দিয়ে প্রশ্নপত্র কিনেছে, চাকরি পেয়েছে, অর্থাৎ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুবিধাভোগী, তাদের ব্যাপারে কী বলবেন?
ছিদ্দিকুর রহমান: প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুবিধাভোগীদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তার চাইতে বেশি শাস্তি হওয়া উচিত যারা ফাঁস করছে, তাদের। আমরা দেখছি পিয়ন, গাড়িচালকরাও প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত। তারা যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ পায়, তবে কীভাবে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে? প্রশ্নের মতো গোপনীয় ও সংবেদনশীল বিষয়টির নিরাপত্তা কি এতই ঠুনকো– অফিসের যে কেউ এটি পেয়ে যাবে? ফাঁকফোকর বা দায়িত্বশীল কারও হাত ছাড়া এমনটি হওয়া কঠিন।
সমকাল: মঙ্গলবার পিএসসির চেয়ারম্যান বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস করা ভীষণ কঠিন। ছয় সেট প্রশ্ন থেকে পরীক্ষার আগমুহূর্তে লটারিতে প্রশ্নপত্র নির্ধারিত হয়।
ছিদ্দিকুর রহমান: যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে, সব প্রক্রিয়াই তাদের জানা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, লটারির আগে সব সেটই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হাতে চলে যায়। লটারিকেই কেন শুধু নিরাপত্তার মাধ্যম হিসেবে ধরা হচ্ছে? গলদ শিকার না করে যদি নিজেদের নেওয়া ব্যবস্থাকে শক্তিশালী মনে করে যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত না হয়, তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধারা চলতেই থাকবে। বলা যায়, এতে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদেরই প্রশ্রয় দেওয়া হয়।
সমকাল: সরকারি চাকরির পরীক্ষা গ্রহণ ও নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। সেখানকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রভাব কতটা?
ছিদ্দিকুর রহমান: পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার অর্থ হলো, চাকরির জন্য যারা সত্যিকারের যোগ্য, তারা বাদ পড়বে। সরকারি চাকরিতে এমনিতেই পদসংখ্যা সীমিত। সেখানে অযোগ্যরা ঢুকে পড়লে যোগ্যরা বাদ পড়বে। এতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার প্রভাব প্রশাসনের সর্বস্তরে পড়বে। মানুষ যথাযথ সেবা পাবে না। এমনকি প্রশাসনে এসে তাদের দ্বারাই অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার শঙ্কা সর্বাধিক।
সমকাল: অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসও থেমে নেই।
ছিদ্দিকুর রহমান: সব প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে একই কথা। এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোই এতদিন আলোচনায় ছিল। পিএসসির প্রতি একটা আস্থা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, সেখানেও প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র গেড়ে বসেছে। শিক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে এতদিন আমরা বলে এসেছি, এ ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে এটি বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা দেখেছি, এমনকি শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত। শিক্ষকরাই যদি এমন অপকর্ম করতে পারেন, তাহলে সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
সমকাল: প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আইনের প্রয়োগ কতটা জরুরি?
ছিদ্দিকুর রহমান: প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুরুতে যেটা বলেছি, উচ্চ পদে অযোগ্যরা বসে আছে বলেই এমন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তা না হলে দিনের পর দিন কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে? অযোগ্যদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগও নিশ্চয় জরুরি। পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধ থাকা দরকার। যারা এ অপকর্ম করছে, তারা একসঙ্গে অনেক অপরাধ করছে। (ক) প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি অপরাধ। (খ) এটি দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন আরেকটা অপরাধ। (গ) অযোগ্য প্রার্থীকে সুবিধা দেওয়া আরেক অপরাধ। (ঘ) সবচেয়ে ক্ষতি করছে যোগ্যদের পিছিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। অন্যের হক নষ্ট করা যাকে বলে। অথচ দাবি করা হচ্ছে, এই অর্থ দিয়ে ধর্মীয় কাজ করছে। এর চাইতে হতাশাজনক আর কী হতে পারে? তাদের অনুভূতি জাগ্রত না হলে এ পথ থেকে ফেরানো কঠিন।
সমকাল: আমরা আইনের কথা বলছিলাম। বুধবার প্রকাশিত সমকালের একটি প্রতিবেদন বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের আইনেই গলদ; শাস্তি হয় না।
ছিদ্দিকুর রহমান: প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আইনের গলদ আছে অবশ্যই। প্রতিবেদনে যেমনটি এসেছে, ১০ বছরের সাজা ছিল। সেটি কমিয়ে চার বছর নির্ধারণ করা হয়। এটি সঠিক হয়নি। কিন্তু তার চাইতেও হতাশাজনক, যে আইন আছে তারও প্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আইন সংশোধনের পাশাপাশি এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেখা যাচ্ছে, এসব ঘটনায় মামলা হলেও তা বছরের পর বছর আদালতে ঝুলে থাকার কারণে তারা জামিনে বের হয়ে আবার অপকর্মে যুক্ত হয়। এখানে তদন্তসহ অন্যান্য গাফিলতিও লক্ষণীয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলাগুলো এভাবে পরিচালনা করা হতাশাজনক। দ্রুত বিচার করে এসব অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে তারা প্রশ্রয় পেতেই থাকবে।
সমকাল: প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আপনি যোগ্য লোকদের যথাযোগ্য আসনে বসাতে বলছেন। সেটা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে?
ছিদ্দিকুর রহমান: ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘দ্য রাইট ম্যান ইন দ্য রাইট প্লেস’। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, পিএসসির চেয়ারম্যান, সদস্য, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক– এসব পদে যোগ্যদেরই নিয়োগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সৎ, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক, অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক। এমনকি প্রশ্নকর্তা নিয়োগেও এগুলো দেখতে হবে। অনেক সময় প্রশ্নকর্তাদের মাধ্যমেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। কোন পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, কাদের মাধ্যমে ফাঁস হয়, সেটা বের করা জরুরি। একই সঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত চুনোপুঁটিদের ধরার পাশাপাশি রাঘববোয়াল থাকলে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ছিদ্দিকুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।
সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন